সামনে বিপদ দেখলে আমরা অনেকেই ধৈর্যহারা হয়ে যাই। অনেক সময় নিজের প্রতি আবার অনেক সময় ঈশ্বরের প্রতিও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। কিন্তু আমরা যদি গভীরভাবে আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থের দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাবো যে, আমরা যদি সর্বদা ঈশ্বরের পথে থাকতে পারি; তবে ঈশ্বর স্বয়ং সর্বদা আমাদের সব বিপদ থেকে রক্ষা করবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

এই প্রতিশ্রুতি যেমন বেদে আছে, তেমনি শ্রীমদ্ভগবদগীতাতেও আছে, শ্রীচণ্ডী, রামায়ণ এবং মহাভারতেও আছে। ধর্মই ধার্মিককে রক্ষা করে। আমরা বেদ-পুরাণাদি শাস্ত্রের অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাই। মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীচণ্ডীতে আছে, দেবতাদের দ্বারা স্তবস্তুতির পর দেবী মহামায়া সব জীবের রক্ষার্থে অভয় দান করেন। তিনি স্বয়ং প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন, ভাবিকালেও তিনি আসুরিক শক্তির বিনাশে বিভিন্ন রূপে আবির্ভূতা হবেন। আবির্ভূতা হয়ে সব আসুরিক সঙ্কট থেকে সন্তানদের পরিত্রাণ করবেন।

বৈবস্বতেঽন্তরে প্রাপ্তে অষ্টাবিংশতিমে যুগে।
শম্ভো নিশুম্ভশ্চৈবান্যাবুৎপৎস্যেতে মহাসুরৌ।।
নন্দগোপগৃহে জাতা যশোদাগর্ভসম্ভবা।
ততস্তৌ নাশয়িষ্যামি বিন্ধ্যাচলনিবাসিনী।।
পুনরপ্যতিরৌদ্রেণ রূপেণ পৃথিবীতলে।
অবতীর্য হনিষ্যামি বৈপ্রচিত্তাংস্তু দানবান্।।
ভক্ষয়ন্ত্যাশ্চ তানুগ্রান্‌ বৈপ্রচিত্তান্ মহাসুরান্।
রক্তা দন্তা ভবিষ্যন্তি দাড়িমীকুসুমোপমাঃ।।
ততো মাং দেবতাঃ স্বর্গে মর্ত্যলোকে চ মানবাঃ।
স্তবন্তো ব্যাহরিষ্যন্তি সততং রক্তদন্তিকাম্‌।।
ভূয়শ্চ শতবাষিক্যামনাবৃষ্ট্যামনম্ভসি।
মুনিভিঃ সংস্তুতা ভূমৌ সম্ভবিষ্যাম্যযোনিজা।।
ততঃ শতেন নেত্রাণাং নিরীক্ষিষ্যামি যন্মুমীন্‌।
কীর্ত্তয়িষ্যন্তি মনুজাঃ শতাক্ষীমিতি মাং ততঃ।।
ততোঽহমখিলং লোকমাত্মদেহসমুদ্ভবৈঃ।
ভবিষ্যামি সুরাঃ শাকৈরাবৃষ্টেঃ প্রাণধারকৈঃ।।
শাকম্ভরীতি বিখ্যাতিং তদা যাস্যাম্যহং ভুবি।
তত্রৈব চ বধিষ্যামি দুর্গমাখ্যং মহাসুরম্‌।।
পুনশ্চাহং যদা ভীমং রূপং কৃত্বা হিমাচলে।
রক্ষাংসি ক্ষয়য়িষ্যামি মুনীনাং ত্রাণকারণাৎ।।
তদা মাং মুনয়ঃ সর্বে স্তোষ্যন্ত্যানম্রমূর্তয়ঃ।
ভীমাদেবীতি বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি।।
যদারুণাখ্যস্ত্রৈলোক্যে মহাবাধাং করিষ্যতি।
তদাহং ভ্রামরং রূপং কৃত্বাঽসঙ্খ্যেয়ষট্‌পদম্‌।।
ত্রৈলোক্যস্য হিতার্থায় বধিষ্যামি মহাসুরম্‌।
ভ্রামরীতি চ মাং লোকস্তদা স্তোষ্যন্তি সর্বতঃ।।
(শ্রীচণ্ডী:১১.৪১-৫৪)

