চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কি হবে জীবনে তোমায় যদি পেলাম না... সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের এ গান যেন আজও সাড়া জাগায় প্রতিটি শ্রোতার মনে। সেই সময়ে গেয়ে যাওয়া গানের ভাবার্থ হয়তো আজও অনেককে ছুঁয়ে না গেলেও শ্রোতার সংখ্যা কিন্তু কমেনি। সে সময় পূজার আগ দিয়ে প্রকাশ পায় গানটি। আর বলা বাহুল্য মারমার কাটকাট অবস্থা। প্রতিটি গলিতে মহল্লায় বাজতে থাকল গানটি। আসলে মূল ব্যাপারটি হলো একটি উৎসবকে সামনে রেখে অডিও অ্যালবাম রিলিজ হওয়ার ধুম পড়ে যেত। আর শ্রোতারাও অপেক্ষা করত কোন কোন উৎসবে কার কার অ্যালবাম বের হবে। ভারতীয় উপমহাদেশের এ চিত্রের ধারা আজও বয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশে। অর্থাৎ অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো আজ অবদি অডিও অ্যালবাম রিলিজ করার জন্য অপেক্ষা করে থাকে বিভিন্ন উৎসবের। এর মধ্যে দুই ঈদ, পহেলা বৈশাখ, ভালোবাসা দিবস, পূজা অন্যতম।

যদিও অডিও অঙ্গনে আগের সেই জোয়ার নেই তবুও থেমে নেই গান প্রকাশনা। শুধু পাল্টেছে কিছু ধরন। আগে শুধু গান রিলিজ দিলেই হতো কিন্তু এখন গান অনেকটা দেখারও বিষয়। অর্থাৎ অডিও গানের পাশাপাশি এর মিউজিক ভিডিও প্রকাশ না করলে তা এখন শ্রোতাদের মাঝে খুব বেশি সাড়া জাগায় না। প্রযুক্তির কল্যাণে গান ও মিউজিক ভিডিওতে বিভিন্ন ইফেক্টের ব্যবহার। এর কিছুটা ভালো আবার কিছুটা শ্রুতি ও দৃষ্টিকটু। বারো মাসে তেরো পার্বণে অভ্যস্ত বাঙালি জাতির কৃষ্টি কালচারের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ হচ্ছে গান। যে কোনো উৎসবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সৃষ্ট হয়েছে বাংলা গান। বাংলা গানের ঐতিহ্য হাজার বছরের পুরনো। 

আরও পড়ুন >>> বীরের জাতি বাঙালি 

বাংলা গানের উদ্ভব 

ঠিক কবে থেকে বাংলা গানের প্রচলন তার সঠিক ইতিহাস না থাকলেও বাংলাদেশের প্রাচীন সঙ্গীতের পরিচয় পাওয়া যায় পাল বংশের রাজত্বকালে। অষ্টম শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতকের শেষ ভাগ পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করে পাল বংশ। এ সময়ের পালা গান বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং লোকমুখে দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে। রাগ ও প্রবন্ধ শ্রেণির সঙ্গীত এ সময়কার অন্যতম সংযোজন। এছাড়া বহুকাল ধরে বাংলা গানের আদি ভিত ধরা হয় স্তোত্রকে। দেব-দেবির মণ্ডপে ঠাকুর সুর করে যে মন্ত্র আওড়ান তাকেই স্তোত্র বলে। পাল বংশীয় সময়ে দেব-দেবীর পূজা অর্চনা বেশি ছিল বলে অধিকাংশ গানই মন্দিরের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

একাদশ শতাব্দীতে চালুক্যরা বাংলাদেশ অভিযানে আসে। সেন রাজ বংশের পূর্ব পুরুষরাই হচ্ছে চালুক্য। এক সময় বাংলাদেশের শাসন সেন বংশের হাতে চলে যায়। সেনদের অনুরাগ ছিল সংস্কৃত চর্চার প্রতি। কিন্তু ভাষাগত সমস্যা এ দেশের মানুষকে সেই সঙ্গীত থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।

