ছবি : সংগৃহীত

দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা অতি পরিচিত একটি রোগ ডেঙ্গু। ডেঙ্গু Flaviviridae পরিবারের একটি ভাইরাস এবং এর চারটি স্বতন্ত্র, কিন্তু ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত সেরোটাইপ রয়েছে (DENV-1, DENV-2, DENV-3 এবং DENV-4) যা ডেঙ্গু সৃষ্টি করে। একটি সেরোটাইপ দিয়ে একবার ডেঙ্গু হলে একই সেরোটাইপ দিয়ে আর ডেঙ্গু হয় না।

তবে অন্য সেরোটাইপ দিয়ে একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে যা মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রধানত এডিস ইজিপ্টাই প্রজাতির স্ত্রী মশা দ্বারা সংক্রামিত হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে অল্প মাত্রায় এডিস অ্যালবোপিকটাস এর মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। এই প্রজাতির মশা চিকুনগুনিয়া, ইয়েলো ফিভার এবং জিকা ভাইরাসেরও বাহক।

২৫ বছরে ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ প্রায় ৩০ গুণ বেড়েছে। সংক্রমণ প্রধানত উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ুযুক্ত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে প্রকট। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘন ঘন ভ্রমণ ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গু জ্বর সংক্রমণকে ত্বরান্বিত করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গুর ভৌগোলিক বিস্তার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতা মশার প্রজনন ও রোগ বিস্তারের জন্য আরও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে এবং করবে।

ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ বিভিন্ন কারণে জলবায়ু সংবেদনশীল। প্রথমত, তাপমাত্রার পরিবর্তন ভেক্টরের প্রজনন হার, কামড়ের হার, ভাইরাসের ইনকিউবেশনের সময় পরিবর্তন, ভেক্টরের ভৌগোলিক পরিসর বা বিস্তার পরিবর্তন করে এবং ভেক্টর-ভাইরাস-হোস্ট সম্পর্ক বৃদ্ধি বা হ্রাস করে ভেক্টরবাহিত রোগ সংক্রমণ এবং মহামারি সম্ভাব্যতাকে প্রভাবিত করে।

দ্বিতীয়ত, বৃষ্টিপাত প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী মশার ঘনত্বকে প্রভাবিত করে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রজনন স্থানের বৃদ্ধি ঘটায় যার ফলে মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী মশার সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এটি সহজেই ভাইরাস প্রাপ্ত হওয়া এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে।

তৃতীয়ত, ডেঙ্গু হেমোরেজিক প্রাদুর্ভাবের একটি স্বতন্ত্র মৌসুমি প্যাটার্ন পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গায় স্পষ্ট। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলের দেশগুলো যেখানে দীর্ঘসময় বর্ষাকাল থাকে সেখানে বর্ষাকালে ডেঙ্গু রোগ বৃদ্ধি পায় এবং বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার কয়েক মাস পরে কমে আসে। বৃষ্টি বা বর্ষার সঙ্গে ডেঙ্গুর বাহক মশার প্রজনন হার বা দীর্ঘায়ু হ্রাস অথবা তার কামড়ানোর ক্ষমতার পরিবর্তিত হতে পারে। তবে বাংলাদেশে ডেঙ্গু যে শুধুমাত্র বৃষ্টিপাতের ওপরই নির্ভর করে তা নয়।

বৃষ্টিপাত প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী মশার ঘনত্বকে প্রভাবিত করে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রজনন স্থানের বৃদ্ধি ঘটায় যার ফলে মশার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশের নগরে বিভিন্ন স্থানে পানি সংকট থাকার কারণে জনগণ তার বাথরুমে অথবা টয়লেটে পানি জমিয়ে রাখে। এছাড়া শীতকালে বাংলাদেশে নির্মাণ কাজ বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণাধীন ভবনে পানির ব্যবহার ডেঙ্গুর বাহক মশার প্রজননকে বাড়িয়ে তোলে। যেহেতু মশার ডিম, লার্ভা এবং পিউপা বেড়ে ওঠার জন্য পানি প্রয়োজন তাই পানি, বৃষ্টি বা বর্ষা মশার প্রজননের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বর্ষাকালে বাংলাদেশ ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হলেও শীতকালেও এখন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। মশার জীবনচক্র তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার উপরে অনেকটা নির্ভরশীল। বর্ষাকালে যেহেতু তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা উপযোগী থাকে তাই এই সময়ে মশার প্রজনন এবং বেঁচে থাকা খুব সহজ হয়।