“দেবী বললেন, বৈবস্বত মনুর অধিকার সময়ে (সপ্তম মন্বন্তরে) অষ্টাবিংশতি—সংখ্যক চতুর্যুগে (কলি ও দ্বাপরের সন্ধিতে) শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অন্য মহাসুরদ্বয় উৎপন্ন হবে। তখন নন্দগোপগৃহে যশোদার গর্ভে জন্মগ্রহণ করে বিন্ধ্যাচলে অবস্থান করে আমি সেই দুই অসুরকে সংহার করব।

শ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ের আগামীতে দেবী বিভিন্নরূপে আবির্ভূতা হওয়ার প্রতিশ্রুতির অন্তিমে এক শাশ্বত অভয়বাণী প্রদান করেন। এসব আসুরিক বাধা দূর করে ধর্মসংস্থাপনের অভয়বাণীটি শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণিত ধর্মসংস্থাপনে সাথে সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়।

পুনরায় আমি অতি ভয়ঙ্করা মূর্তিতে পৃথিবীতে আবির্ভূতা হয়ে বিপ্রচিত্তিবংশীয় দানবগণ বধ করব। সেইসব উগ্রভাব বিপ্রচিত্তি বংশের অসুরদের ভক্ষণ করে নাশ করার সময় আমার দন্তসব দাড়িম্বকুসুমের মতো রক্তবর্ণ হবে। এইজন্য স্বর্গে দেবতারা ও ভূলোকে মানবেরা স্তব করার সময় আমাকে সতত ‘রক্তদন্তিকা’ নামে কীর্তন করবে।

পুনরায় শতবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টি হেতু পৃথিবী জলশূন্যা হলে মুনিগণের স্তবে আমি অযোনিসম্ভবা হয়ে আবির্ভূতা হবো। তখন স্তবকারী মুনিদের শতনয়নে নিরীক্ষণ করব। সেইজন্য মানবগণ আমাকে শতাক্ষী বলে কীর্তন করবে। হে দেবগণ! অনন্তর আমি নিজদেহজাত জীবনধারক পত্রাদি শাক দ্বারা যতদিন না বৃষ্টি হয়, ততদিন পর্যন্ত সমগ্র জগত পালন করব। তখন পৃথিবীতে আমি শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হবো। আর সেই সময়ে আমি দুর্গম নামক মহাসুরকে বধ করে আমি দুর্গাদেবী নামে প্রসিদ্ধা হবো।

পুনরায় যখন হিমালয়ে আমি ভীমামূর্তি ধারণপূর্বক মুনিদের রক্ষার জন্য রাক্ষস বিনাশ করব তখন মুনিরা প্রণতভাবে আমার স্তব করবেন। এই জন্য আমি ‘ভীমাদেবী’ নামে বিখ্যাত হবো।

যখন অরুণ নামক অসুর ত্রিভুবনের মহা বিঘ্ন উৎপন্ন করবে, তখন আমি অসংখ্য ভ্রমর বিশিষ্ট আকৃতি ধারণ করে ত্রিভুবনের মঙ্গলহেতু সেই মহাসুরকে বিনাশ করবো। এইজন্য সবাই আমাকে ভ্রামরী বলে স্তব করবে।”

শ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ের আগামীতে দেবী বিভিন্নরূপে আবির্ভূতা হওয়ার প্রতিশ্রুতির অন্তিমে এক শাশ্বত অভয়বাণী প্রদান করেন। এসব আসুরিক বাধা দূর করে ধর্মসংস্থাপনের অভয়বাণীটি শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণিত ধর্মসংস্থাপনে সাথে সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়। গীতায় বলা হয়েছে, জগতে অধর্মের বাড়বাড়ন্ত হলেই, ধর্ম সংস্থাপনের জন্য ভগবান স্বয়ং আবির্ভূত হয়ে সাধুদের পরিত্রাণ করবেন। গীতার মতো সেই রূপ শ্রীচণ্ডীতে দেবীও বলেছেন—
ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি।
তদা তদাবতীর্য্যাহং করিষ্যাম্যরিসংক্ষয়ম্‌।।
(শ্রীচণ্ডী:১১.৫৪-৫৫)

