ছবি : সংগৃহীত

হিজবুল্লাহ, লেবাননের প্রভাবশালী শিয়া রাজনৈতিক দল এবং সামরিক সংগঠন। তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক আক্রমণে হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন।

হাসান নাসরুল্লাহ (Hassan Nasrallah) হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ১৯৯২ সালে। তার কৌশলী নেতৃত্বের কারণে হিজবুল্লাহ শুধুমাত্র একটি সামরিক প্রতিরোধ সংগঠন নয়, বরং একটি সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত হয়। তার সময়কালে হিজবুল্লাহ আন্তর্জাতিক স্তরে ইরান ও সিরিয়ার মিworldত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সন্ধ্যায়, লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ইসরায়েলের বিমান হামলায় তাকে হত্যা করা হয়। নাসরুল্লাহর পাশাপাশি হিজবুল্লাহর দক্ষিণ ফ্রন্টের কমান্ডার আলী কারকি এবং অন্যান্য শীর্ষ কমান্ডাররাও এ আক্রমণে নিহত হন। এছাড়া এক সপ্তাহ আগে, ইসরায়েলের বৈরুতে হিজবুল্লাহর আরেক শীর্ষ কমান্ডার ইব্রাহিম আকিলকে হত্যা করে।

এই ঘটনার পর থেকে হিজবুল্লাহর মধ্যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইসরায়েল একে তাদের জন্য বিশাল সাফল্য বলে দাবি করেছে, তবে এর ফলে ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে উত্তেজনার মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। ইরানের সমর্থনপুষ্ট হিজবুল্লাহ অনেকদিন ধরেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে এবং নাসরুল্লাহর মৃত্যুর পর দলটি পুনর্গঠিত হবে কি না বা কীভাবে এর ভবিষ্যৎ পরিচালিত হবে সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছে।

নাসরুল্লাহর মৃত্যু : হিজবুল্লাহর জন্য অস্থায়ী আঘাত?

নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে সংগঠনটি ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ এবং লেবাননে ইরানি প্রভাব শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়। নাসরুল্লাহর মৃত্যু হিজবুল্লাহর জন্য তাৎক্ষণিক ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হলেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি দলের কার্যক্রমে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।

হিজবুল্লাহ অনেক পুরোনো সংগঠন, যার নেতৃত্বের পরিবর্তন ইতিপূর্বেও ঘটেছে এবং প্রতিবারই দলটি নতুন নেতৃত্বের মাধ্যমে নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। এর শক্তিশালী সামরিক সক্ষমতা এবং বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার এখনো অক্ষত রয়েছে, যা দলটির প্রতিরোধের মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

নাসরুল্লাহর মৃত্যুর ফলে হিজবুল্লাহর কার্যক্রম স্থগিত হবে না। বরং তারা দ্রুতই নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করবে এবং তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করবে। যদিও বৈরুতকে হিজবুল্লাহর ‘দুর্বল অবস্থান’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ এখানে পশ্চিমা দূতাবাস এবং পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি রয়েছে, তবে ইসরায়েল সামরিকভাবে হিজবুল্লাহকে পরাজিত করতে সক্ষম নয় বলেই মনে করা হচ্ছে।

ইরানের প্রতিক্রিয়া : এক যুদ্ধের ভারসাম্য

নাসরুল্লাহর হত্যার পর ইরান প্রতিশোধমূলক হামলার ইঙ্গিত দিলেও ইরান ইসরায়েলের সাথে সরাসরি যুদ্ধের পরিবর্তে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে চায়। ইরান সম্ভবত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরাক ও ইয়েমেনের মতো তাদের মিত্রদের মাধ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, সরাসরি কোনো বড় সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আগে।

ইরানের সমর্থনপুষ্ট হিজবুল্লাহ অনেকদিন ধরেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে এবং নাসরুল্লাহর মৃত্যুর পর দলটি পুনর্গঠিত হবে কি না বা কীভাবে এর ভবিষ্যৎ পরিচালিত হবে সে বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছে।

ইরানকে নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে ধরনের আলোচনা চলছে তাতে স্পষ্ট যে দেশটি তার পরোক্ষ যুদ্ধগুলো চালিয়ে যাবে, কিন্তু সরাসরি বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা আরও বাড়বে, তবে ইরান এখনই একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের পথে হাঁটবে না। বরং, তারা হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য মিত্রদের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করবে।

ইসরায়েলের সফলতা বনাম বাস্তবতা

ইসরায়েল নাসরুল্লাহকে হত্যার ঘটনাকে বড় সাফল্য হিসেবে উপস্থাপন করছে। তবে বাস্তবতা হলো, হিজবুল্লাহকে এত সহজে দমিয়ে রাখা যাবে না। হিজবুল্লাহ ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে যে তারা যেকোনো শীর্ষ নেতার অনুপস্থিতিতে দ্রুত নতুন নেতৃত্ব গঠন করতে পারে এবং তাদের সামরিক প্রতিরোধ অব্যাহত রাখতে পারে। নাসরুল্লাহর মৃত্যুর পরেও দলটি পুনর্গঠিত হয়ে আবারও সংগঠিত হবে এবং তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে।