কত সময় ধরে এবং কী পরিমাণ বৃষ্টি হলো সেটি ডেঙ্গুরবাহক এডিস মশার প্রজননের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৃষ্টিপাতের ধরনও একটি ভূমিকা রয়েছে। অতি ভারী বৃষ্টিপাত মশার লার্ভাকে প্রজনন স্থান থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে বা মেরে ফেলতে পারে। আবার হালকা বৃষ্টি বিদ্যমান প্রজনন স্থানগুলো পুনরায় পূরণ করতে পারে এবং উচ্চ স্তরের আর্দ্রতা বজায় রাখতে পারে যা প্রাপ্তবয়স্ক মশাদের বিস্তৃত হয়ে প্রজনন হার বাড়াতে এবং বেঁচে থাকতে সহায়তা করে।

জলবায়ুর পরিবর্তন ভেক্টর এবং মধ্যবর্তী হোস্টের বৃদ্ধি এবং বিস্তারকে প্রভাবিত করতে পারে। যদিও জলবায়ুর কারণগুলো ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) এর সংক্রমণ চক্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তবে এটি পৃথিবীর বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে ভিন্ন হতে পারে। 

মশা, মশার আচরণগত পরিবর্তন, পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়া, ভাইরাস বা প্যাথোজেনের বিবর্তনে বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে গবেষণা হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। গত দুবছর থেকে দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অতি উচ্চ। ডেঙ্গুতে এত মানুষের মৃত্যুর কারণ জানার জন্য গবেষণার বিকল্প নেই। বাংলাদেশে যারা এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করেন তাদের সঙ্গে সরকারের সমন্বয় সাধন প্রয়োজন। রাষ্ট্রের উচিত গবেষকদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গবেষণায় উৎসাহিত করা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব গবেষণাগার তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, এডিস মশার ঘনত্ব এবং ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নিয়ে যে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করে তাতে দেখা যাচ্ছে যে অক্টোবরে ডেঙ্গু আরও জটিল আকার ধারণ করবে। আমরা মাঠ পর্যায়ে ডেঙ্গুর বাহক মশা নিয়ে যে গবেষণা কাজগুলো করে তাতে দেখা যাচ্ছে যে ঢাকা শহরসহ বেশ কয়েকটি শহরে এডিস মশার ঘনত্ব স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।

এডিস মশার ঘনত্বের ইনডেক্স যেটিকে ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ বলা হয় সেটি যখন কোনো একটি এলাকায় ২০ বা তার অধিক হয় তখন ধরে না হয় সে অঞ্চলে এডিস মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি বেড়ে যেতে পারে। এই মুহূর্তে ঢাকার প্রতিটি মহল্লায় ব্রুটো ইনডেক্স বিষয়ের ওপরে রয়েছে। তাই পুরো শহরই ডেঙ্গু ঝুঁকিতে।

তবে কোনো কোনো স্থানে সেই ইনডেক্স ৭০ এর বেশি আছে। এছাড়া কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর, খুলনা,  নরসিংদী, চাঁদপুর এবং ময়মনসিংহে এডিস মশার ঘনত্ব বেশি রয়েছে। কোনো একটি স্থানে এডিস মশার ঘনত্ব যদি বেশি থাকে এবং সেই অঞ্চলে যদি রোগী থাকে তাহলে সেখানে জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু রোগটি বাড়তে থাকে। 

যদি কোথাও অনেক এডিস মশা থাকে কিন্তু কোনো রোগী না থাকে তাহলে সেখানে রোগটি ছড়াবে না আবার কোনো একটি জায়গাতে যদি অনেক রোগী থাকে কিন্তু এডিস মশা না থাকে তাহলেও রোগটি ছড়াবে না। ডেঙ্গু রোগী এবং এডিস মশার সঙ্গে সম্পর্কটি ভেঙে দিতে পারলে ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার কয়েকটি উপায় রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো ডেঙ্গু রোগীকে সবসময় মশারির ভেতরে রাখা। প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এডিস মশাকে নিয়ন্ত্রণ করা।