‘এই প্রকারে যখনই দানবদের প্রাদুর্ভাবে বিবিধ প্রকারের বিঘ্নবাধা উৎপন্ন হবে, তখনই আমি আবির্ভূতা হয়ে দেবশত্রু অসুরদের বিনাশ করব।’

যখনই দানবদের প্রাদুর্ভাব বাড়বে, তখনই দেবী আবির্ভূতা হয়ে অসুরদের বিনাশ করবেন। একই প্রকার আশ্বাস আমরা শ্রীমদ্ভগবদগীতায়ও দেখতে পাই। সেখানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন:

যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:৪.৭-৮)

‘যখন যখনই ধর্মের গ্লানি হয়ে অধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে, তখনই আমি নিজেকে সৃষ্টি করি, অর্থাৎ সাকাররূপে অবতীর্ণ হয়ে জনসমক্ষে প্রকটিত হই। এভাবেই যুগে যুগে সাধুদের পরিত্রাণ করি এবং দুষ্কৃতিকারীদের বিনাশ করে ধর্মসংস্থাপন করি।’

যখনই ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুদয় হয়, তখনই দেবী নানা বেশ ধারণ করেন, নানা রূপে আবির্ভূতা হন। অসুরদলনে নানা বেশ ধারণ করেন, নানা রূপে আবির্ভূতা হওয়ার বিষয়টি শ্রীমদ্ভগবদগীতাতে তো রয়েছে, এর সাথে সাথে দেবীভাগবতের সপ্তম স্কন্ধের অন্তর্ভুক্ত 'দেবীগীতা' নামক শাক্ত গ্রন্থেও বর্ণিত হয়েছে। 
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভূধর।

অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদা বেশান্ বিভৰ্ম্যহম্ ৷৷ দেবদৈত্যবিভাগশ্চাপ্যত এবাভবন্নৃপ৷৷
যে ন কুৰ্বন্তি তদ্ ধর্মং তচ্ছিক্ষার্থং ময়া সদা।
সম্পাদিতাস্তু নরকাস্ত্রাসো যচ্ছ্রবণাদ্ভবেৎ৷৷
(দেবীভাগবত: সপ্তম স্কন্ধ, ৩৯.২২-২৪)

‘হে ভূধর! যে যে সময়ে ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের অভ্যুদয় হয়, অর্থাৎ শ্রুতি-স্মৃতির নির্দিষ্ট ধর্ম-কর্ম পরিত্যাগ করে অপর শাস্ত্রগ্রন্থ আশ্রয় করে ধর্মের নামে অধর্ম করতে শুরু করে তখনই অধর্মকে বিনাশ করতে ভূমণ্ডলে আমি আসি নানা বেশ ধরে, নানা রূপে আবির্ভূতা হই।

বেদে আমার অনুশাসন মেনে যারা ধর্মকর্ম করে না, তাদের শিক্ষার জন্যই আমিই সৃষ্টি করেছি নানারকমের নরক। সেইসব নরকের কথা শুনলে ভয়ে তাদের চিত্ত অবশ হয়ে যাবে।’

বিভিন্নরূপে দেবী এ জগতে আবির্ভূতা হবেন সাধুদের রক্ষার্থে এবং অসুরদের বিনাশে। শ্রীচণ্ডীতেই দেবীকে মহীস্বরূপা বা পৃথিবীস্বরূপা বলা হয়েছে। জগতে বিভিন্নরূপে তিনি আসবেন। শতবর্ষব্যাপী অনাবৃষ্টির কারণে পৃথিবী জলশূন্যা হয়ে গেলে মুনিগণের স্তবে তিনি অযোনিসম্ভবা হয়ে আবির্ভূতা হয়ে স্তবকারী মুনিগণকে শতনয়নে নিরীক্ষণ করবেন।

