ছবি : সংগৃহীত

ক্রীড়াঙ্গনেও সংস্কার শুরু হয়েছে। হওয়াই উচিত। তবে এই সংস্কারে খেলাধুলা নামের বিষয়টা সরকারের ‘ফোর্থ সাবজেক্ট’ থেকে আবশ্যিক বিষয় হয়ে উঠলে খুব খুশি হতাম। সামগ্রিক বাতাবরণে মনে হচ্ছে, সেটা হওয়ার নয়।

চারদিকে সাধারণ মানুষের হাহাকার ও দাবিনামার এমন হিড়িক ও হুজুগ উঠেছে সেগুলো মেটাতেই সরকারের নাভিশ্বাস উঠছে। নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সামলে দেশে শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজটাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে। এমন সমস্যাসংকুল পরিস্থিতির মধ্যে ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে খুব বিলাসী স্বপ্ন দেখার হয়তো সুযোগ নেই।

সত্যি বললে, সুযোগটা ভালো ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। শেখ হাসিনার গায়েও ছিল ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর ট্যাগ। খেলাধুলায় তার ব্যাপক আগ্রহ ও অনুরাগের কথা বলতেন অনুসারীরা। তবে তা নিয়ে অনেক সন্দেহ আছে।

তার প্রশ্রয়ে এক কাজী সালাউদ্দিনই দেশের ফুটবলটাকে নিয়ে গেছেন ধ্বংসের কিনারে। দেখেও যেন না দেখার ভান করতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। বরং তার পরোক্ষ ইঙ্গিতে প্রতিবার নীল-নকশার বাফুফে নির্বাচন করে সভাপতির চেয়ার আঁকড়ে থাকতেন সালাউদ্দিন।

অন্যদিকে চলতো বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের ক্রিকেট তামাশা, দল নির্বাচন থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই তিনি হাজির থাকতেন জোকারের মতো। বাকি ফেডারেশনগুলোও চলে গিয়েছিল আওয়ামী পান্ডাদের দখলে। খেলাধুলার কিছু না বুঝলেও ফেডারেশনের চেয়ার দখল করে রাখতে হবে তাদের।

যেমন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুস সোবহান গোলাপ উশু ফেডারেশনের সভাপতি হয়েছিলেন খেলাটির সঙ্গে ন্যূনতম সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই। এমনকি খেলাটি কীভাবে খেলে, কীভাবে পয়েন্ট হিসাব হয়, সেগুলো না জানালেও একজন ট্রাক ড্রাইভারকে এনে বসিয়েছিলেন সাধারণ সম্পাদকের চেয়ারে। আওয়ামী নেতাদের এমন নানা অপকর্ম ছড়িয়ে আছে ক্রীড়াঙ্গনে।

১৫ বছরের ক্রীড়ামন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। একেকজন একেক কিসিমের, আলাদা তাদের ক্রীড়া দর্শনও। কেউ বিদেশ সফরমুখী, কেউ অর্থমুখী আর মারমুখী আরিফ খান জয়ের সঙ্গে তো কারও তুলনা চলে না! একেকজন এমন কীর্তিমান মন্ত্রী, যদিও ক্রীড়া উন্নয়নের ধারে কাছেই কেউ ছিলেন না।

একেকজন একেক কিসিমের, আলাদা তাদের ক্রীড়া দর্শনও। কেউ বিদেশ সফরমুখী, কেউ অর্থমুখী আর মারমুখী আরিফ খান জয়ের সঙ্গে তো কারও তুলনা চলে না! একেকজন এমন কীর্তিমান মন্ত্রী, যদিও ক্রীড়া উন্নয়নের ধারে কাছেই কেউ ছিলেন না।

ক্রীড়া সাফল্য একটি দেশের ভাবমূর্তি যে বদলে দিতে পারে, এই ভাবনা থেকে শত হস্ত দূরে ছিল তাদের অবস্থান। মন্ত্রীদের কাছে গেলেই মিলতো ফেডারেশনের অনুমোদন। ৫৫টির মতো ক্রীড়া ফেডারেশন হয়েছে, অথচ দেশে কোনো আদর্শ ক্রীড়ানীতি নেই।

সম্ভাবনার নিরিখে কোন কোন খেলাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে, কোনটা খেলার আনন্দে এগোবে, এ ব্যাপারে তাদের কোনো পরিকল্পনাই ছিল না। বাস্তবতা হলো, সব খেলায় আন্তর্জাতিক পদকের সুযোগ নেই। তাই বলে খেলাগুলো বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। কারণ এর সঙ্গে জড়িত অনেক ছেলেমেয়ে, তারা খেলার আনন্দে খেলে যেতেই পারে।

খেলা শুধু পদক জেতায় না, শারীরিক ও মানসিক বিকাশেও এর অবদান আছে। আর পদকের লড়াইয়ে থাকবে আলাদা কয়েকটি ডিসিপ্লিন। কারণ তৃতীয় বিশ্বের দেশে সব খেলাকে সমান সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া কঠিন। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার যুগে ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে এমন বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণ থাকা উচিত বৈকি।

ক্রীড়া সংস্কার বলতে এখন আমরা দেখছি, ফেডারেশনগুলোর ভাঙাগড়া। রাজনৈতিক পালাবদলে বেশিরভাগ ফেডারেশনের সভাপতি লাপাত্তা বা শহরে থাকলেও আর ফেডারেশনমুখো হচ্ছে না। খেলাধুলা চালিয়ে রাখতে গেলে তাদের জায়গায় নতুন সভাপতি দিতেই হবে। সার্চ কমিটি নতুন লোক খুঁজছে এবং তাদের নেতৃত্বে ফেডারেশনে অ্যাডহক কমিটি গড়ার কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য, কমিটির নেতৃত্বে ব্যবসায়ীদের নিয়োগ দিয়ে খেলাধুলার কর্মকাণ্ড সচল রাখা।

সমস্যা হচ্ছে, ব্যবসায়ীদের তরফ থেকেও খুব ইতিবাচক সাড়া মিলছে না। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ফেডারেশনে ঢোকা ঠিক হবে কি না, ঢুকলে ভবিষ্যতে কী সমস্যা হতে পারে ইত্যাদি নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ করছেন ব্যবসায়ীরা। কেউ কেউ আগ্রহী হলেও বেশিরভাগ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

এছাড়া যেটা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনকে বাদ দিয়ে জায়গা দেওয়া হচ্ছে অন্যদের। সেটা হওয়াই উচিত। অনেক বছর ধরে তারা ক্রীড়াঙ্গন দখলে রেখে অশ্বডিম্ব উপহার দিয়েছে। তবে এখনকার সংকট হচ্ছে, জানা-বোঝা এবং সৎ চিন্তার লোক পাওয়া কঠিন। সংগঠকদের গড়পড়তা মান হলো, কোনো রকমে চালিয়ে নেওয়া। কোনো বড় ভিশন নিয়ে যে কেউ কাজ করবেন, সে রকম সংগঠক পাওয়া দুষ্কর।  

অ্যাডহক কমিটিতে ক্রীড়া সাংবাদিক রাখার কথাও শোনা যাচ্ছে। সরকার ইতিমধ্যে জেলা ক্রীড়াসংস্থার কমিটিতে স্থানীয় সাংবাদিক রাখার নির্দেশনা দিয়েছে। এটা আদৌ সুচিন্তিত কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সাংবাদিক ক্রীড়া ব্যবস্থাপনায় ঢুকলে কী কী বিপত্তি ঘটতে পারে, তা আমরা বিগত বছরগুলোয় কমবেশি দেখেছি।

তাছাড়া যিনি সাংগঠনিক কাজ করবেন, তিনি আবার ওই খেলা নিয়ে সঠিক রিপোর্টও করবেন, দুটো বোধহয় একসঙ্গে চলে না। তখন ওঠে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’-এর প্রশ্ন। তাই বলি, ক্রীড়া ফেডারেশন হলো সংগঠকদেরই জায়গা। তাদের দায়িত্ব খেলাধুলা এগিয়ে নেওয়ার, এই কাজ ঠিকঠাক চলছে কিনা সেটা দেখার কাজ সাংবাদিকদের। সাংবাদিকরাও একই কাতারে ঢুকে গেলে ভালো-মন্দ দেখবেটা কে?

মন্ত্রীদের কাছে গেলেই মিলতো ফেডারেশনের অনুমোদন। ৫৫টির মতো ক্রীড়া ফেডারেশন হয়েছে, অথচ দেশে কোনো আদর্শ ক্রীড়ানীতি নেই।

যাই হোক, যেসব অ্যাডহক কমিটি হচ্ছে সেই খেলাগুলোয় যে ক্রীড়া বিপ্লব হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং শঙ্কা জাগছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে খেলাগুলো সচল রাখতে স্পন্সর পাওয়া যাবে কিনা।

আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ব্যাংকগুলো যুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল বিভিন্ন ফেডারেশনের সঙ্গে। এখন ব্যাংকগুলোই ধুঁকছে, গ্রাহকদের টাকাই দিতে পারছে না তারা। তাই বলছি, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সামনের দিনে খেলা চালানো কঠিন হয়ে যাবে।

বড় সমস্যা হবে না শুধু ক্রিকেটের। তাদের অর্থের জোর আছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে যেটা ছিল না প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, সেটাও এখন অনেকখানি ঠিক হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে নাজমুল হাসান পাপনের জায়গায় নতুন সভাপতি ফারুক আহমেদের নিয়োগে।

ফারুক দায়িত্ব নেওয়ার পর পাকিস্তানের মাঠে বাংলাদেশ ঐতিহাসিক ক্রিকেট সিরিজ জিতেছে। সুবাদে ক্রিকেটে এখন খুশির হাওয়া, তাই সামনের দিনগুলোয় ক্রিকেট আরও সুসংগঠিত হবে বলে আশা করা যায়।

ফুটবলে তেমন কোনো পরিবর্তন না এলেও অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবস্থা বেগতিক দেখে সালাউদ্দিন আসন্ন নির্বাচনে অংশ না করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাতে অন্তত ১৬ বছরের ফুটবল স্বৈরাচারের অবসান নিশ্চিত হয়েছে। তার সময়ে ফুটবল সব হারিয়ে হতদরিদ্র চেহারা নিয়েছে।

আশার কথা, আগামী অক্টোবরে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচন হবে। এরপর নতুন নেতৃত্বের অধীনে খেলাটি যদি নতুন পথের দিশা খুঁজে নিতে পারে। দুটো বড় খেলাতেই আপাত স্বস্তির হাওয়া বইছে। এখন অবধি ক্রীড়াঙ্গনে অন্তর্বর্তী সরকারের সুফল দেখি এটুকুই।

সনৎ বাবলা ।। ক্রীড়া সম্পাদক, সকালসন্ধ্যা ডটকম