এই মুহূর্তে যেহেতু প্রায় প্রতিটি এলাকাতে এডিস মশার ঘনত্ব বেড়ে গেছে তাই এখন হটস্পট ধরে ধরে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে জোরদার করা প্রয়োজন। হটস্পট মশার ঘনত্বের উপরে অথবা ডেঙ্গু রোগীর ওপরে ভিত্তি করে করা হয়ে থাকে। এখন ডেঙ্গু রোগীকে কেন্দ্র করে হটস্পট নির্ধারণ করা প্রয়োজন। যেসব এলাকায় বা বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী আছে সেই বাড়িকে কেন্দ্র করে চতুর্দিকে ২০০ মিটার পর্যন্ত ফগিং করে ক্রাশ করে এডিস মশা মেরে ফেলতে হবে।

যেখানে ডেঙ্গুর রোগী আছে সেখানকার এডিস মশাগুলো ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করতে পারে তাই তারা বেঁচে থাকলে জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়বে। ডেঙ্গুর বাহক মশা যেহেতু ২০০ মিটারের বেশি দূরে উড়ে যায় না তাই ২০০ মিটারকে কেন্দ্র করে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটা নিশ্চিত করতে পারলে ওই মহল্লায় ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

অতি ভারী বৃষ্টিপাত মশার লার্ভাকে প্রজনন স্থান থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে বা মেরে ফেলতে পারে। আবার হালকা বৃষ্টি বিদ্যমান প্রজনন স্থানগুলো পুনরায় পূরণ করতে পারে...

হটস্পট ম্যানেজমেন্ট এর পাশাপাশি ব্রিডিং সোর্স ম্যানেজমেন্টও করতে হবে। যেসব পাত্রে বৃষ্টির পানি জমা হয়ে এডিস পোশাক প্রজনন হতে পারে সেগুলো ফেলে দেওয়া অথবা ম্যানেজমেন্ট করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজে সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। নগরবাসীকে নিশ্চিত করতে হবে নিজের বাড়ি এবং বাড়ির আঙিনাতে যেন কোনো প্রকার প্রজনন স্থল না থাকে। 

যদি প্রজনন স্থলগুলো এমন হয় যে একে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না তাহলে সেখানে কর্পোরেশনের মাধ্যমে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।  আমরা দীর্ঘ সময় ধরে বলে এসেছি মশা মারার এরোসল এবং কয়েলের মতো করে মশার লার্ভা মারার কীটনাশক মানুষের হাতের নাগালে আসা প্রয়োজন।

একজন নাগরিক ইচ্ছে করলে যেন নিজেই নিজের বাড়ির মশাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেই সুযোগটি নগরবাসীর হাতে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আইনগত জটিলতা থাকার কারণে একজন নাগরিক নিজে মশা নিয়ন্ত্রণের কীটনাশক কিনতে পারছে না। এরোসল এবং কয়েলের মতো লার্ভা মারার কীটনাশক যদি মানুষের হাতের নাগালে থাকতো তাহলে জনগণ তার বাড়ির সামনের ড্রেন, ডোবা, নর্দমা অথবা তার বাড়িতে জমে থাকা পানিতে এগুলো কিনে ব্যবহার করতে পারতো। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে এই প্রোগ্রামটির সফলতা আসবে না। জনগণকে সম্পৃক্ত করার পন্থাগুলো খুঁজে বের করে তার বাস্তবায়ন করতে হবে।

২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গু শুরু হয়ে প্রতি বছরই মানুষ আক্রান্ত হয়েছে আর সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে আমরা শুনেছি তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে। তাদের কথামতো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলেও নগরবাসী এর সুফল পায়নি। দীর্ঘসময়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার পেছনে কারণগুলো খুঁজে বের করা দরকার। কারণ খুঁজে বের করতে পারলেই তার সমাধান করা সম্ভব। 

পৃথিবীর অনেক দেশ সফলভাবে ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী শহর কলকাতাও এক্ষেত্রে সফল। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফলতার জন্য আমি একটি মডেল প্রস্তাব করেছি যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আমার মডেল বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হবে। নীতি নির্ধারকদের অনুরোধ করবো আমার মডেলটি পড়ে বিশ্লেষণ করে দেখবেন। যদি আপনাদের কাছে উপযোগী মনে হয় তাহলে সেটি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশের মানুষকে ডেঙ্গু থেকে রেহাই দেবেন।

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com