শতনয়ন শব্দটি অনন্ত নয়ন অর্থে ব্যবহৃত। এ শতনয়ন রূপের জন্য সব মানুষ তাঁকে শতাক্ষী নামে অভিহিত করবে। এরপরে তিনি নিজদেহ থেকে জীবনধারক শাক উৎপন্ন করে যতদিন বৃষ্টি না হয়, ততদিন পর্যন্ত সমগ্র জগত পালন করে শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হবেন। শাক বলতে বর্তমানে আমরা কোনো গাছের পাতাকে বুঝি; কিন্তু শাস্ত্রে শাক শব্দটি পত্র, মূল, কাণ্ড, ত্বক, পুষ্প ইত্যাদি দশপ্রকার।

এ জগতের জড়চেতন সব বস্তুর উপাদান কারণ যেমন দেবী; তেমনি সব জগতকে পরিচালনার নিমিত্ত কারণও তিনি। অর্থাৎ তিনিই জগতের মধ্যে যেমন আছেন, তেমনি জগতকে পরিচালনাও করছেন। আবার দুর্ভিক্ষ অনাবৃষ্টি পীড়িত অবস্থায় নিজদেহ থেকে অন্ন উৎপন্ন করে জীবকে রক্ষা করেন। সবই তাঁর মায়া, তাঁর ইচ্ছা এবং তাঁর লীলা। এক হয়েও লীলা আস্বাদিতে তিনি জগতে বহুধা মূর্তিতে আবির্ভূতা হতেন। সেসব বহুধা মূর্তি দেখে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাই। তাঁকে বহু মনে করি। কিন্তু তিনি আদতে একজনই।

দেবী এ জগতে অনন্তবার অনন্তরূপে আবির্ভূতা হয়েছেন, জগতকে আসুরিক শক্তির প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করতে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আসুরিক শক্তি যতই ভয়ঙ্কর হোক, এর বিনাশ হবেই। শুধু ভয় পাওয়া যাবে না।

দেবীর অনন্ত নামের মধ্যে ‘দুর্গা’ নামটি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। দুর্গম নামক মহাসুরকে বধ করেই দেবী দুর্গা নামে অভিহিত হবেন। হিমালয়ে ভয়ংকর ভীমামূর্তি ধারণপূর্বক আসুরিক শক্তি থেকে মুনিদের রক্ষা করার জন্য দেবী ‘ভীমাদেবী’ নামে খ্যাত হবেন। অরুণ নামক অসুর ত্রিভুবনের মহা বিঘ্ন উৎপন্ন করলে, দেবী কোটি কোটি ভ্রমরের আকৃতি ধারণ করে অরুণাসুরকে বিনাশ করবেন। কোটি কোটি ভ্রমরের রূপ ধারণ করে ত্রিভুবনকে রক্ষা করার জন্যে দেবী 'ভ্রামরী' নামে আখ্যায়িত হবেন। শাস্ত্রে বর্ণিত প্রতিশ্রুত বিভিন্ন রূপের বাইরে আদ্যাশক্তি মহামায়া বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আবির্ভূত হয়েছেন।

তিনি শাস্ত্রীয় বর্ণনা অনুসারেই সর্বদা এসেছেন বিষয়টি ঠিক এমন নয়। এর বাইরেও তিনি সাত্ত্বিক স্বভাবের ব্যক্তিবর্গের বিপদে আবির্ভূতা হয়েছেন বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন স্থানে। শুভশক্তির প্রয়োজনে ভক্তের আকাঙ্ক্ষা তাকে বারেবারে অচিন্ত্য অব্যক্ত থেকে ব্যক্ত করেছে মূর্তিমান করেছেন।

