বিটিভি কি দলীয় প্রচারযন্ত্রই থাকবে?
বাংলাদেশ টেলিভিশন অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। পরিচালিত হয় জনগণের করের টাকায় কিন্তু ব্যবহৃত হয় দলীয় কাজে। জন্মলগ্ন থেকে বিটিভি সরকারি দলের নগ্ন প্রচার বা অপপ্রচার মাধ্যম। সংবাদ, অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সব ধরনের আধেয়তে সরকার দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই তা চলছে। প্রকৃতপক্ষে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ১৯৬৪ সালে যখন বিটিভি (তখন পিটিভি) যাত্রা শুরু করে তখনো প্রতিষ্ঠানটি জেনারেল আইয়ুব খানের প্রধান প্রচারযন্ত্র ছিল। যে পরম্পরা আজও চলমান।
বিজ্ঞাপন
জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের সময় প্রতিষ্ঠানটি ন্যাক্কারজনক অপপ্রচার চালিয়েছে। অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা আগেও ছিল। যে কারণে জনপরিসরে বিটিভি পরিচিত ছিল ‘বাতাবি লেবুর বাম্পার ফলন’ নামক নেতিবাচক অভিধায়। প্রশ্ন হলো, বিটিভি কি আগামীতে বাতাবি লেবুই থাকবে। নাকি কেউ উদ্যোগী হবেন রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটি সংস্কারে?
নানা ধরনের শঙ্কা ও সংকটের মধ্যেও শেখ হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশে নানা খাতে টেকসই সংস্কারের সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে। সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, পুলিশ ও প্রশাসনের সংস্কারে কয়েকটি কমিশন এরইমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম মূলত বিটিভি-বেতার নিয়ে কোনো আলাপ নেই।
সংবিধান, নির্বাচন, বিচার বিভাগ, পুলিশ ও প্রশাসনের সংস্কারে কয়েকটি কমিশন এরইমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম মূলত বিটিভি-বেতার নিয়ে কোনো আলাপ নেই।
যদিও বিষয়টি ফেলনা নয়। যে কারণেই ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রীয় রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ওই নির্বাচনে জয় লাভ করা আওয়ামী লীগ। কিন্তু যে উদ্যোগী দ্রুতই মাঠে মারা গিয়েছিল।
জাতীয় গণমাধ্যম হিসেবে বেতার ও বিটিভি স্বৈরাচার এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার শাসন আমলে একেবারেই ‘বংশবদ প্রচারযন্ত্র’তে পরিণত হয়েছিল। জাতীয় এই মাধ্যমকে অত্যন্ত যুক্তিহীন ও নগ্নভাবে দলীয় কাজে ব্যবহার করা হতো। অনেক ক্ষেত্রে জনগণের করের টাকায় চলা এই প্রতিষ্ঠান দুটি রূপ লাভ করে ঘৃণ্য দলীয় প্রচারণা যন্ত্রে।
প্রতিষ্ঠান দুটি পরিচিত হতে থাকে ‘সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স’ হিসেবে। যাই হোক এমন বাস্তবতায় ১৯৯৬ সালে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকারের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিশন সে সময় সর্বমহলে আশার সঞ্চার করেছিল। বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে গঠিত এই কমিশনের প্রধান ছিলেন সাবেক সচিব আসাফ্উদ্দৌলাহ্। অন্য সদস্যরাও ছিলেন যোগ্য, প্রজ্ঞাবান।
আরও পড়ুন
অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল বেতার ও বিটিভির বিষয়ে ইতিবাচক নীতিমালা হবে, যার ভিত্তিতে নিশ্চিত হবে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। একইসাথে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাও এমন একটা নীতিমালার বিষয়ে সহযোগী ছিল। সরকারের বৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী ইউ.এন.ডি.পি. এই প্রকল্পে ৮০ লাখ টাকা প্রদান করে। ১৯৯৬ সালের বাস্তবতায় এটি ছিল বড় অঙ্কের টাকা।
সংস্থাটির শর্ত ছিল এই টাকা ব্যয় করা যাবে শুধুই কমিশনের কাজে। এই কমিশনের একজন সদস্য ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ইউ.এন.ডি.পি.-এর সহায়তা সম্পর্কে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান উল্লেখ করেছেন ‘তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। কমিশন যে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী হয়ে রইলো না, এতে বোধ করি তিনি খুশি হননি।’ (বিপুলা পৃথিবী, পৃষ্ঠা: ৪৮৫)
সে সময় আর্থিক স্বায়ত্তশাসন ছাড়াও নানা বিষয়ে শুরুতেই তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে কমিশনের বিরোধ লেগে যায়। কমিশনের যাত্রা শুরুর আনুষ্ঠানিকতা ও বৈঠকের স্থান নিয়ে শুরু হয় মনোমালিন্য। তথ্য মন্ত্রণালয় চেয়েছিল বৈঠক হোক সরকারি কোনো দপ্তরে। কিন্তু নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে কমিশন প্রধান বৈঠকের আয়োজন করেন হোটেল পূর্বানীতে। তথ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন কাজটি হোক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কিন্তু কমিশন নিভৃতে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহী ছিল।