হিজবুল্লাহ চার দশকের পুরোনো সংগঠন, যার গভীর সামরিক ও রাজনৈতিক শিকড় রয়েছে। তাই নাসরুল্লাহর মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার মৃত্যুতে দলটির কাঠামো ধসে পড়বে না। অতীতে দেখা গেছে, হিজবুল্লাহ তাদের শীর্ষ নেতাদের হারানোর পরেও নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে এবং তারা আবারও তা করতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাত : ভবিষ্যতের রূপরেখা

নাসরুল্লাহর মৃত্যুর ফলে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাত একটি নতুন মোড় নিতে পারে। ইসরায়েল নিজেদের সামরিক সাফল্য তুলে ধরলেও, বাস্তবে হিজবুল্লাহর পুনর্গঠন এবং প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান প্রভাবের লড়াইয়ে হিজবুল্লাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং নাসরুল্লাহর মতো নেতার মৃত্যুতে এই প্রভাবের লড়াই থেমে যাবে না।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক এবং সামরিক প্রভাব কমিয়ে আনতে ইসরায়েল যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তা আপাতত সফল হতে পারে, তবে এটি দীর্ঘমেয়াদে কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। হিজবুল্লাহর শক্ত সামরিক কাঠামো এবং ইরানের সমর্থন দলটিকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে, যা ইসরায়েলের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হিজবুল্লাহর ভবিষ্যৎ : নেতৃত্বের সংকট নাকি নতুন শক্তি?

নাসরুল্লাহর মৃত্যুর ফলে হিজবুল্লাহর নেতৃত্বে একটি সাময়িক শূন্যতা তৈরি হলেও, এটি দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে মনে করা হয়। দলটি নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করবে এবং তাদের প্রতিরোধ চালিয়ে যাবে। তবে, নতুন নেতার নির্বাচন কীভাবে হবে এবং কাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হবে তা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে।

হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। হিজবুল্লাহর নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও দলের সামরিক ক্ষমতা অক্ষত থাকবে, কারণ তারা একক নেতা দ্বারা পরিচালিত একটি সংগঠন নয়। দলটির গভীর সামরিক শিকড় এবং ইরানের সমর্থন তাদের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। তাই, নাসরুল্লাহর মৃত্যু দলটির জন্য বড় কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করা হচ্ছে।

হিজবুল্লাহ চার দশকের পুরোনো সংগঠন, যার গভীর সামরিক ও রাজনৈতিক শিকড় রয়েছে। তাই নাসরুল্লাহর মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার মৃত্যুতে দলটির কাঠামো ধসে পড়বে না।

নাসরুল্লাহর মৃত্যুর পর, সংগঠনের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে এবং নেতৃত্বের নতুন কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন হবে। তবে, এটি নিশ্চিত যে, হিজবুল্লাহ শুধু একটি সামরিক সংগঠন নয়। এটি একটি আদর্শিক ও সামাজিক আন্দোলন, যা এক ব্যক্তির মৃত্যুর ফলে সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে না।

নাসরুল্লাহর হত্যার পর হিজবুল্লাহ সাময়িকভাবে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে দলটির কার্যক্রম ও প্রতিরোধ শক্তিতে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে মনে করা হচ্ছে। ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে সামরিকভাবে দমন করতে সক্ষম হবে না, কারণ দলটির সামরিক ও রাজনৈতিক কাঠামো গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত। নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের পর হিজবুল্লাহ আবারও নিজেদের সংগঠিত করবে এবং তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে।

ইরানের সঙ্গে হিজবুল্লাহর সম্পর্ক এবং মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায়, ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ সংঘাতের মাত্রা আরও বাড়তে পারে। তবে এই সংঘাতের প্রকৃতি হবে নিয়ন্ত্রিত, কারণ ইরান সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে তাদের মিত্রদের মাধ্যমে লড়াই চালিয়ে যাবে।

ইসরায়েল নাসরুল্লাহর হত্যাকে একটি বিশাল সাফল্য হিসেবে দেখাতে চাইলেও, হিজবুল্লাহর প্রতিরোধের ইতিহাস বিবেচনায়, দলটি খুব শিগগিরই পুনর্গঠিত হবে এবং তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। তাই, হিজবুল্লাহকে দমন করা আপাতত অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

সুতরাং, নাসরুল্লাহর মৃত্যুর পরেও হিজবুল্লাহকে দমন করা সহজ হবে না, বরং এটি একটি নতুন কৌশল অবলম্বন করে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে। তাদের সামরিক শক্তি, আদর্শিক ভিত্তি এবং আঞ্চলিক প্রভাব হিজবুল্লাহকে দমন করার চেষ্টাকে চ্যালেঞ্জ করবে এবং সংগঠনটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে যদি তারা তাদের নেতৃত্ব পরিবর্তন এবং কৌশলগত পরিকল্পনায় সফল হয়।

অধ্যাপক ড. সুজিত কুমার দত্ত ।। সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়