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। শ্রাদ্ধশান্তিকর্মের নিয়ম হলো—যতক্ষণ শ্রাদ্ধকর্ম সমাধা না হয় ততক্ষণ মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে যিনি পারলৌকিক কৃত্যাদি করছেন সেই শ্রাদ্ধকর্তা আসন পরিত্যাগ করতে পারেন না। তবে শ্রাদ্ধকর্ম সমাধা না হওয়া পর্যন্ত যদি কখনো এমন হয় যে, শ্রাদ্ধকর্তা শ্রাদ্ধকর্মে বসে দেখছেন; চোখের সামনে তার একমাত্র শিশু সন্তান আগুন নিয়ে খেলা করতে করতে সেই আগুনে পড়ে গেছেন। তখন তিনি কী করবেন? শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে আসনে শ্রাদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকবেন, নাকি দৌড়ে গিয়ে আগে সন্তানকে রক্ষা করবেন। তিনি অবশ্যই আগে সন্তানকে রক্ষা করবেন।

দেবীর একটি অন্য রূপ কাত্যায়নী। কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে বিশেষ করে অষ্টমী, নবমী তিথিতে দেবীর পূজা করা হয়। 'ক' শব্দে ব্রহ্ম এবং ‘ক’ শব্দে শিব; ব্রহ্মরূপ সজিবকে ধারণ করে আছেন বলে, সেই মহাদেবীর নাম কাত্যায়নী। আবার মহর্ষি কাত্যায়ন সবার প্রথমে দেবীর পূজা করেছিলেন বলে, দেবীর এক নাম কাত্যায়নী।

দেবীপুরাণে দেবীর এই কাত্যায়নী, রৌদ্রী, বিন্ধ্যবাসিনী, জয়ন্তী, অজিতা, বিজয়া, অপরাজিতা, মহিষঘ্নী, সিংহবাহিনী, কালী, কপালী, কপালিনীসহ আরও কয়েকটি দানবদলনী রূপের নামকরণের তাৎপর্য পাওয়া যায়।

কং ব্রহ্ম কং শিবঃ প্রোক্তমশ্মাসারঞ্চ কং কৃতম্‌।
ধারণাদ্বসনাদ্‌ বাপি কাত্যায়নী মতা বুধৈঃ।।
রৌদ্রাণি ঘোরকর্মাণি কারণাচ্চ রৌদ্রী মতা।।
বিন্ধ্যেঽবতীর্য্য দেবার্থং হতো ঘোরো মহাভটঃ।
অদ্যাপি তত্র সাবাসা তেন সা বিন্ধ্যবাসিনী।।
জয়ন্তী জয়নাখ্যাতা অর্জিতা ন জিতা ক্বচিৎ।
বিজিত্য পদ্মনামানং দৈত্যরাজং মহাবলম্‌।
বিজয়া তেন সা দেবী লোকে চৈরাপরাজিতা।।
সিংহমারুহ্য কল্পান্তে নিহতো মহিষো যথা।
মহিষাঘ্নী ততো দেবী কন্যা বৈ সিংহবাহিনী।।
কালী দক্ষাপমানেন সর্বশত্রুনিবর্হণী।
কলনা কালসংখ্যা বা কালী দেবেষু গীয়তে।।
কপালং ব্রহ্মকং জাতং করে ধারয়তে সদা।
কপালী তেন সা প্রোক্তা পালনাদ্বা কপালিনী।।
(দেবীপুরাণ:৩৭.১০-১৬)

“দেবীর 'কাত্যায়নী' নামপ্রসঙ্গে বলা হয়েছে, 'ক' শব্দে ব্রহ্ম এবং ‘ক’ শব্দে শিব; অর্থাৎ ব্রহ্মরূপ শিবকে ধারণ করে আছেন বলে দেবীর নাম কাত্যায়নী।

দেবী ঘোর রৌদ্র কর্ম করে থাকেন, তাই তাঁর নাম 'রৌদ্রী'। তিনি দেবগণের কার্য্যসিদ্ধির জন্য বিন্ধ্যাচলে অবতীর্ণ হয়ে মহাসুর ঘোরকে বিনষ্ট করে অদ্যপি সেই বিন্ধ্যাচলে বাস করেন বলে সেই মহাদেবীর নাম 'বিন্ধ্যবাসিনী'।

দেবী সর্বত্র জয় লাভ করেন বলে, তাঁর নাম 'জয়ন্তী'। তাঁকে কেউ জয় করতে পারে না, তাই তাঁর নাম 'অজিতা'। মহাবল পদ্মনামক দৈত্যরাজকে জয় করেছেন বলে, তাঁর নাম 'বিজয়া' এবং লোকে তখন থেকে আজও দেবীকে 'অপরাজিতা' নামে অবিহিত করেন।

