ছবি : সংগৃহীত

১৯৭৪ সালে সালের কথা, কবি রফিক আজাদ একটি কবিতা লিখেছিলেন—‘ভাত দে হারামজাদা’। ৩৩টি ছন্দোবদ্ধ পঙ্‌ক্তির এ কবিতা লেখার পর সে সময় কবিকে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এখনো সেই ভাত! সম্প্রতি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে গেল এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের ক্যান্টিনে ভাত খাইয়ে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ভাবছি, কোথায় আমরা স্বস্তিতে আছি? সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমাদের দেখতে হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, আমরা কি সেই লাউ-কদুর ছকের পুনরাবৃত্তি দেখতে চেয়েছি?

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঘটে যাওয়া বিশ্বজিৎ, আবরার হত্যা ঘটনাগুলোই এখন সামনে আসছে। সেই ঘটনাগুলো আমরা তখনো সমর্থন জানাইনি। এখনো করছি না। তখনকার সংকুচিত পরিসরেও আমরা সেসব ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছি। চলতি যে ঘটনাগুলোর কথা আমরা বলছি, সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতি-উত্তরও বিদ্রূপভাবে সামনে টানা হচ্ছে—‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’

কারা এ বিদ্রূপ ছড়াচ্ছে? এর মানে হচ্ছে, যে ঘটনাগুলো এখন হচ্ছে, সেগুলো ন্যায়সংগত করার নতুন নিয়ম এটি! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কীভাবে দুজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পরিতাপের বিষয় হলো, নিহত দুজনের মধ্যে একজন মানসিক ভারসাম্যহীন। এ রকম একজন মানসিক রোগীকে আমরা কী ভয়ংকর হিংস্রতায় হত্যা করলাম, তা-ও আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে দূরদূরান্ত থেকে আমাদের সন্তানরা আসে আন্তর্জাতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে। কী হচ্ছে তারা! 

‘মব জাস্টিস’ যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, কয়েক দিনে আমরা তার বেশ কয়েকটি ঘটনা দেখেছি। যেখানে-সেখানে যার যেমন ইচ্ছা লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে নেমে পড়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে মাজার ভাঙার মতো ঘটনা ঘটছে।

মব জাস্টিস শেষ পর্যন্ত ‘মব লিঞ্চিংয়ের’ মতো হৃদয়বিদারক ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। রাজশাহীতে পা হারানো সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, মাত্র তিন দিন আগে সন্তানের বাবা হয়েছিলেন তিনি। গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের লোকজন হামলা করে স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা শওকত আলী দিদারকে হত্যা করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথিকক্ষে আটকে রেখে এক যুবককে চোর সন্দেহে দফায় দফায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হামলার শিকার হয়ে সাবেক শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা নিহত হয়েছেন। এ হত্যার প্রতিবাদে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করেছেন।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তো থেমে নেই। গাইবান্ধা ও ময়মনসিংহে যৌথ বাহিনীর অভিযানের পর আওয়ামী লীগের দুজন ও বিএনপি একজন মারা গেছেন। স্বজনদের অভিযোগ, অভিযানের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনের কারণে তারা মারা গেছেন।

মব জাস্টিস নিয়ে অনেক কথা চলছে। এখন আমাদের খুঁজতে হবে এই ধরনের প্রবণতার কারণ কী? কেন এগুলো থামানো যাচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট থেকে ঘোষণা করা হলো, ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের রাজনীতি চলবে না। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ফল কী এটা হতে পারে? যুক্তি দেওয়া হয় যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফার একটা দাবি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা।

জবরদখল করে অছাত্রদের রাজনীতি বন্ধ করার কথা। কিন্তু একটা ছুঁতো দিয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত হলো। এটা ভুলে গেলে চলবে না, ছাত্ররাজনীতি না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। ছাত্ররাজনীতি না হলে এই জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সফল হতো না।

মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এ জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানকে মেলানোর যে ‘সমানুপাত’ তৈরি হয়েছে, তাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের অতিরিক্ত ক্ষমতায়ন দেখা যাচ্ছে। ‘যাচ্ছে তাই’ করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা এখন হঠাৎ পাওয়া ‘স্বাধীনতা’র (!) যে ব্যবহার করছে, তাতে তারা বেশ লাগামহীন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর যেটা ঘটেছে, সেখানে সবাই নিজেদের প্রাপ্য পেতে চাইছেন। নিজেদের সবাই ‘ক্ষমতাবান’ মনে করছেন। আমরা হয়তো ভুলে যেতে বসেছি, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে’র পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সময়ের শোষণ, নিপীড়ন আর নির্মমতার অভিজ্ঞতা।

শিক্ষার্থীদের প্রতি যে বৈষম্য হয়েছিল, সেগুলো তারা ত্বরিতগতিতে মিটিয়ে নিতে চায়। সে জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় তারা মব জাস্টিস চর্চা করে আসছে। কিন্তু তাদের এটা মনে রাখা দরকার, লড়াই করে জেতা আক্ষরিকভাবে দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়। সেটি কোনোভাবেই প্রতিশোধ নিজের হাতে নেওয়ার মতো শক্তিধর হয়ে উঠতে শেখায় না। এই গণ-অভ্যুত্থান নিশ্চিতভাবেই ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান। পরিতাপের বিষয়, সেখানে কেউ জনতার কথা বলছেন না। সবই এখন ‘ছাত্র’রা নির্ধারণ করছেন।

‘জনতা’র কাতারে কারা ছিল, তারা এখন কোথায়, কেউ তা খোঁজ করছেন না। প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত বলেছেন, তাদের ক্ষমতায় এনেছে ছাত্ররা। তাই আমরা দেখেছি সচিবালয়ে অবরুদ্ধ থাকা থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই ছাত্র মবের সহযোগিতা চেয়েছেন উপদেষ্টারা।

বিভিন্ন জেলায় ছাত্ররা যাচ্ছে, প্রশাসন তাদের সর্বোচ্চ প্রটোকল দিচ্ছে, ছাত্ররা সচিবালয়ে যাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদত্যাগে বাধ্য করার ক্ষেত্রেও এই মবই আসলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সবাই ভয় পাচ্ছে এই মবকে। ‘ছাত্র’ পরিচয়টি যেখানে একটি অতি বৃহৎ ঐক্য তৈরি করতে পেরেছিল, সেই পরিচয়টি এখন কেন ‘ভয়ের’ প্রতীক হয়ে উঠছে। এর কারণ আন্দোলনের ফসলটা চলে গেছে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির কাছে।

যার প্রভাবে উপদেষ্টা পরিষদেও আমরা শ্রমিক শ্রেণির কোনো প্রতিনিধি দেখতে পাইনি। এই আন্দোলনে শ্রমিক-মজলুম জনতা যোগ দেন এবং অনেকে জীবন দিয়েছেন। কিন্তু কোনো আলোচনাতেই তারা নেই। কেউ তাদের কথা বলেও না। তাদের সঙ্গে এ পর্যন্ত কেউ কোনো ধরনের আলোচনায় বসেননি। প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ্য, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ নূর হোসেন, ডা. মিলনের কথা সবাই স্মরণ করলেও শ্রমিকনেতা আমিনুল হুদা টিটোর নাম খুব একটা আসে না।

প্রতিটি আন্দোলনে একটি জনমানস চরিত্র থাকে। ইতিহাস হাতড়ালে আমরা দেখতে পাই, যতগুলো আন্দোলন হয়েছে এদেশে হয়েছে, তার পেছনে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, নেতৃত্বও দিয়েছে তারা। কিন্তু কোনো আন্দোলনই সফল হয়নি, যতক্ষণ সে আন্দোলনটি কৃষক, শ্রমিক, একেবারে সাধারণ মানুষ—জনমানস চরিত্রটি সামনে না এসেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে যদি আমরা সেই জনমানস চরিত্রটি ধরে রাখতে না পারি, তাহলে এ আন্দোলনের লিগ্যাসি প্রশ্ন উঠতে বেশি সময় লাগবে না।  

সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই আন্দোলন নিয়ে একধরনের নেতৃত্ব শক্তি ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। সেখানে সাধারণ মানুষের স্বর খুবই কম। রেসিজমের এটা একটা আকর্ষণীয় উপাদান, টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতার বাইরে পুরোনো দলকে সামনে নিয়ে আসা। সেই একটা কায়দা, একই কৌশল, যেটা আওয়ামী লীগ শাসনামলে দেখা গেছে, সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলন হলেই ‘জামায়াত-বিএনপি’ তকমা দেওয়া হতো, এখনো আন্দোলন হলেই তকমা পড়ছে ‘আওয়ামী লীগ’ বা কোনো এক ধরনের লীগ।

প্রশ্ন হলো, ট্যাগ লাগানোর যে বন্দোবস্ত, সেখান থেকে আমরা কতটুকু বের হতে পেরেছি? তাতে ফোকাসটা অন্যদিকে নেওয়ার আরেকটি বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে। প্রকৃত দোষীরা আড়ালে ঢাকা পড়ছে।

ইতিহাস থেকে আসলে কেউ শিক্ষা নেয় না। এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগকে কীভাবে ফ্যাসিস্ট, গণহত্যাকারী দল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা বা ঘায়েল করার চিরায়ত যে প্রবণতা, এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যেন এ সরকারের মূল কাজ।

আমাদের সতর্ক থাকতে হবে অনেক বিষয়েই। শিক্ষার্থীরা আমাদের গর্ব। তারা সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরাই ক্ষমতায় এনেছে বলে তাদের সব অন্যায় এবং অযৌক্তিক কর্মকাণ্ডের বিপরীতে কথা বলা যাবে না বা জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করা যাবে না, সেটি কেন?

কোনো এক গোষ্ঠী বা দলকে যদি অতিমাত্রায় ‘মহিমান্বিত’ করেন, তাহলে দেখবেন আপনি-আমি এভাবেই ফ্যাসিবাদকে বারবার লালন করছি এবং ভয়ের সংস্কৃতি থেকে আর মুক্তি মিলবে না। অথচ এই গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল ভয়কে জয় করেই এবং সেটি স্থায়ী করার জন্যই।

আগে আবরার ছিল এখন তোফাজ্জল, আগে লংগদু ছিল এখন দীঘিনালা, আগে হেলমেট ছিল এখন সমন্বয়ক, আগে ভারত ছিল এখন আমেরিকা। বিকল্প যদি এমন হয়, তবে বিকল্প নয়, বেসাতি দায় ও দরদের গল্পের বদলে আমূল পরিবর্তন চাই। সেটা কি একদমই সম্ভব না? আমরা কি এতটাই পচে যাওয়া মানবগোষ্ঠী হয়ে গেছি?

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার বিষয়টিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মব জাস্টিস ও মব লিঞ্চিং অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। নাগরিকদের মানবাধিকারের মৌলিক প্রশ্নের সঙ্গে আপস করার সুযোগ নেই। এখানে রাষ্ট্রের নীরবতা মানে ফ্যাসিজমের নতুন কারণ তৈরি হওয়া।

আগে ছিল বিচারহীনতার সংস্কৃতি, এখন মব জাস্টিস। পার্থক্য কোথায়? তর তর করে পার হওয়া মাত্র ৪৫ দিনে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, সেসব প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। এসব প্রশ্নের ফয়সালা হওয়া জরুরি। নচেৎ সরকারকে ‘অশীতিপর’ সংকটে পড়তে হবে।

হাবীব ইমন ।। রাজনৈতিক বিশ্লেষক