বাংলাদেশের শেষ হিন্দু রাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেব রচিত গীত গোবিন্দ একটি প্রাচীন কাব্যগ্রন্থ। গীত গোবিন্দের অন্তর্ভুক্ত গানগুলোকে বলা হয় প্রবন্ধ শ্রেণির সঙ্গীত। দশম শতাব্দী থেকে প্রবন্ধ সঙ্গীতের সঙ্গে চর্যাপদ বা চর্যা প্রবন্ধের প্রচলন ছিল। জয়দেবের গান থেকে বাংলাদেশে প্রবন্ধ সঙ্গীত বিস্তার লাভ করে। চর্যাকে তাই বাংলাদেশের প্রাচীনতম সঙ্গীত বলে মনে করা হয়। চর্যা এক ধরনের যোগী সম্প্রদায়ের গীত। চর্যায় রাগের উল্লেখ আছে। এ কারণে চর্যা সঙ্গীতে রাগের প্রভাব লক্ষণীয়।

১২০১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির আগমন ঘটে এবং মুসলিম শাসনের সূত্রপাত। আর বাংলাদেশের মধ্যযুগের ইতিহাস এবং সঙ্গীতের নতুন ধারার সূচনা ঘটে এ সময় থেকে। যে সঙ্গীত আগে ছিল শুধুমাত্র দেব-দেবীর আরাধনায় নিয়োজিত সে সঙ্গীত মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে সহজ, সরল ও সাবলীল রূপ ধারণ করল। ছড়িয়ে পড়ল প্রতিটি আনাচে-কানাচে যা আগে ছিল অকল্পনীয়। কারণ, তখন তা নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির নিকট সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু মুসলমানদের কাছে সঙ্গীতের রূপ ছিল বাস্তবধর্মী এবং জাগতিক আনন্দের উৎস। মূলত এখান থেকেই সঙ্গীতের নবযুগ সূচিত হয়

১২০১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির আগমন ঘটে এবং মুসলিম শাসনের সূত্রপাত। আর বাংলাদেশের মধ্যযুগের ইতিহাস এবং সঙ্গীতের নতুন ধারার সূচনা ঘটে এ সময় থেকে। যে সঙ্গীত আগে ছিল শুধুমাত্র দেব-দেবীর আরাধনায় নিয়োজিত সে সঙ্গীত মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে সহজ, সরল ও সাবলীল রূপ ধারণ করল। ছড়িয়ে পড়ল প্রতিটি আনাচে-কানাচে যা আগে ছিল অকল্পনীয়। কারণ, তখন তা নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির নিকট সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু মুসলমানদের কাছে সঙ্গীতের রূপ ছিল বাস্তবধর্মী এবং জাগতিক আনন্দের উৎস। মূলত এখান থেকেই সঙ্গীতের নবযুগ সূচিত হয়।

আরও পড়ুন >>> ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত : ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের ইতিহাস 

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে দুই ধরনের সঙ্গীত প্রচলিত রয়েছে। (১) মার্গ সঙ্গীত (২) দেশি সঙ্গীত। মূলত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতই মার্গ সঙ্গীতের অনুসারী। বাংলা সঙ্গীত প্রধানত দেশি সঙ্গীতের আদর্শেই রচিত।

বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার

বাদ্যযন্ত্রকে যদি নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করা না যায় তাহলে বলা যায় যে পদার্থ হতে আঘাতের মাধ্যমে শব্দের সৃষ্টি হয় তাই বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু শাস্ত্রীয় ভাষায় গানের ছন্দকে আরও সুমধুর করে তুলতে এবং নির্দিষ্ট যাত্রায় পরিচালনাকারী যন্ত্রই হচ্ছে বাদ্যযন্ত্র। একটা সময় যখন মানুষ খালি গালায় গান গাইত তখন হাতের কাছে যাই থাকত তা দিয়ে শব্দ বের করে এনে গানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করত। সে সময় থেকেই বাদ্যযন্ত্র ধারণার উৎপত্তি। এরই ধারাবাহিকতায় একতারা, খোল ও দোতারার সৃষ্টি।

মধ্যযুগের পরপরই মোগল সাম্রাজ্যের সময় বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। হারমোনিয়াম-তবলার ব্যবহার মোগল শাসনামলে উল্লেখ রয়েছে। সম্রাট আকবরের নবরত্নের সদস্য মিয়া তানসেনের তানপুরা ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কথিত আছে, মিয়া তানসেন মেঘমল্লার রাগ পরিবেশন করে বৃষ্টি নামাতে সক্ষম হয়েছিলেন আবার ভৈরবী রাগ পরিবেশন করে রাতের বেলায়ই ভোরের আবহ সৃষ্টি করেছেন। সঙ্গীতের প্রতি কতটা নিবেদিত হলে এমনটা সম্ভব। সঙ্গীতচর্চা ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে এ সময় থেকেই।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশ চেয়েছিলেন 

হয়তো গানের সেই ভক্তি থেকে এখন আমরা অনেকটাই দূরে। তারপরও ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসার জায়গা কমেনি একটুও। তবে এ কথাও ঠিক শুধু আবেগ দিয়ে সঙ্গীত প্রতিষ্ঠা পায় না। সাধনা এর জন্য অবশ্যম্ভাবী।

গ্রামোফোন

গানের জগতে গ্রামোফোন এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। গানের জগতে প্রযুক্তির প্রথম ব্যবহার। ধারণা করা হয়, এ যন্ত্র আবিষ্কার না হলে গানের জোরাল আবেদন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না। গ্রামোফোনের প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮৭৭ সালে। টমাস এডিসন এই ধারণার উদ্ভাবক। কিন্তু তিনি এর পরিপূর্ণতা দিতে পারেননি। পরবর্তীতে ১৮৮৭ সালে এমিল বার্লাইনার একটি পরিপূর্ণ গ্রামোফোন তৈরি করতে সক্ষম হন। গ্রামোফোনের মাধ্যমে তিনি গান ধরে রাখতে সম্ভব হন। এরই ফলশ্রুতিতে গান রেকর্ড করার কলাকৌশল রপ্ত করেন। সে ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ সালে তিনি এইচএমভি প্রতিষ্ঠা করেন যার স্বত্ব পরবর্তীতে তিনি ভিক্টোর টকিং মেশিন কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেন। সেই সময়েই ভারতে এইচএমভির আগমন এবং তৎকালীন সময়ে একমাত্র গ্রামোফোন রেকর্ডিং কোম্পানি ছিল এইচএমভি। ভিনদেশি এক কোম্পানি পুরো ভারত বর্ষ বাজিমাত করে দিল। তখন থেকেই গান ব্যবসায়িক অবয়ব খুঁজে পেল। বাণিজ্যিক পণ্য রূপে প্রকাশ হতে লাগলো গান। বাণিজ্যিক পণ্য বলতে যা দিয়ে ব্যবসা করা যায়। অর্থাৎ পুঁজি খাটিয়ে আসলসহ লাভ তুলে আনা যায়। গানের ক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি ঘটতে শুরু করলো। অডিও ধারণ করা বাবদ খরচ এবং শিল্পীর সম্মানীসহ খরচ করা মোট টাকা শ্রোতাদের শুনিয়ে বাজার থেকে সেই টাকা লাভসহ তুলে আনার বাণিজ্য চলছে প্রযুক্তির কল্যাণে আজ পর্যন্ত।

একটা সময় ছিল যখন গুণী শিল্পীদের ডেকে এনে অডিও অ্যালবাম করার আমন্ত্রণ জানানো হতো। ভালো একটা সম্মানী বরাদ্দ থাকত তাদের জন্য। শুধু প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের ক্ষেত্রেই নয় নতুনদের মধ্যে যারা ভালো গাইতে পারত তাদের খুঁজে বের করে অ্যালবামের কাজ শুরু হতো। যে কারণে অ্যালবামটি হতো মানসম্মত এবং তা সহজেই পৌঁছে যেত শ্রোতাদের ঘর পর্যন্ত। শিল্পীদের মানমর্যাদা বৃদ্ধি, রুটিরুজি এবং অডিও বাজারের প্রাণ দুটোই বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকত। কিন্তু কালের প্রবাহ-ই বলি কিংবা আকাশ সংস্কৃতির কবল-ই বলি, নিজেরাই টুঁটি চেপে ধরেছি অডিও শিল্পের। অনেকটা ব্যক্তিগত স্বার্থের বলি আজকের এই অডিও শিল্প