দেবী কল্পান্তে সিংহে আরোহণ করে মহিষাসুরকে বিনষ্ট করেছিলেন, তাই তাঁর নাম 'মহিষঘ্নী' এবং 'সিংহবাহিনী'।

দক্ষের অমানকালে তাঁর নাম 'কালী' হয়েছে, অথবা কালে সব পদার্থেরই কলন বা সংহার করেন বলে দেবগণ তাঁকে 'কালী' নামে অবহিত করেছেন। তিনি সর্বদা হাতে ব্রহ্মকপাল ধারণ করেন কিংবা পালন করেন বলে তাঁর নাম কপালী ও কপালিনী।”

শ্রীচণ্ডীতে দেবীর প্রতিশ্রুত ‘ইত্থং যদা যদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি’—এ ভাবটিই পাওয়া যায়, স্বদেশী আন্দোলনের যুগে খ্যাতিমান বাঙালি চারণকবি মুকুন্দদাসের লিখিত ‘ভয় কি মরণে’ সংগীতে। কবি সংগীতটিতে শব্দের বিন্যাস অসাধারণভাবে সাজিয়েছেন। বিশেষ করে সংগীতটির, ‘তা থৈ তা থৈ থৈ দিমি দিমি দ্রম দ্রম’ অংশটি। মনে হয় যেন দামামা বাজছে, ডমরু বাজছে, জয়ঢাক বাজছে, রণভেরী বাজছে, শঙ্খ বাজছে। আর এই সব প্রলয়ঙ্কারী বাদ্যের তালে তালে মহাকাল এবং মহাকালী উন্মাদিনী হয়ে নাচছে। সাথে রয়েছে ভূত, পিশাচ এবং যোগিনীগণ। সে এক অভূতপূর্ব দানবদলনী নৃত্য।

ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে
তা থৈ তা থৈ থৈ দিমি দিমি দ্রম দ্রম।।
ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে।।
ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।।
দানব দলনী হয়ে উন্মাদিনী
আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে।।

দেবী এ জগতে অনন্তবার অনন্তরূপে আবির্ভূতা হয়েছেন, জগতকে আসুরিক শক্তির প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করতে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আসুরিক শক্তি যতই ভয়ঙ্কর হোক, এর বিনাশ হবেই। শুধু ভয় পাওয়া যাবে না। আমরা ভয় পেয়ে যাই এবং ভয় পেয়ে নিজের প্রতি ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। এ কারণে আসুরিক শক্তি আরও শক্তিশালী হয়ে আমাদের বেশি করে গ্রাস করতে উদ্যত হয়। কিন্তু ধৈর্যহারা না হয়ে শুধু এ বিষয়টিই স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, সর্বাবস্থায় ঐশ্বরিক শক্তি আমাদের রক্ষা করবেন।

বিশ্বাস যদি আমাদের দৃঢ় থাকে, তবে অবশ্যই তিনি আমাদের যেকোনো পরিস্থিতিতেই এসে রক্ষা করবেন। বিশ্বাসটি যদি সামান্য নড়বড়ে সুতা দিয়ে বাঁধা থাকে, যা সামান্য টানাহেঁচড়াতেই ছিঁড়ে যায়; তবে তিনি কীভাবে আসবেন আমাদের রক্ষার্থে। বিশ্বাসের প্রদীপটি এমনভাবে প্রজ্বলিত হতে হবে যে, প্রচণ্ড দমকা বাতাসেও যেন প্রদীপটি নিভে না যায়। 

সর্বদা মনে রাখতে হবে, ভয়ের কিছু নেই; অসুরেরা পরাজিত হবেই। আজ যাদের মনে হচ্ছে অনন্ত শক্তিশালী, একদিন তারাই তাদের এই পৈশাচিক ভাবাপন্নতার কারণে জগতে পুরাতত্ত্বে রূপান্তরিত হয়ে দৃষ্টান্তে পরিণত হবে। 

ড. কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়