নারীবাদীদের মধ্যে একদল আছেন ইকোফেমিনিস্ট—এই ধরনের নারীবাদকে ইকোফেমিনিজম নামেই চিহ্নিত করা হয়। ইকোফেমিনিস্টরা নারী ও প্রকৃতির মধ্যে একধরনের সম্পর্ক দেখেন—নারী ও প্রকৃতির মধ্যে অনেকটা সমান্তরাল তুলনা। সর্বংসহা প্রকৃতি ও নারী উভয়ই সৃষ্টি করে, সহ্য করে সব কষ্ট, অত্যাচার, নির্যাতন, তবুও সৃষ্টি করে, সৃষ্টিকে রক্ষা করে মানুষকে রক্ষা করে।

ওদের কথা হচ্ছে প্রকৃতিকে রক্ষা করা, পৃথিবীর বুকে মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নারী ও প্রকৃতি উভয়রই প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে, রক্ষা করতে হবে যত্ন করতে হবে এবং নারী ও প্রকৃতি উভয়ের ভূমিকা ও শক্তিকে সম্মান করতে হবে।

আমাদের দেশে যখন শরৎ কাল আসে, বাতাসে ভাসতে থাকে দেবী দুর্গার আগমনী সুর, বাঙালি মেতে ওঠে মায়ের আগমন উদযাপন করবে বলে তখন আমার কেবল মনে হয় ইকোফেমিনিজমের উৎপত্তি পশ্চিমে হলেও বাংলায় যেন এই মতবাদের মূল সুরটি আবহমান কাল থেকেই আছে হিমালয়দুহিতা দুর্গারূপের একজন নারীকে পূজা করার মধ্যে।

দুর্গা কে? দুর্গা হচ্ছেন দুর্গতিনাশিনী মহাশক্তি—পৌরাণিক দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের মিলিত শক্তি থেকে সৃষ্ট দেবী যিনি প্রকৃতিতে বিরাজ করেন এবং মানুষের ও দেবতাদের বিপদের সময় আবির্ভূত হন এবং দমন করেন অশুভ শক্তিকে। বাংলায় দুর্গাকে মাতৃরূপে পূজা করা হয়। প্রতিবছর তিনি আগমন করেন তাঁর পুত্র-কন্যা কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে নিয়ে তাঁর বাবার বাড়ি বাংলায় এবং পূজার শেষে আবার চলে যান হিমালয়ে।

আমাদের দেশে যখন শরৎ কাল আসে, বাতাসে ভাসতে থাকে দেবী দুর্গার আগমনী সুর, বাঙালি মেতে ওঠে মায়ের আগমন উদযাপন করবে বলে...

ভারতবর্ষের এবং নেপালের নানা অংশে দুর্গার মতোই আরও অনেক দেবীশক্তিকে পূজা করা হয় নানা নামে—ওদের কারও থাকে দুর্গার মতোই দশটি বাহু, কারও থাকে এর চেয়ে কম বা বেশি সংখ্যক বাহু, একেক রূপে তিনি বিনাশ করেছেন একেকটি অশুভ শক্তি তথা অসুরকে, রক্ষা করেন দেবতাদের তথা প্রকৃতিকে ও মানুষকে।

আমাদের দেশে যিনি দেবী দুর্গা নামে পূজিত হন, তিনি বিনাশ করেছেন মহিষাসুরকে। মহিষাসুর বর প্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, এই মহাবিশ্বে এমন কোনো পুরুষ কখনো হবে না যে তাকে বধ করতে পারেন। এই বর পেয়ে দুষ্ট অসুর শুরু করেন উৎপাত, স্বর্গলোক থেকে সব দেবতাদের তাড়িয়ে দেন। স্বর্গচ্যুত দেবতাদের রক্ষা করার জন্যেই আবির্ভূত হন দেবী দুর্গা।