যাই হোক, মন্ত্রণালয়ের সাথে ছোট খাটো বিষয়ে বিরোধ চললেও সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কাজে বেশ উৎসাহী ছিলেন। বিভিন্ন বৈঠকে তিনি এই কাজে প্রবল উৎসাহ দিয়েছেন। একটি বৈঠকের কথা উল্লেখ করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি উল্লেখ করেছেন ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরে কমিশনের আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হয় অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে। তার সঙ্গে কথা বলে আমাদের মনে হয়েছিল যে, স্বায়ত্তশাসন তার দলীয় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অন্তর্গত। সে প্রতিশ্রুতি পালনের সে আমাদের সহায়তা চায়। তবে কমিশন বৈঠকে স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে ইতিমধ্যে আমরা যে ধারণা করেছি, তার সঙ্গে তার (প্রধানমন্ত্রীর) ধারণার পার্থক্য আছে, এ কথাও আমাদের মনে হয়েছিল। তবে সে ব্যবধান দুরতিক্রম্য বলে মনে হয়নি।’ (বিপুলা পৃথিবী, পৃষ্ঠা: ৪৮৫)
জাতীয় গণমাধ্যম হিসেবে বেতার ও বিটিভি স্বৈরাচার এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার শাসন আমলে একেবারেই ‘বংশবদ প্রচারযন্ত্র’তে পরিণত হয়েছিল। জাতীয় এই মাধ্যমকে অত্যন্ত যুক্তিহীন ও নগ্নভাবে দলীয় কাজে ব্যবহার করা হতো।
পরবর্তী সময়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য এই কমিশন যুক্তরাজ্য-ভারত-পাকিস্তান ও ফিলিপাইন সফর করে। অধ্যাপক আনিসুজ্জাজান গিয়েছিলেন ফিলিপাইন। সেখান থেকে ফিরে সবার অভিজ্ঞতার আলোকে প্রতিবেদন লেখার কাজ শুরু হয়। আনিসুজ্জামানের বাড়িতেই এই কাজ চলে।
পরে নানা সংশোধন, কাটাকাটির পর পুরো প্রতিবেদন তৈরির পর ১৯৯৭ সালে তা তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেওয়া হয়। তবে এই অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না। শুরুর উষ্ণতা ছিল না, ছিল শীতলতা।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান উল্লেখ করেছেন ‘প্রধানমন্ত্রীর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট তুলে দেওয়া পর আমাদের সবাইকে রিপোর্টের কপি দেওয়া হলো। রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল আঞ্জু মনোয়ারের (কমিশনের সদস্য সচিব, তথ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব) নেতৃত্বে। কাজেই তিনিই সবাইকে রিপোর্টের কপি দিচ্ছিলেন। প্রতিমন্ত্রী তাকে ধমক দিয়ে বললেন ‘সবাইকে কপি দিচ্ছেন কেন? কত কপি ছাপা হয়েছে? ভদ্র মহিলা খুবই অপ্রস্তুত হলেন। তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন ১০০ কপি স্যার। প্রতিমন্ত্রী জানতে চাইলেন ১০০ কপি কেন? আমিতো ৫০ কপি ছাপতে বলেছিলাম। কমিশন চেয়ারম্যানকে ইঙ্গিত করে মঞ্জু মনোয়ারা বললেন, স্যার ১০০ কপি ছাপতে বলেছিলেন।’ (বিপুলা পৃথিবী, পৃষ্ঠা: ৪৮৫) সেদিন বৈঠক শেষে কমিশন সদস্যরা প্রতিবেদনের কপি না নিয়েই বাড়ি ফেরেন। সচিব আঞ্জু মনোয়ারাকে বদলি করা হয় টাঙ্গাইলে।
আরও পড়ুন
অত্যন্ত ইতিবাচক, খুব প্রয়োজনীয় এই কাজটি নিয়ে ওই কমিশনের সদস্যরা আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান উল্লেখ করেছেন, ‘করদাতার টাকা যেখানে খরচ হবে, করদাতাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সেখানে নাক গলাবেন না—এমন একটা পরিস্থিতি অনেকের পছন্দ হয়নি। তাঁরা বেতার-টেলিভিশনকে স্বায়ত্তশাসন দিতে চেয়েছিল মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্ব বজায় রেখে।’
ওখানেই শেষ। এরপর বিটিভি ও বেতারের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আর কোনো আলোচনা হয়নি। কেউ নেয়নি কোনো উদ্যোগ। ২০২৪ সালে এসে অধ্যাপক আসাফ্উদ্দৌলাহ্ সেই প্রতিবেদনটির কথা মনে পড়ছে। ওই প্রতিবেদন আজ কোথায় আছে তা মনে হয় কারওই জানা নেই। হয়তো প্রতিবেদনগুলো অনেক আগেই উইপোকার উপাদেয় খাদ্য হয়েছে। তবে যারা কল্যাণমুখী, জবাবদিহিতামূলক রাষ্ট্রে শক্তিশালী ‘ম্যাস মিডিয়া’ দেখতে চান তারা হয়তো আজও ওই প্রতিবেদন নিয়ে স্বপ্ন দেখেন।
আর অন্য একটি পক্ষ হয়তো আজও সক্রিয় ওই প্রতিবেদনকে অন্ধকারে রাখতে। কারণ তারা হয়তো আজও মনেপ্রাণে চান বেতার ও টেলিভিশন হবে ‘ক্লাস মিডিয়া’, ‘ম্যাস মিডিয়া’ নয়। আবারও বলাই বাহুল্য তারাই শক্তিশালী। নতুন শুরুর বাংলাদেশে বিটিভি ও বেতারের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনের কথা কেউ কি একটু তুলবেন? অপেক্ষায় রইলাম।
রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়