অ্যালবাম প্রকাশনার ধরন

আমাদের দেশে আকাশ সংস্কৃতি বিস্তার করেছে খুব বেশিদিন হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে এর সুবিধা কিংবা অসুবিধা দুটোর সঙ্গেই বেশ ভালোভাবেই পরিচয় ঘটেছে আমাদের। যে কারণে অডিও বাজারের সেই জোয়ার এখন আর তেমন নেই। অর্থাৎ অডিও অ্যালবামের শ্রোতাপ্রিয়তা এবং ব্যবসায়িক সাফল্য কোনোটাই যেন এখন তেমন চোখে পড়ে না। এরই মধ্য দিয়ে পাল্টে গেছে অডিও অ্যালবাম প্রকাশের ধরন। একটা সময় ছিল যখন গুণী শিল্পীদের ডেকে এনে অডিও অ্যালবাম করার আমন্ত্রণ জানানো হতো। ভালো একটা সম্মানী বরাদ্দ থাকত তাদের জন্য। শুধু প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের ক্ষেত্রেই নয় নতুনদের মধ্যে যারা ভালো গাইতে পারত তাদের খুঁজে বের করে অ্যালবামের কাজ শুরু হতো। যে কারণে অ্যালবামটি হতো মানসম্মত এবং তা সহজেই পৌঁছে যেত শ্রোতাদের ঘর পর্যন্ত। শিল্পীদের মানমর্যাদা বৃদ্ধি, রুটিরুজি এবং অডিও বাজারের প্রাণ দুটোই বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকত। কিন্তু কালের প্রবাহ-ই বলি কিংবা আকাশ সংস্কৃতির কবল-ই বলি, নিজেরাই টুঁটি চেপে ধরেছি অডিও শিল্পের। অনেকটা ব্যক্তিগত স্বার্থের বলি আজকের এই অডিও শিল্প। যেমন- সঙ্গীতে জ্ঞানলব্ধ কিংবা জ্ঞানহীন যে কেউ চাইলেই এখন ছাড়তে পারছেন অডিও অ্যালবাম। বরং সঙ্গীতের গণ্ডি না পেরোনো ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাই যেন বেশি। এদের ভিড়ে সঙ্গীত সাধকদের খুঁজে পাওয়াই যেন দায়। এ কাজটি হয়েছে কোনো সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি না থাকায়। নেই অডিও শিল্পের কোনো বিধিবিধান। যে কারণে মিউজিক ডিরেক্টরদের পক্ষ থেকেও আসছে না কোনো আপত্তি। কারণ, শিল্পী যেই হোক তার নির্দিষ্ট রেমুনেরেশন (পারিশ্রমিক) ঠিকই চলে আসছে। অবশ্য সবার ক্ষেত্রে এমনটি হয় না। কারণ, এখনও অনেকে আছেন যারা বেছে কাজ করছেন। কিন্তু সুযোগ সন্ধানী লোকই যেন বেশি। প্রযুক্তির কল্যাণে গান এখন ঘরে বসেই রেকর্ড করা যায় তবে তা কতটুকু মানদণ্ডে দণ্ডিত তা দেখার বিষয়। 

আরও পড়ুন >>> উৎসবগুলো সম্প্রীতির কথা বলে 

প্রযুক্তির ধারাবাহিকতায় অডিও ক্যাসেট, সিডি, মেমোরি কার্ড ও ইউটিউব 

গ্রামোফোনে যে রেকর্ডার বাজানো হতো তার এপিঠ একটি এবং ওপিঠে একটি, মোট দুটি গান থাকত। চাবি ঘুরিয়ে মাউথ পিসের মতো একটি অংশ রেকর্ডারের ওপর স্থাপন করা মাত্রই গান বেজে উঠত। কিন্তু বারবার রেকর্ডার পাল্টিয়ে পাল্টিয়ে গান শোনার ধৈর্য যেন হারিয়ে ফেলছিল। ঠিক সে সময়ই আবিষ্কৃত হলো অডিও ক্যাসেট। সেটা ফিতাসমৃদ্ধ এবং ১০ থেকে ১২টি গান ধারণ করতে পারত। বাংলাদেশে অবশ্য ষাট দশকে এসে অডিও ক্যাসেটের প্রচলন হয়। যারা বিত্তবান তাদের ঘরেই শোভা পেত গ্রামোফোন। মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তের বিনোদন বলতে শুধু রেডিও। সত্তর-আশির দশকে বিশেষ করে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর অডিও শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পশ্চিমা ধাঁচের পপ গানের আদলে বাংলা গানে নতুন এ ধারার সংযোগ ঘটান ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর, জানে আলম, পিলু মমতাজ, ফেরদৌস ওয়াহিদ প্রমুখ। তরুণ প্রজন্মের কাছে নতুন এ ধারা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। দেদার বিক্রি হতে থাকল অডিও ক্যাসেট। এছাড়া একটা অডিও ক্যাসেটের অনেকগুলো গান একসঙ্গে শোনার মজাও আলাদা, সে সুবাদে তরতর করে প্রসার ঘটতে লাগল অডিও শিল্পের। শ্রোতাদেরও বিভাজন তৈরি হয়। কেউ শুনছেন রবীন্দ্র-নজরুল, কেউ আধুনিক কেউ বা পপ। পপ গানের এই রেশ ধরেই বাংলাদেশে সূচনা ঘটে ব্যান্ড সঙ্গীতের। সময়টা নব্বই দশক। ব্যান্ড সঙ্গীতের সুবাদে শ্রোতাদের সামনে নতুন করে হাজির হয় হেভি ইন্সট্রুমেন্ট এবং এর সাউন্ড ইফেক্ট। প্রবর্তিত হয় বাংলা গানের আরেক ধারা। 

