ছবি : সংগৃহীত

আমার জানামতে, বেসামরিক সরকার কর্তৃক সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্বপূর্ণ লেখক ও গবেষকদের বেশকিছু বিশাল প্রকাশনা আছে। এর মধ্যে ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের The Soldiers and the State নামক গবেষণা গ্রন্থটি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। তিনি ঐ গ্রন্থে সামরিক বাহিনীকে পেশাগত উন্নতি ও মূল্যায়নের মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণের (Objective Control of Military) ধারণাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তিনি গবেষণা ও যুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল বা দলের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আনুগত্যের মাপকাঠিতে পদোন্নতি ও পদায়নের মাধ্যমে নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গ দ্বারা সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ (Subjective Control) করলে তার ফল উল্টো হতে বাধ্য। কারণগুলো সহজেই বোধগম্য—পেশাগত দক্ষ অফিসারদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি, আনুগত্য প্রকাশের অসুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি, পেশাগত দক্ষতা অর্জনে নিরুৎসাহিত হওয়া, কম্যান্ড চেইনসহ সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল হওয়া, কমান্ডের প্রতি একক আনুগত্য সৃষ্টির পরিবর্তে বহুবিধ আনুগত্য সৃষ্টি হওয়া ইত্যাদি। যার ফলশ্রুতিতে দেশে সামরিক অভ্যুত্থান, সামরিক শাসন, অনির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি ঘটতে পারে। বইটির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো আলোকপাত না করে, স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের মতো জগৎবিখ্যাত একজন রাষ্ট্র বিজ্ঞানী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই সত্যটি অবতারণা করলাম। কারণ এই সত্যটি আমরা সবাই জানি, কিন্তু কেও কি মানছি?

ভারত ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র ১৯৪৭ সালে একই সাথে গঠন হওয়ার পরে, একটির গণতান্ত্রিক ভিত্তি এত সুদৃঢ় হলো যে আজ পর্যন্ত সামরিক অভ্যুত্থান, সামরিক শাসন বা অনির্বাচিত সরকার কিছুই প্রত্যক্ষ করতে হলো না। অথচ আরেকটি রাষ্ট্র বার বার গণতন্ত্রের স্থায়ী ভিত্তি দিতে হোঁচট খেয়ে যাচ্ছে। আর এত সংগ্রাম, যুদ্ধ ও লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে সেই পাকিস্তান থেকে বের হয়েও, আমরা কি তাদের পদাঙ্কই অনুসরণ করে চলছি না?

ভারত ও পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ভিত্তিগুলোর কারণ ও পার্থক্য খুঁজলে—অনেক বিষয়া আসবে। যা নিয়ে অসংখ্য গবেষণা ও বই লিখিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হলো একটি রাষ্ট্র সামরিক বাহিনীকে বস্তুনিষ্ঠভাবে পেশাগত উন্নতি ও মূল্যায়নের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং করছে, আর আরেকটি সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে।

১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময় জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বাধীন সামরিক বাহিনীর ওপর বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তেমন বিতর্ক না থাকলেও, মুজিব বাহিনী নামে একটি সমান্তরাল রাজনৈতিক দলীয় বাহিনী সৃষ্টি, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রক্ষীবাহিনী এবং জেনারেল ওসমানীর অবসর পরবর্তীতে সিনিয়র ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও জেনারেল জিয়াউর রহমানকে অতিক্রান্ত করে জেনারেল সফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিয়োগ ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিকীকরণ ও বাহিনী নিয়ন্ত্রণের শুরু।

শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে সামরিক বাহিনীর উন্নতি বা ওয়েলফেয়ারের দিকে না তাকিয়ে, রক্ষীবাহিনীকে একটি বিশেষ বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নিয়ে বিস্তর প্রমাণ সমৃদ্ধ লেখালিখি ও গ্রন্থ আছে।

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী সামরিক বাহিনীকে পেশাগতভাবে উন্নত করার প্রচেষ্টা তো দূরের কথা, সামরিক বাহিনীর অফিসারদের পদায়ন তার, তার দলের ও তার পরিবারের সদস্যদের পছন্দ মতো হতো। তারপর বাকশালের মধ্য দিয়ে সামরিক বাহিনীকে আওয়ামীকরণের ব্যবস্থা তো হয়েছিলই। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার অধীনে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি একটি উদাহরণ হতে পারে, যেখানে প্রত্যেক কম্যান্ড স্তরে একজন পলিটিক্যাল কমিশনারের নিয়োগ দেওয়া হয়।

অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও, ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতার মাত্র ৪ বছরের মাথায় সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিকীকরণ ও সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণের নির্মম ফল পেলাম। রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান ও সিপাহী জনতার বিপ্লব হলো। তারপর এলো জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন। যেকোনো সামরিক শাসনই সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিকীকরণ করে—এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য।

