ছবি : সংগৃহীত

বর্তমান সময়ের অন্যতম হিট শব্দ 'ট্রেন্ডি'। কয়েক মাস যাবৎ সর্বক্ষেত্রে 'ট্রেন্ড' চলছে 'সংস্কার'। এই 'সংস্কার' বলতে আবার ভেঙেচুরে নতুনভাবে তৈরি করা বা গড়ে তোলা বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু সব কি নতুনভাবে গড়ে তোলা যায়?

কংক্রিটের শহরে যে ফ্ল্যাটে আমরা বসবাস করি, বছর দশ পরে সেই বাড়ির দেয়ালে ড্যাম ধরলে শুধু সেই দেয়ালটায় ঠিক করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অথবা ডিজাইনে একটু পরিমার্জন বা পরিবর্তন করার করার জন্য ভেতরে দেয়াল ভেঙে এদিক-সেদিক করা হয়। পুরো ফ্ল্যাট কী আমরা ভেঙে ফেলি? অথচ এই 'সংস্কার'-এর নামে বর্তমানে মন ভাঙা হচ্ছে, সম্পর্ক ভাঙা হচ্ছে, ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলা হচ্ছে, সর্বোপরি মনুষ্যত্ব ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়তে দেখা যাচ্ছে।

প্রতিটা সেক্টরে 'বৈষম্য' দূর করতে গিয়ে আরও প্রকট করে তোলা হচ্ছে 'বৈষম্য'। কারণ একটাই, অস্থিরতা। ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দ ন্যাক্কারজনকভাবে বা নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। সর্বজনীনতা লোপ পাচ্ছে।

আমি ১৯৯৯ সালে অভিনয়কে পুরোপুরি পেশা হিসেবে গ্রহণ করি। তার পূর্বে আমি ছিলাম ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার শুধুই একজন দর্শক। সেই সময়েও লক্ষ্য করেছি, সরকার পরিবর্তন সাথে সাথে সব গণমাধ্যমে কিছু সংখ্যক অভিনয়শিল্পীর অনুপস্থিতি। পত্রিকা পাঠের মাধ্যমে জেনেছিলাম 'কালো তালিকাভুক্ত' তারা। কী অদ্ভুত!

অভিনয়শিল্পী মাত্রই হওয়ার কথা রঙিন, উজ্জ্বল। অথচ একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের অনুসারী হয়ে, তারা হয়ে গেলেন কালো বা কালিমালিপ্ত! আবার কেউ কেউ প্রতিবাদী হওয়ার কারণেও হয়েছিলেন 'কালো তালিকাভুক্ত'। অদ্ভুত বিষয়! একূলে থাকলেও দোষ ওকূলে গেলেও দোষ। এখন মধ্যবর্তী স্থানে যারা আছেন, তারা কী সুবিধাবাদী? কেউ কেউ। তবে, অধিকাংশই ভীত। ভয় কাজ হারানোর।

মূলত বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মতো অভিনয়শিল্পীরা রাজনৈতিক মতাদর্শে সচেতন হলেও, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা একপ্রকার দুর্বলতা। গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অভিনয়শিল্পীর পরিচিতি, সুনাম এক কথায় 'ফেইম' দলীয় স্বার্থে বা প্রচারণায় ব্যবহার করতে চাইতেই পারে। কিন্তু তিনি বা তারা ব্যবহৃত হবেন কি না, সেটা বারংবার ভাববার বিষয়।

প্রতিটা সেক্টরে 'বৈষম্য' দূর করতে গিয়ে আরও প্রকট করে তোলা হচ্ছে 'বৈষম্য'। কারণ একটাই, অস্থিরতা। ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দ ন্যাক্কারজনকভাবে বা নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। সর্বজনীনতা লোপ পাচ্ছে।

মনে রাখা উচিত, সৃষ্টির সেরা জীব, মানুষ যেখানে নশ্বর সেখানে একটি রাজনৈতিক দল কীভাবে অবিনশ্বর হয়? রাজনৈতিক দল মানেই জনগণকে নিয়ে খেলা, আবার জনগণেরও বুদ্ধিবৃত্তিক খেলা। অথচ অভিনয়শিল্পীরা সব সময় জনগণের নিকট 'প্রিয়', 'সম্মানীয়', 'শ্রদ্ধেয়'। অথচ অভিনয়শিল্পীদের দীর্ঘদিন যাবৎ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার চর্চা এখন জনগণের নিকট অবমূল্যায়ন হওয়ার কারণ।

বিশ্বব্যাপী সমাদৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'ফেসবুক'। এর মাধ্যমে তাই সারাবিশ্বে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকরা এখন প্রতিবাদ, মতামতের মতো ঘৃণাও প্রকাশ করছেন অনায়াসেই। সাম্প্রতিক সময়ে তাই কোনো কোনো অভিনয়শিল্পীদের নিয়েও উষ্মা প্রকাশ বা সমালোচনা করা হয়েছে ভীষণভাবে। সেই সূত্র ধরে 'সংস্কার'-এ নেমেছে অভিনয়শিল্পীরাও। স্বাভাবিক।

কারণ, একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যক্তির ভুলের দায়ভার বৃহত্তর গোষ্ঠী কেন গ্রহণ করবে? সেক্ষেত্রে, যদি বলি, 'সংস্কার'-এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন 'প্রতিকার'; এটা কী ভুল হবে? ভিজ্যুয়াল মিডিয়াতে অকল্পনীয় অসামঞ্জস্য লক্ষণীয়। সেই অসামঞ্জস্য হলো কর্মক্ষেত্রে, সম্মানীতে।

একটা শ্রেণি আকাশচুম্বী সম্মানীর বিনিময়ে কাজ করছেন। একই মুখ টিভি, সিনেমা, ওটিটি-তে দেখা যাচ্ছে। আর অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা বৃহৎ অংশ আগামীকাল তার বাসায় বাজার করতে পারবেন কি না সেই ভাবনায় ব্লাডপ্রেশার, সুগারের সমস্যায় ভুগছেন। অসুস্থ হওয়ার পরেও ডাক্তারের ভিজিট দেওয়ার ভাবনায় দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা এবং গ্যাসের ওষুধ খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। এজন্য প্রয়োজন এক্টরস এজেন্সি?