তপন চৌধুরী, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, মাকসুদ বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের লিজেন্ড। এই গানগুলোও অডিও ফিতায় পাওয়া যেত। বিংশ শতকের একেবারে দোরগোড়ায় এসে বাংলাদেশ কমপ্যাক্ট ডিস্কে (সিডি) গান বাজারে ছাড়া হয়। অন্যান্য রেকর্ডারের চেয়ে সিডির লংজিবিটি (দীর্ঘায়ু) বেশি হওয়ায় ক্রেতারাও দারুণভাবে লুফে নিল। এছাড়া একটি-দুটি নয়, অসংখ্য গান রাখা সম্ভব একটা সিডিতে। তবে আকাশ সংস্কৃতির জামানায় মানুষ যেমন বসে নেই তেমনই বসে নেই প্রযুক্তিও। প্রচলন হয়েছে মেমোরি কার্ড নামক এক ধরনের ছোট চিপ। যার ধারণক্ষমতা অডিও ফিতা বা সিডির চেয়েও বহুগুণ বেশি। কম্পিউটার কিংবা মোবাইল ফোন উভয়েই ব্যবহৃত হচ্ছে মেমোরি কার্ড। যে কারণে পাল্টেছে গান শোনার ধরন। এখন আর আয়োজন করে গান শোনার প্রয়োজন পড়ে না। মুক্ত আকাশ সংস্কৃতিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বর যে কোনো গান ডাইনলোড করে মেমোরি কার্ডে ভরে রাখা সম্ভব। ইচ্ছে হলেই কানে হেডফোন লাগিয়ে মোবাইল ফোনের মেমোরি কার্ডে অপশন চালু করলেই হাঁটতে, চলতে, বসতে শোনা যাবে গান।

আরও পড়ুন >>> সংস্কৃতি খাতে বাজেট এত কম কেন? 

মেমোরি কার্ডের দৌরাত্ম্যে অডিও শিল্প আজ ধ্বংসের মুখে। পুরনো ইকুইপমেন্ট বাতিলের খাতায় নাম লিখিয়েছে অনেক আগেই। সম্প্রতি সনি কোম্পানি তাদের টেপ রেকর্ডার উৎপাদন আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে অডিও অ্যালবাম রিলিজ হওয়ার সংখ্যা এবং ক্রেতার সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। যে কেউ ইউটিউবে গিয়ে যে কোনো গান খুব সহজেই শুনতে পারেন। কিছুদিন আগে দুই বাংলার জনপ্রিয় গায়ক কবির সুমন (সুমন চট্টোপাধ্যায়) একটি অ্যালবামের জন্য গান প্রস্তুত করে রেখেছিলেন কিন্তু কোনো অডিও কোম্পানি আগ্রহ দেখায়নি। পরবর্তীতে তিনি ইউটিউবে গানগুলো ছেড়ে দেন। তার মন্তব্য ‘আমি পয়সা পাইনি ঠিকই কিন্তু শ্রোতাদের ভালোবাসা পেয়েছি। কারণ, গানগুলো তাদের নিকট পৌঁছাতে না পারলে এমন রেসপন্স পেতাম না। তাছাড়া মেসেজ টাও পৌঁছানো হতো না। তবে আর যাই হোক অডিও শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনে ক্রেতাদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। ভালো গানে উৎসাহ এবং অ্যালবাম কেনার প্রতি আগ্রহ দেখানো উচিত। 

গান রেকর্ডিংয়ের সেকাল 

একটা সময় ছিল যখন সরাসরি গান রেকর্ড করা হতো। অর্থাৎ যে গানটি গাওয়া হবে তার সুর সব মিউজিসিয়ানকে বুঝিয়ে দিতেন সঙ্গীত পরিচালক। মিউজিক ওঠানো হয়ে গেলে শিল্পীকে ডাকা হতো, এরপর মিউজিক এবং শিল্পীর ভোকাল একসঙ্গে টেক করা হতো। যদি সামান্য ভুল হতো তাহলে পুনরায় গানটি গাওয়া হতো।

প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় জীবন অনেক ছোট ও সহজ হয়ে এলেও শেকড়ের টান অনুভব করা না গেলে বাংলা গানের রস আস্বাদন করা সম্ভব নয়। প্রযুক্তি মানুষের জীবনে গতি সঞ্চার করবে, সেই সঙ্গে হাজার বছরের বাংলা গানের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। এ কাজটা আমাদেরই করতে হবে 

 গান রেকর্ডিংয়ের একাল 

বর্তমান সময়ে গান রেকর্ডিং অনেক সহজ হয়ে গেছে। কিছুদিন আগেও মিউজিসিয়ানদের একসঙ্গে গানের মিউজিক ট্র্যাকে নামানো হতো, এরপর শিল্পীর সময় সুযোগ বুঝে রেকর্ডিং স্টুডিওতে গিয়ে মিউজিক ট্র্যাকে ভোকাল দিয়ে আসত শিল্পী। এখন আপনিও চাইলে ঘরে তৈরি করতে পারবেন আপনার পছন্দের মিউজিক। এজন্য অবশ্য মিউজিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে হবে। মিউজিক ট্র্যাকে নামাতে এখন আর মিউজিসিয়ানদের প্রয়োজন পড়ে না। সফটওয়্যার সে ঝামেলা থেকে রেহাই দেবে। বেশকিছু সফটওয়্যার এখন বাজারে পাওয়া যায় তার মধ্যে সিয়ান্ডো ও প্রটুলস এইচবি অন্যতম। প্রটুলস ব্যবহার করতে অবশ্য ম্যাক পিসির প্রয়োজন পড়বে। এ ধরনের সফটওয়্যার আপনার কম্পিউটারে সংযোজন করে কম্পিউটারের কি-বোর্ড দিয়েই তুলে নিতে পারবেন আপনার পছন্দসই মিউজিক। মিউজিক তোলার পর যদি বাসায় সাউন্ড প্রুফ রুম না থাকে তাহলে কোনো রেকর্ডিং স্টুডিওতে গেলে অনায়াসেই ট্র্যাকটি বাজিয়ে ভোকাল দিলে গান রেকর্ড হয়ে যাবে। লাইসেন্স ফিসহ এ ধরনের সফটওয়্যার পাওয়া যাবে ১০,০০০ টাকা থেকে ৫০,০০০ টাকার মধ্যে।

আরও পড়ুন >>> মহররম থেকে দুর্গোৎসব : সম্মিলন ও শক্তি 

প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় জীবন অনেক ছোট ও সহজ হয়ে এলেও শেকড়ের টান অনুভব করা না গেলে বাংলা গানের রস আস্বাদন করা সম্ভব নয়। প্রযুক্তি মানুষের জীবনে গতি সঞ্চার করবে, সেই সঙ্গে হাজার বছরের বাংলা গানের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হবে। এ কাজটা আমাদেরই করতে হবে। 

প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করে তুলেছে। তবে এর ভোগান্তিও বেশ। তবে একটু সতর্ক থাকলে এসব ভোগান্তি এড়ানো সম্ভব। আজ বেশির ভাগ গায়ক-গায়িকার রয়েছে নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল। নিজ নিজ চ্যানেলে গান রিলিজ দিয়ে তাতে আবার বুস্টিংও করছেন। যাতে অনেক মানুষ গানটি দেখতে পারেন। এছাড়া গানের লাইক ও কমেন্টও একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক কথায় বলা যায় গান যেন এখন প্রযু্ক্তি নির্ভর। প্রযুক্তির ধারাবাহিকতার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে গানের ধরন। প্রযুক্তির কল্যাণে বিশ্বের নামিদামি গায়ক-গায়িকার গান মুহূর্তেই আমাদের চোখের সামনে এসে ধরা দেয়। সময়ের চাহিদায় প্রযুক্তির উৎকর্ষতা আসবেই। তবে এর সঠিক ব্যবহার আমাদের বেছে নিতে হবে।

এমএআর/