ছবি : সংগৃহীত

একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, এক দশকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। গ্রামীণ দারিদ্র্য কমেছে। জীবনযাত্রার মানেরও উন্নতি হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

তবে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্যেও একটি গুরুতর সমস্যা প্রকাশ পেয়েছে—আয় ও সম্পদ বৈষম্য। বৈষম্যের এই বাস্তবতা শুধু শহর ও গ্রাম কিংবা ঢাকার সাথে ঢাকার বাইরের এলাকাই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আজ নারী শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষ, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরও প্রবলভাবে দৃশ্যমান। এছাড়া, আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার।

বাংলাদেশে আয় বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জিনি সহগ (Gini coefficient) নামে পরিচিত বৈষম্য সূচক ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। ২০০৯ সালে এই সূচক ছিল ৩২.৪, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ৪৩.০। অর্থাৎ, সমাজের সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয়ের ব্যবধান বাড়ছে।

শহর ও গ্রামবাসীর মধ্যে আয় বৈষম্য বিশেষভাবে দৃশ্যমান। গ্রামীণ অঞ্চলে কর্মসংস্থানের ঘাটতি এবং কৃষি উৎপাদনে স্থবিরতা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গ্রামের মানুষ শহরে আসছে, কিন্তু শহরেও তারা আশানুরূপ কর্মসংস্থান পাচ্ছে না। কৃষি খাতের শ্রমিকরা এ বৈষম্যের শিকার সবচেয়ে বেশি। কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর বিষয়ে পরিকল্পনার অভাবে তারা আয় বৈষম্যে পড়ছে।

নারীদের জন্য পরিস্থিতি আরও খারাপ। অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা নারী শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য এখনো চরম পর্যায়ে রয়ে গেছে। শ্রমবাজারে তাদের মজুরি প্রায় ২০-৩০ শতাংশ কম। অনেক নারী শ্রমিক কঠোর পরিশ্রম করেও তাদের ন্যায্য মজুরি পান না, যা বৈষম্যকে আরও তীব্র করে তুলেছে।

বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে শ্রমজীবী মানুষেরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের অনেকেই এখনো সেই ক্ষতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিডের পর প্রায় ৪০ শতাংশ শ্রমিক তাদের আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারেনি।

দুর্ভাগ্যক্রমে, এই সময়ে আরও বড় আকারে বৈষম্য বেড়ে গেছে। তৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ ছিল ধীর ও অপর্যাপ্ত। ফলে, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় এই মানুষগুলো বৈষম্যের চক্রে বন্দি থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠীও বৈষম্যের বড় শিকার। জনসংখ্যা দ্রুত বয়স্ক হয়ে পড়ছে, কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্র বয়স্কদের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারছে না। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বয়স্ক, যারা অবসরকালীন সুরক্ষা বা পেনশনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সমাজে এই প্রবীণ জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।

বাংলাদেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠীও বৈষম্যের বড় শিকার। জনসংখ্যা দ্রুত বয়স্ক হয়ে পড়ছে, কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্র বয়স্কদের জন্য প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারছে না।

প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও বৈষম্য প্রকট। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ কম হওয়ায় তারা সমাজে আরও পিছিয়ে পড়ছে। পর্যাপ্ত সুযোগের অভাবে এবং নীতি সহায়তার ঘাটতির কারণে তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

সরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যয় হয়েছে। কিন্তু কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই বিনিয়োগের প্রতিফলন দেখা যায়নি। উদাহরণস্বরূপ, মেগা প্রকল্পগুলোয় বিপুল অর্থ ব্যয় করা হলেও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে খুব কম।

বাংলাদেশে ক্রনি ক্যাপিটালিজমের (Crony Capitalism) বিকাশ কয়েক বছরে বৈষম্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দলীয় নেতা এবং তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের মধ্যেই সম্পদের পুঞ্জীভবন হয়েছে। এই অর্থনীতির মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্য খুব কমই সুযোগ তৈরি হয়েছে, যার ফলে শ্রমিকশ্রেণি এবং নিম্নবিত্ত মানুষ সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার হয়েছে। উপরন্তু, সম্পদ পাচার করে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া এবং দুর্নীতি বৈষম্যকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।

আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং পাহাড়ি অঞ্চলে বৈষম্য আরও প্রকট। পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে সেখানে বিনিয়োগ ও উন্নয়ন কার্যক্রম পিছিয়ে পড়েছে। এতে করে পাহাড়ের আদিবাসী জনগণ আরও বেশি বৈষম্যের শিকার হয়েছে, যা তাদের জীবনমানের উন্নয়নে বড় বাঁধা সৃষ্টি করেছে।

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনীতিতে যে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে, তা জনগণের মধ্যে নতুনভাবে সংস্কার নিয়ে আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। জুলাই আন্দোলনের মূল দাবি ছিল বৈষম্য নিরসন। দেশের মানুষ এখন ন্যায়সঙ্গত সমাজ, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, শোষণমুক্ত অর্থনীতি এবং একটি টেকসই উন্নয়নের জন্য সংস্কার চায়।

এক দশকে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, দুর্নীতি এবং অর্থনীতিতে অসামঞ্জস্য দেশকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছে যেখানে দ্রুত ও কার্যকর সংস্কার ছাড়া অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হবে। তবে, এই সংস্কার আলোচনা যতটা রাজনীতি এবং শাসনব্যবস্থা নিয়ে হচ্ছে, ততটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে হচ্ছে না।

অথচ, দেশের মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটিয়ে ওঠার জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যথাযথ সংস্কার আনা অত্যাবশ্যক। বস্তুত, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কার ছাড়া সমাজ ও রাজনীতিতে প্রত্যাশিত সংস্কার বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত নেই বলেই চলে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনে কিছু সংস্কার অবশ্যই করতে হবে যা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—

১. মজুরি বৈষম্য কমানো: নারী শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। সরকারকে একটি ন্যূনতম মজুরি কাঠামো তৈরি করতে হবে যা আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য জীবিকা নির্বাহের উপযুক্ত হবে এবং নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরির বৈষম্য দূর করবে।

২. শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ন্যায্য মজুরি: বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি অত্যন্ত কম। ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা ও শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার আনা দরকার। শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যক্রমকে বাধা না দিয়ে শ্রমিকদের দাবি বিবেচনার জন্য একটি সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন।

৩. কর ব্যবস্থার সংস্কার: বর্তমানে দেশে কর ব্যবস্থা ধনীদের পক্ষে ঝুঁকে আছে। বৈষম্য কমাতে বর্তমান কর ব্যবস্থার সংস্কার দরকার। বিশেষ করে আয় করের পরিধি বৃদ্ধি করা দরকার, কর প্রশাসনে দুর্নীতি নির্মূল করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে শ্রমিকদের মজুরি অত্যন্ত কম। ন্যায্য মজুরির নিশ্চয়তা ও শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার আনা দরকার। শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যক্রমকে বাধা না দিয়ে শ্রমিকদের দাবি বিবেচনার জন্য একটি সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন।

৪. অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে কর্মসংস্থান: সরকারি অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্পগুলোয় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা দরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ যেমন হয়েছে, তেমনি অন্যান্য সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং শ্রমঘন শিল্প স্থাপনের দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

৫. আদিবাসীদের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা: সমতলের আদিবাসী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের জন্য সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে। সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রকল্প নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৬. বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা: বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর করা প্রয়োজন। পেনশন ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া উচিত যাতে প্রবীণ জনগণ অর্থনৈতিকভাবে নিরাপদ থাকেন।

৭. প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি: প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ বাড়ানো দরকার। প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি এবং নীতি সহায়তা প্রদান করে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে।

৮. দুর্নীতি দমন: দুর্নীতির বিস্তার বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা; অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রসারেও ভূমিকা রাখে। সম্পদ পাচার ও দুর্নীতি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য একটি কার্যকর দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রয়োজন।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও, বৈষম্য বৃদ্ধি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। শ্রমিক আন্দোলন থেকে শুরু করে আদিবাসীদের দাবি, প্রত্যেকেই একটি শোষণমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চায়।

বৈষম্য নিরসনে জরুরি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। জনগণের এই নতুন চাহিদা পূরণে সঠিক অর্থনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে, বাংলাদেশ একটি ন্যায্য, টেকসই ও শোষণমুক্ত অর্থনীতির পথে এগিয়ে যেতে পারবে।

ড. কাজী মারুফুল ইসলাম ।। অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়