দুর্গা পূজা নিয়ে আলোচনায় একটা কথা মাঝে মাঝেই আসে, দশভুজা দেবী দুর্গার পূজার অর্থ কি তবে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীকী রূপ? দেবী দুর্গা কি তবে নারীশক্তির প্রতীক? কেউ কেউ তো এটাও বলেন যে দেবী দুর্গা হচ্ছেন বাংলা তথা ভারতবর্ষে নারীবাদেরই আইকন ইত্যাদি।

এইসব যারা বলেন ওদের কথার মধ্যে একদম যুক্তি নেই সেকথা বলতে পারি না। দুর্গা বা অন্য কোনো দেবীর পূজায় দেবীরূপে যাকে পূজা করা হচ্ছে তিনি তো একজন নারীই বটে। দুর্গার ক্ষেত্রে এই কথা যেন একটু বেশীই সত্যি—দুর্গা যেন আমাদের বাঙলারই কন্যা, তিনি একাধারে আমাদের জননী, মা এবং আমাদের কন্যাও বটে।

পূজা করতে গিয়ে যখন মন্ত্র পাঠ হয় তখন আমরা দেবী দুর্গাকে কত রূপেই না কল্পনা করি এবং প্রতিটা রূপেই তাঁকে স্তুতি করি, প্রণাম করি। দুর্গাপূজার সময় যখন পাঠ হতে থাকে লক্ষ্য করে শুনলেই বুঝতে পারবেন মন্ত্রের কথাগুলো—

‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।

যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।

যা দেবী সর্বভূতেষু বিদ্যারূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।’

এইরকম নানাপ্রকার উপমায় বন্দনা করা হয় দেবী দুর্গাকে। নানারকম শিল্প কর্ম, সাহিত্য, নাটক, সিনেমা এমনকি বিজ্ঞাপনেও, ভারতে ও বাংলাদেশে দুর্গারূপে নারীকে উপস্থাপন করতে দেখেছি। বাংলাদেশেও একবার একটি এনজিওর প্রকাশিত বইয়ে নারীকে দশভুজা আকারে উপস্থাপন করা হয়েছিল, একজন নারী সন্তান পালনসহ সংসারে হাজারো কাজ করে সেটা দেখানোর জন্যে। খুব জনপ্রিয় হয়েছিল সেই ছবিটা।

বাণিজ্যিক সিনেমায় যখন নারীর এইরকম দুর্গারূপ উপস্থাপন করা হয় লোকে সেটাকে সাধারণত সাদরেই গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু এই সবকিছুর পরেও দেবী দুর্গার এইরকম দশভুজা রূপ বা মাতৃরূপ বা শক্তিরূপ কোনোটাই প্রকৃত প্রস্তাবে নারীর প্রতি সম্মান বা নারীকে পুরুষের সমান ভাবার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

দুর্গা পূজা নিয়ে আলোচনায় একটা কথা মাঝে মাঝেই আসে, দশভুজা দেবী দুর্গার পূজার অর্থ কি তবে নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীকী রূপ? দেবী দুর্গা কি তবে নারীশক্তির প্রতীক? কেউ কেউ তো এটাও বলেন যে দেবী দুর্গা হচ্ছেন বাংলা তথা ভারতবর্ষে নারীবাদেরই আইকন ইত্যাদি।

বিশেষ করে বাঙালি সমাজে, বাংলাদেশে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, দেবী দুর্গার প্রতি ভক্তি সমাজের সর্বস্তরে বিরাজমান হলেও সাধারণভাবে নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা সেটা যেন সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। আমাদের সমাজের ও রাষ্ট্রের নানা পর্যায়ে নারীরা যতটুকুই অগ্রসর হয়েছে, রাজনৈতিক শীর্ষ পদ থেকে প্রশাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে নারী যতটুকুই অগ্রসর হয়েছে সবটুকুই নারী নিজের যোগ্যতায় অর্জন করে বটে, সব ক্ষেত্রেই নারীকে সফলতা পেতে হয় পুরুষের শর্তে, পিতৃতন্ত্রের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে এবং পিতৃতান্ত্রিক নারীবিদ্বেষী চেতনা ধারণ করে।

রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক বা অন্য কোনো ক্ষেত্রেই চট করে এমন কোনো নারীকে পাওয়া যায় না যিনি নারী ও পুরুষের সম্পূর্ণ সমতায় বিশ্বাস করেন বা সেই লক্ষ্যে কাজ করেন। এর কারণ নিহিত রয়েছে সমাজের মূল কাঠামোর মধ্যে এবং সংস্কৃতিতে—যে নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলবে তাকে আমাদের হ্রস্বতর ও সমাজ কখনোই নেতৃত্বের ভূমিকায় রাখবে না।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে আরজিকর কাণ্ড এবং এরপর সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা দেখলেই বোঝা যায়—মুখ্যমন্ত্রী শারীরিকভাবে নারী বটে, কিন্তু চেতনায় তিনি পুরুষের চেয়েও পুরুষ। আমাদের দেশেও দেখবেন, রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষে যখনই কোনো নারী অধিষ্ঠিত হয়েছেন তারা ওদের নীতিতে এবং কর্মে কখনোই পিতৃতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য বিঘ্ন হয় এমন কিছু করে না।  

তথাপি দুর্গারূপে নারীকে পূজা করার এই সংস্কৃতির গুরুত্ব আছে বটে। প্রতি শরতে প্রতি বছর দেবী দুর্গার যখন আগমন ঘটে, আমাদের সামনে দশভুজা আবির্ভূত হন সশস্ত্র রূপে—লড়াকু যুদ্ধংদেহী রূপে। প্রতিবার তিনি যেন বলেন, তোমরা সবাই একেকটা অসুর-মহিষাসুর বা অন্য কোনো অসুর। আমরা যেন সেইসব অসুর, যারা হরণ করেছি নারীর সব অধিকার। অধিকার হরণ করে নারীকে বন্দি করেছি গৃহপালিত পশুর মতো করে।

নারীকে আমরা আদর করি প্রেমিকা রূপে, শ্রদ্ধা করি মাতৃরূপে সবই ঠিক আছে—কিন্তু আমরা পুরুষরা যেন নারীকে ঠিক কী রূপে দেখতে চাই সেটা ঠিক করে দিই এবং সেই রূপে দেখলেই কেবল নারীকে সম্মান করি। আমরা কখনো নারীকে পুরুষের সমানরূপে দেখি না স্বীকার করতে চাই না।

যুগের পর যুগ পার হয়ে গেছে আমরা দুর্গাপূজা করি, তথাপি অদ্যাবধি আমরা আমাদের ঘরের দুর্গার জন্যে অন্তত পারিবারিক সম্পত্তিতে পুরুষের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করতে দেইনি। 

নারীরূপে দেবীকে পূজা করার মধ্যে নারীর প্রতি সমাজের সম্মানের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সেই সুযোগ আমাদের পুরুষশাসিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ রাখেনি। বছরের এই ক’টা দিন মা মা বলে ভক্তি গদগদ হই বটে, এরপরেই আবার ভুলে যাই যে আমাদের ঘরের যিনি মা, তিনিও একজন মানুষ।

আমরা স্বীকার করি না যে যাকে আমি মা বলে ভক্তিতে গদগদ হচ্ছি, তিনি কেবল মা নন, তিনি একটি মানবসত্তা বটে এবং তার নিজের আশা আকাঙ্ক্ষা, জীবনে কাছে চাওয়া, পাওয়া, কামনা, বাসনা সবকিছুই আছে এবং সেটা থাকাই স্বাভাবিক। অন্য কিছু বাদ দেন, আমরা তো আমাদের ঘরের দুর্গার নিজের শরীরের মালিকানাও অস্বীকার করি।

এইজন্য আমার কাছে মনে হয় দেবী দুর্গার কোনো রূপ যদি আমাদের ঘরের দুর্গার মধ্যে দেখতে চাই সেটা যেন হয় নারীর শক্তি রূপ—নারীকে জয় করতে হবে তার নিজের অধিকার। মানুষের অধিকারের মধ্যে তুচ্ছতম যে অধিকারটি, সেটিও নারীকে অর্জন করতে লড়াই করেই।

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট