সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং অর্থনীতি পুনর্নির্মাণ কিংবা পুনর্গঠন করা সহজ কাজ নয়। এ বিষয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশ্বের অসংখ্য রাষ্ট্রের ধারাবাহিক পুনর্নির্মাণের কাজ নিয়মিতভাবে অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও সেখানেও নানাবিধ চ্যালেঞ্জ সামনে থাকে। তারপরও রাষ্ট্রসমূহ রাজনৈতিক সংস্কারের রোডম্যাপ মাথায় নিয়ে এগিয়ে চলে।

এমন ধারাবাহিক সংস্কারের রোডম্যাপ বাংলাদেশেও থাকা উচিত। কারণ ধারাবাহিকভাবে সংস্কারের কাজ করতে না পারলে সেটি যথাযথভাবে ঘরে তোলা সম্ভব হবে না। বর্তমান বাস্তবতায় এমন প্রসঙ্গটি আরও বেশি ন্যায্য হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের জন্য।

এখানে জনগণের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে নতুন দিগন্তে চোখ মেলানোর। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথ মোটেও মসৃণ নয়। এত বছরে আমাদের পথ চলাটা যেমন খুব বেশি মসৃণ ছিল না, তেমনি আগামীর পথ চলাও মসৃণ হবে না। এই দেশে অনেক উত্থান-পতন ছিল। অস্থিরতাও সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।

আমরা জানি, বাংলাদেশে উদার গণতন্ত্রের উপাদানগুলো সবসময়ই অনুপস্থিত। আর এই দীর্ঘ সময়ের অনুপস্থিত উপাদানগুলোর যথাযথ সংস্কার রাতারাতি সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজানোর বিষয়টি অগ্রাধিকার পায়। যা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।

নানা প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চাই, তার জন্য দরকার আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা

গণতন্ত্রের জন্য সবার আগে প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা। কিন্তু কেবল এটাই যথেষ্ট নয়। সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘নির্বাচনে সঠিকভাবে ভোট প্রদান করা একটি দক্ষতা, যা অন্যান্য বিদ্যার মতোই আয়ত্ত করতে হয়। একজন অন্ধ ব্যক্তিকে যদি ঝড়ে কবলিত সাগরে জাহাজ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে যে অবস্থার উদ্ভব হবে, জনগণের উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া ভোট প্রদানের ক্ষমতায় দেশের অবস্থা হয় ঠিক তেমনই।’

ভবিষ্যতের চলার পথ মসৃণ করতে হলে অতীতের ভুল চিহ্নিত করে শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ইতিপূর্বে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় বিধিবিধানের অসমাঞ্জস্যতায় দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের পথ মসৃণ হয়নি। নানা প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চাই, তার জন্য দরকার আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা।

আমরা জানি শুধু তথাকথিত তৃতীয় বিশ্ব নয়, উন্নত বিশ্বেও এখন গণতন্ত্রের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কথাই বলা যায়। সেখানে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক হয়। কী সত্যি, কী মিথ্যা তা নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। এমনকি তাদের রাজনৈতিক সংস্কারও ন্যায্যভাবে প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। সেখানকার গণতন্ত্রকেও এখন অনেকেই ডলারোক্র্যাসিতে আখ্যা দেয়। সেখানেও উগ্রগোষ্ঠীর তৎপরতা রয়েছে।

আজকের যুগে সামরিক শাসনের হুমকি ততটা মাথাব্যথার কারণ নয়। বরং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি টানাপোড়েনে কিছু উগ্রগোষ্ঠীর অপতৎপরতা এবং সুযোগ নেওয়ার ঘটনা অনেক। পাশাপাশি কোনো বিশেষ আদর্শ বা দর্শনও সৃষ্টি হতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশে আমরা এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ে প্রবেশ করেছি। আমাদের স্বপ্ন অনেক। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে এখনো টানাপোড়েনের ক্ষেত্র দৃশ্যমান। আর এই টানাপোড়েনের ক্ষেত্রে উদার গণতন্ত্র গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ থাকাটা খুব স্বাভাবিক।

বর্তমান সরকার দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সংস্কারের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাতে অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যেই। দেশে নানা শ্রেণি পেশার মানুষ, ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রভাব এড়িয়ে ন্যায্য এবং যুক্তিসঙ্গত রাস্তায় সংস্কার এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টি খুব সতর্কভাবে মোকাবিলার প্রয়োজন রয়েছে।

বিশেষ করে এই সংস্কারকে ঘিরে মুখোমুখি হচ্ছে দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক গোষ্ঠীসমূহ। অন্যদিকে পর্দার আড়ালেই থেকে যাচ্ছে দেশি বিদেশি উগ্রগোষ্ঠী সৃষ্টির আশঙ্কা কিংবা ভিন্ন ভিন্ন ষড়যন্ত্র।

বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের তরুণদের স্লোগান হচ্ছে, ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই’। বাংলাদেশে আমরা এবার এমন স্লোগানই দেখেছি। তবে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতাদের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যতা তৈরি করে তরুণরা তাদের ন্যায়বিচাররে দাবিটি যথাযথভাবে ঘরে তুলতে পারবে কিনা সেটি একটি প্রশ্ন।

কারণ বাংলাদেশের ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ক্ষেত্রেও আমরা খেয়াল করেছি যে যেভাবে আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল ন্যায়বিচারের, তা নানা কারণে তরুণদের কিছুটা নিরুৎসাহের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। যদিও সাময়িক এই চ্যালেঞ্জকে আরও গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ কিংবা সংকট মোকাবিলা করতে বড় ভূমিকা হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব অতিমাত্রায় সামনে আসছে। সেখানে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি।

আবার কোনো একটি গোষ্ঠী বা মহল এ বিষয়ে সুযোগ নিতে চাইবে না যে তা কিন্তু নয়। যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে সংস্কার কিংবা বিপ্লবের সুযোগ দেশে দীর্ঘমেয়াদি সংকটের পরিবেশ হয়েছে। মোটা দাগে এক্ষেত্রে বলা যায় যে আমাদের তরুণ সমাজ যতই দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে চাক না কেন এতে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আগানো অনেকটা চ্যালেঞ্জিং।

যেকোনো দেশের ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য প্রয়োজন ওই দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কার এবং জনআকাঙ্ক্ষা সম্পন্ন ভবিষ্যৎ তৈরি করতে একটি উন্নত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজন।

এজন্য সব রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। এ দেশের মানুষ বারবার লড়াই করেছে, কিন্তু চূড়ান্ত মুক্তি সম্ভব হয়নি। সংস্কৃতি চর্চার প্রসার ঘটানোর চেষ্টা থাকলেও বারবার সেটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

আমরা সবাই জানি আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতি এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে সমাজে তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নিতে পারে। কাজেই আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতি এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেকোনো সংস্কারের অগ্রাধিকার নির্ণয়ে মৌলিক নীতি ও মানদণ্ড হওয়া উচিত।

নানা প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চাই, তার জন্য দরকার আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা।

যে সংস্কারগুলো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সহায়ক, সেগুলো অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, অন্যদিকে যে সংস্কারগুলো আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে অবনতি বা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়, তা সংস্কারের বাইরে রাখা উচিত।

দীর্ঘদিন থেকে গড়ে ওঠা একটি সিস্টেমকে সহজ এবং সরল সমীকরণে জনগণের জন্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশের সরকার এবং জনগণ উভয়েরই বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন। শুধু সরকার নয় বাংলাদেশে ১৭ কোটি মানুষের মন-মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন না আনতে পারলে কখনোই পরিপূর্ণ স্থায়ী রাজনৈতিক সংস্কার সম্ভব নয়।

দেশের প্রতিটি প্রশাসনিক স্তরের দায়িত্বশীলদের যেমন সংস্কার প্রয়োজন তেমনি যারা সেবা গ্রহণ করবে তাদের মনেও শতভাগ ইতিবাচক প্রবণতা থাকতে হবে। আমাদের দেশে বেশকিছু অফিস-আদালত রয়েছে যেখানে ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না। আবার সেবা গ্রহীতারা যাতে তাদের কাজ সাধন হওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে ঘুষ অ্যাপ্রোচ করেন সেজন্য সংশ্লিষ্ট অনেক অফিসিয়াল তাদের সেবা কার্যক্রমকে কিছুটা জটিল থেকে জটিলতর করেন।

এমন অসংখ্য সেক্টর কিংবা অফিস রয়েছে, যেখানে তদবির ছাড়া একজন সাধারণ/নগণ্য মানুষ তার ন্যায্য কাজটি পান না। বারবার তাদের সংশ্লিষ্ট অফিসিয়ালদের টেবিলে টেবিলে ঘুরতে হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা রাজনৈতিক/গণতান্ত্রিক/সামরিক সরকাররা যা এতবছরেও করতে পারেনি তার যাত্রা যেন সম্পূর্ণভাবে ইতিবাচক হয়ে ওঠে। কোনো অশনি সংকেত সেই যাত্রায় বাধা হিসেবে প্রবেশ করতে না পারে—সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

আমি বিশ্বাস করি, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকার সংস্কারের মাধ্যমে আমাদের একটি পুনর্গঠিত দেশ উপহার দিতে চান বা দিতে যাচ্ছেন তা যেন আমাদের সকলের কাঙ্ক্ষিত এবং ন্যায্য কাঠামোর ভেতর আবদ্ধ হয়। অন্যায্য কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো কাঠামোর অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই কাম্য নয়।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

sultanmahmud.rana@gmail.com