আরে সেজন্যেও তো অর্থ প্রয়োজন। এজেন্সি তো বিনামূল্যে সার্ভিস দেবে না, তাই না? সহমর্মী হোন। আগে আকাশপাতাল অসমবণ্টন, এর প্রতিকার করুন। নিজেদের সংশোধন করে, যতটা প্রয়োজন ততটা গ্রহণ করে সহকর্মীদের সুযোগ দিয়ে, কর্মক্ষেত্রকে সচল রাখুন। থামতে শিখুন। অন্তর্গত চাহিদাকে লাগাম টেনে, একে অপরের কথা ভাবুন।

আগে সব অব্যবস্থাপনার প্রতিকার করে, তারপর সংস্কারে নামুন। অগ্রজদের এখন দোষ ধরা, আঙুল তুলে জবাবদিহিতার প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করার পূর্বে মনে রাখবেন, আপনার আজকের এই পথ কিন্তু তাদেরই তৈরি করা। তাই আগামীতে আপনাদের দিকেও যেন এমন আঙুল না ওঠায় কেউ।

তাই বিগত দিনের ভুল নিয়ে কথা বললে হবে না অনুজদের দায়িত্ব বর্তায় বিগত ভুলের পাশাপাশি নিজেদের ভুলগুলোও শুধরে নেওয়া। এজন্য কখনোই অগ্রজদের দোষী সাব্যস্ত করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সোজা কথায় যদি বলি, বাবার ভুল দেখলে সর্বাঙ্গে সন্তানকে সতর্ক হতে হয় যেন ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয়।

একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সর্বক্ষেত্রে 'সংস্কার'-এর নামে যে অবমাননা, অসহনশীলতা, অমানবিকতা, অস্থিরতা, বৈষম্যমূলক আচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা সত্যিই হানিকারক। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, সেই বিচারে জনগণের নিকট কোন আমলে, কোন সরকার সঠিক ছিল? বুঝতে পারি না।

দীর্ঘ ১৫ বছর নির্দিষ্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল। ১৫ বছর পর সব বয়সের, পেশার, ধর্মের এক কথায় আপামর জনসাধারণের আন্দোলনের মুখে পতন ঘটে উক্ত শাসনামল। ঐ পতনের দিন থেকেই এক অদ্ভুত সহিংসতা, অস্থিরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী সমাদৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম 'ফেসবুক'। এর মাধ্যমে তাই সারাবিশ্বে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকরা এখন প্রতিবাদ, মতামতের মতো ঘৃণাও প্রকাশ করছেন অনায়াসেই।

আবার আশ্চর্যজনকভাবে লজ্জিত হয়ে কিছু মানুষ দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাও করেন। যা সত্যিই আশাবাদী করে তুললেও কিছুদিন পর শিক্ষকদের অপসারণ, ধর্মীয় অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয়, নারী-পুরুষের ভেদাভেদ, মানুষে মানুষে বিদ্বেষ, ক্রোধ 'বৈষম্য' প্রকট করে তুলছে।

নমনীয়তা, সহনশীলতা লোপ পাচ্ছে। অধৈর্য, ফেসবুকের কারণেই হোক তিলকে তাল করা হচ্ছে। গুজব ছড়ানো ও লাফানো পরিলক্ষিত হচ্ছে।

অথচ, বাংলাদেশে শিক্ষার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ বা কিছু বেশি। শিক্ষিত মানুষ হবে অহিংস। মুখ খুললেই যত সমস্যা। কারণ, সবার কথা কী সবাই বুঝে না বোঝার চেষ্টা করে? আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, আদ্যোপান্ত না জেনে, না বুঝে, না বিবেচনা করে কেবল প্রতিবাদ করা হচ্ছে।

আপামর জনসাধারণের কথা ভেবে, যুক্তিসংগত পয়েন্ট নিয়ে, নীরব প্রতিবাদ তো দেখছি না! প্রতিবাদ সর্বজনীনতা হারিয়েছে। গোষ্ঠী, ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে।

সময় আছে, ভাবুন, মানবিক শিক্ষা, ধর্ম নিরপেক্ষতা, অহিংসা, দেশপ্রেম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাসকে বিনির্মাণ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সুনাগরিক কীভাবে গড়ে তোলা যায়। শান্ত হোন সবাই।

যে দেশে নিজে বসবাস করতে চান সে দেশে কি কেবল নিজের পরিবার এবং আত্মীয়-পরিজন নিয়ে বসবাস করবেন? কোনো সমাজব্যবস্থায় কী চান না? যদি চান, তবে 'সংস্কার' নয় 'প্রতিকার' করুন। সমবণ্টনে বিশ্বাস করুন।

নাজনীন হাসান চুমকী ।। অভিনেত্রী, নাট্যকার ও পরিচালক