তবে তিনি তার সামরিক ও রাজনৈতিক শাসনামলে সামরিক বাহিনীর পেশাগত উন্নতিসহ কাঠামোগত উন্নতির প্রভূত চেষ্টা করেছেন—এতে কোনো সন্দেহ নেই। তিনি ও তার সরকার কখনো পদায়ন ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করেছেন বলে আমাদের সিনিয়র অফিসারদের কাছ থেকে কখনো শুনিনি। তার মানে, তিনি হয়তো সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণের পথে হাঁটতে চাননি। তার উদ্যোগে প্রণীত War Book 1978 এটা প্রমাণ করে যে, সামরিক বাহিনী ও কোনো সম্ভাব্য যুদ্ধ একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হবে। কিন্তু মুজিব সরকারের রাজনীতিকীকরণ, মুক্তিযোদ্ধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দুই বছরের অ্যান্টি-ডেট সিনিয়রিটি দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা-মুক্তিযোদ্ধা নয় এমন অফিসারদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি, আওয়ামী সরকারের সুবিধা বঞ্চিত ও সুবিধা প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যে বিভেদ ইত্যাদির ফল জেনারেল জিয়াকেও গ্রাস করলো। সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ছিল কিনা জানা না গেলেও জেনারেল জিয়া, অত্যন্ত জনপ্রিয় সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনরায় প্রবক্তা হয়েও, কোনো ষড়যন্ত্রের ফলে কিছু বিপথগামী অফিসারের হাতে নিহত হন।

১৯৮১ পরবর্তী বিচারপতি সাত্তার-এর বিএনপি সরকারের শাসনামলে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণে কোনো সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা না থাকলেও, তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের ক্রমেই পরিস্ফুট রাজনৈতিক উচ্চবিলাষকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হন।

জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন আবারও গণতন্ত্রের চাকাকে অচল করে সামরিক বাহিনীর অরাজনৈতিক অবস্থা বজায় রাখাকে অসম্ভব করে ফেললো। তবে ৫ আগস্ট ২০২৪ পূর্ববর্তী সময়ের সাথে তুলনা করলে, সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় জেনারেল এরশাদ সরকারের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণ অনেক কম ছিল। তিনি মূলত সামান্য কয়েকটি জ্যেষ্ঠ পদে নিজের লোক বসাতেন বলে এবং কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের অবমূল্যায়ন করেছেন বলে কথিত আছে। কিন্তু পদোন্নতি ও পদায়নে পেশাদারিত্বের অবমূল্যায়ন করেছেন বলে জানা যায়নি। বিশেষ করে সব পর্যায়ের পদোন্নতি প্রদান ও পদায়নের ক্ষেত্রে কখনো কারও পরিবারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেতে তার কোনো নির্দেশনা ছিল না অথবা কোনো রকম হস্তক্ষেপ করেননি। জেনারেল আতিকের মতো পেশাদার ও নির্লোভ জেনারেল ও পরবর্তীতে জ্যেষ্ঠতা ভঙ্গ না করে জেনারেল নুরুদ্দিন খানকে সেনাপ্রধান নিয়োগ নিশ্চয়ই জেনারেল এরশাদ সরকারের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আমার বক্তব্যকে কিছুটা হলেও সমর্থন করবে। তবে সেনাবাহিনীর নিষ্কণ্টক সমর্থন তাকে স্বৈরাচারী করে তুলেছিল।

এরশাদ পরবর্তী বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের শাসনামলে সামরিক বাহিনীকে পেশাদারিত্বের আলোকে বস্তুনিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণের সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থায় না আনলেও, রাজনীতিকিকরণ ও সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণের প্রসার খুব ব্যাপক হয়নি। কিন্তু ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পূর্বেই—দেশের ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার—বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সরকারের সময় শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নিজেদের নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠলেন ও সেনাবাহিনীকে সামরিক অভ্যুত্থানে প্ররোচিত করলেন। তাদের ছত্রছায়ায় ১৯৯৬ সালের ২০ মে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম হঠকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে উৎখাতের নামে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করলেন। সামরিক বাহিনীর ৯ পদাতিক ডিভিশনের সময়মতো পদক্ষেপের কারণে এই যাত্রা দেশ গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় সক্ষম হলেও, এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ও এর দমনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এই প্রথম দুটি ভাগে বিভক্ত করে দুর্বল করার কাজটি শুরু হলো। রক্তক্ষয়ী পর্যায়ে গেলে যার পরিণতি এই দেশের জন্য অতীব ভয়াবহ হতে পারতো। কিন্তু এর দায় তো দূরে থাক, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে জেনারেল নাসিমসহ ষড়যন্ত্রে ও ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িতদেরকে বরং পুনর্বাসন করলো। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী সরকার সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের সব প্রক্রিয়া শেষ করলেন। দেশ ও সামরিক বাহিনীকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম অবসরকালীন ছুটি থেকে জেনারেল মুস্তাফিজকে ডেকে এনে সেনাপ্রধান নিয়োগ করলেন। যিনি ছিলেন শেখ হাসিনার ফুপা (বর্তমান সেনাপ্রধানের শ্বশুর)। ব্যক্তিগতভাবে জেনারেল মুস্তাফিজ অনেক পেশাদার ও যোগ্য অফিসার হলেও, তিনি অতিক্রান্ত ছিলেন না অথবা অকালীন অবসরও প্রাপ্ত হননি। স্বাভাবিক অবসরে যাওয়া একজন জেনারেলকে নিজ আত্মীয় হওয়ার কারণে নিয়োগ দিয়ে তিনি সামরিক বাহিনীতে শুধু রাজনীতিকীকরণ বা দলীয়করণই শুরু করলেন না, সামরিক বাহিনীকে পরিবারতন্ত্রে ঢুকিয়ে দিলেন। পরিবার তন্ত্রের ফলে জেনারেল তারেক সিদ্দিকির পদোন্নতি ও পদায়ন ছাড়াও সামরিক বাহিনীতে গোপালগঞ্জতন্ত্র ঢুকে গেল, শেখ কামাল ও শেখ জামালের কোর্সমেট ও শেখ হেলালের ক্যাডেট কলেজমেটরাও বিশেষ তালিকায় যুক্ত হলো। সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ব্যাপক হারে প্রসার ঘটলো। এই সময়েই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরকারের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়ানো শুরু হলো, মিডিয়ার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলো, সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ অফিসারদের পদোন্নতি ও পদায়নে ক্রমেই নাক গলাতে লাগল।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারে এলো বিএনপি। এবার বিএনপি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে ক্রমেই সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বাড়ালো। বিএনপি এবার র‍্যাব ফোর্স গঠনের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর অফিসারদের পেশাগত ওরিয়েন্টেশনকে পাশ কাটিয়ে পুলিশিং ভূমিকায় সংশ্লিষ্ট করলো ও তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহারের সুযোগ করে দিলো। যার ফল আজকের লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিব, মেজর জেনারেল জিয়াউল হাসান, রিয়ার অ্যাডমিরাল সোহাইল এবং আরও অনেক।

পরপর দুই রাজনৈতিক সরকারের দ্বিমুখী দলীয়করণ ও ক্রমাগত বৃদ্ধিকৃত সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণের কারণে সামরিক বাহিনীতে শুধু পেশাগত উন্নতি ক্ষতিগ্রস্ত হলো না, সামরিক বাহিনীর অফিসারগণ যেন ৩টি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ল—আওয়ামী, বিএনপি এবং বঞ্চিত পেশাগতভাবে দক্ষ ও নিরপেক্ষ গ্রুপ। যা হওয়ার তাই হলো—ষড়যন্ত্রকারীদের খপ্পরে পড়ে রাজনৈতিক কোন্দলের সুযোগ নিয়ে জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে আবারও রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলো সামরিক বাহিনী। দুই বছর ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্যারাকে ফেরত গেলেন ঠিকই; কিন্তু সাথে নিয়ে গেলেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ক্ষোভ, হিংসা এবং দুর্নীতি, লোভ ও ক্ষমতা অপব্যবহারের দুর্নাম। দুর্বল হয়ে গেল সামরিক বাহিনীর পেশাগত ভিত্তি এবং একতা। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার দুই মাসের মধ্যে সেনাবাহিনীর দুর্বলতার সুযোগে সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়াসহ তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে বিডিআর কার্নেজ ঘটানো হলো, ৫৭ জন মেধাবী ও পেশাদার অফিসারদের হত্যা করা হলো ও পরে অনেককে চাকরিচ্যুত করা হলো। খুনিদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো, পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হলো, আর সেনাবাহিনী চেয়ে দেখলো। এটা আবার ঘটলো সেই ১৯৯৬ সালের একই সরকারের সময়, যারা ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন করেছিলেন। তারপরের ১৫ বছরের ইতিহাস সবার জানা। শেখ রেহানার দেবর জেনারেল তারেক সিদ্দিকিকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিয়োগ, তার মাধ্যমে বাহিনীগুলোর ওপর রাজনৈতিক খড়্গ চালানো ও গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর চরমভাবে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য হাসিলে গুম, খুন, আয়নাঘর সৃষ্টিসহ সব ধরনের অপকর্মে লিপ্ত করেছেন। সামরিক বাহিনীর রাজনীতি ও দলীয়করণ ও সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীতে পেশাগত উন্নতির পথ রুদ্ধ করেছেন। একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়ায় অসুস্থ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে অনেক পেশাদার মেধাবী অফিসারও তাদের নীতি ও নৈতিকতা থেকে বিচ্যুত হন। যেটা অত্যন্ত দুঃখজনক।

৫ আগস্ট ২০২৪-এ ছাত্র জনতার বিপ্লবের ফলে আমরা নতুন স্বাধীনতা পেয়েছি। পচনশীল বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সর্বক্ষেত্রে সংস্কারকে স্থায়িত্ব দিতে সামরিক বাহিনীকে পেশাদারিত্বের আলোকে সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে বেসামরিক সরকারকে স্বৈরাচারী হতে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা যাবে না।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সরকার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন ।। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা