বিদ্যুৎ-জ্বালানি বিষয়ে করণীয় ও পরিকল্পনা
জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নতুন স্বপ্নে পথচলা শুরু করেছে। একজন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের নেতৃত্বে আমাদের যাত্রা শুরু। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদও নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এতে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব সন্নিবিষ্ট হয়েছেন যারা তাদের নিজস্ব ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন এবং সার্বিকভাবে সুশীল সমাজের নজর কেড়েছেন।
ফলে আমরা আশা করতেই পারি দেশ ভালো আগামীর পথে হাঁটবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিদ্যুৎ সেক্টর আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার ভয়ই হচ্ছিল, কখন না আবার বিদ্যুৎ ঘাটতির কথা শুনতে হয়! যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হবেই। এবার প্রায় ২৫০০-৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতির ধাক্কায় পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
বিজ্ঞাপন
বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র কারিগরি ত্রুটির কারণে বন্ধ রয়েছে, কেউ পাওনা আদায়ের তাগিদ দিচ্ছেন, আবার গ্যাস খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলএনজি টার্মিনাল প্রায় তিন মাস ধরে অকার্যকর রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ভয়, এই ঘাটতি সম্ভবত আরও বাড়তে পারে। কারণ গ্যাসের সরবরাহ একসাথে তিনটি খাতের চাহিদা জোগায় ঘরগৃহস্থালির দৈনন্দিন কাজে, শিল্পকারখানায় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রে। ফলে গ্যাসে র্যাশনিং করতে হলে এই তিনখাতই নড়বড়ে হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
গ্যাসের অবস্থা নাজুক হলে বিদ্যুতের জন্য স্বাভাবিকভাবে চাপ পড়ে তেল চালিত কেন্দ্রগুলোর ওপর। এদের জ্বালানি কিনতে গেলে ডলারের ওপর চাপ পড়বে, তাছাড়া উৎপাদনের বেশি চাপে এদের কারিগরি ত্রুটিও দেখা দেবে। এইসব প্রভাবকের মিলিত চাপে বিদ্যুৎ ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অতিদ্রুত এই ঘাটতি পোষানো যাবে না এবং কিছুটা সময় লেগেই যাবে পাওনা মেটাতে, কারিগরি ত্রুটি সারাতে এবং গ্যাস সরবরাহ আগের ভলিউমে প্রত্যাবর্তন করতে।
জ্বালানি নিয়ে আমাদের সমস্যা থাকছেই এবং প্রতিটি মৌসুমেই এই সমস্যার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। অথচ প্রত্যাশা ছিল আমাদের এইসব পদ্ধতিগত সমস্যা আর থাকবে না। নবপ্রভাতের পথচলায় পথের কাঁটার মতো এই সমস্যা হঠাৎ করে ঘাড়ে চেপে বসেছে।
তাৎক্ষণিক করণীয় কী তা বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা ঠিক করছেন। কিছু পাওনা মিটিয়ে অন্তত আদানির বিদ্যুৎ-সরবরাহ নিশ্চিত করা হোক, মাতারবাড়ি ও বড়পুকুরিয়ার সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান হোক–এগুলো আমাদের প্রত্যাশা।
ব্যক্তিগতভাবে আমার ভয়ই হচ্ছিল, কখন না আবার বিদ্যুৎ ঘাটতির কথা শুনতে হয়! যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হবেই। এবার প্রায় ২৫০০-৩০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতির ধাক্কায় পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি চালু হোক, যদিও এর কারিগরি ত্রুটির প্রকরণটি আমাদের অজানা, তবু তিন মাসের মতো সময়ে অচঞ্চল বসে থাকা কাম্য নয়। আমরা একটি গতিশীল, ক্রিয়াশীল জ্বালানি টিম চাই।
এ বিষয়ে কিছু কাজ করা যায় এবং এটা এখনই করতে হবে, যাতে করে ভবিষ্যতে আমরা গতিশীল জ্বালানি খাত পাবো যা নিজের সমস্যাকে চিহ্নিত করে তার সমাধান করতে আগেই তৎপর হবে। আমার পক্ষ থেকে কিছু জরুরি উপদেশ হলো—
১। জ্বালানি ভাবনায় সবসময় মৌলিক বিষয়গুলো জোর দিন—মেগাওয়াট (ক্ষমতার একক) নিয়ে উল্লম্ফন নয়, জুল (শক্তির একক)-এর হিসাব করুন; জ্বালানি ঘনত্ব এবং জেনারেশন-কার্ভের [কিলোওয়াটঘণ্টা (কিঃওঃঘঃ) বনাম ঘণ্টা অথবা মিনিট] কথা ভাবুন।
২। বাংলাদেশ এমন কোনো জ্বালানি ব্যতিক্রমী দেশ নয় যে তাকে ফুয়েল আমদানি করতে হবে না। অতএব, আমাদের একটি কোর-গ্রুপ থাকা প্রয়োজন যারা এনার্জি প্রাইসিং নিয়ে মডেল নির্মাণ করতে সক্ষম হবে, আন্তর্জাতিক বাজারে দরের ওঠানামা নখদর্পণে রাখবে, এবং একাধিক বিকল্প সাপ্লাই চেইনের সন্ধানে থাকবে।
আরও পড়ুন
৩। জ্বালানি নিরাপত্তার কথা ভাবুন। জ্বালানি সরবরাহের একাধিক বিকল্প ভাবনা প্রস্তুত রাখার জন্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করুন। এটি উচ্চ ক্ষমতার হবে। এদের একটি কাজ হবে জ্বালানিখাতের ডেটা সংগ্রহ করে মডেল নির্মাণের ভিত্তিতে স্মার্ট এনার্জি মিক্স সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং সরকারকে সেই পথে পরিচালিত করা। এদের আরেকটি কাজ হবে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের ভিত্তি তৈরি করা, যাতে ভবিষ্যতের জ্বালানি পরিকল্পনাসমূহ আমরা নিজেরাই করতে পারি।
৪। গ্রিডে সৌর বা বায়ু বিদ্যুৎ যত বেশি যোগ হবে, গ্রিডের ঝুঁকি তত বাড়বে। এটি প্রকৃতিগতভাবে সত্য কথা। এছাড়াও পরমাণু বিদ্যুৎ বহন করার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিগত দশকগুলোয় আমাদের যে পরিমাণ বিনিয়োগ ছিল, গ্রিডে তেমন ছিল না। এই বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার, অর্থপূর্ণ স্মার্ট গ্রিড আমাদের জাতীয় প্রয়োজন।
৫। জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিনিয়োগ কমিয়ে নবায়নযোগ্য এবং পরিচ্ছন্ন বিদ্যুতের উৎসগুলোর অন্বেষণে বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজন। কার্বন-নিরপেক্ষ অর্থনীতি নির্মাণ একটি বৈশ্বিক লক্ষ্য, এখান থেকে আমাদের বিচ্যুত হওয়ার কোনো মানে হয় না।
বাজেটে আরও যে দুটো জিনিস খুব হিসাব করে লক্ষ্য রাখতে হবে সে দুটি হলো–শুল্ক এবং ভর্তুকি। অযাচিত শুল্ক যেমন জ্বালানি খাতে দুর্ভিক্ষ আনতে পারে (নবায়নযোগ্য খাত অবশ্যই শুল্ক ছাড়ের অধিকার রাখে), তেমনি ভর্তুকি হিসাব মতো না হলে হয় অতিরিক্ত অপচয়কে প্রশ্রয় দেবে নয়তো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে অহেতুক রাজনৈতিক ঝুঁকি আনয়ন করবে।
৬। দেশের লোড-কার্ভকে এমনভাবে পরিবর্তন করা দরকার যাতে পিক-লোড মধ্যাহ্নের দিকে হয়। এখন সেটা হয় সন্ধ্যায় অর্থাৎ ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত বিদ্যুৎই আমাদের জ্বালানির সর্বোচ্চ দাবিদার। যদি সন্ধ্যার বদলে মধ্যাহ্নে পিক-লোড চলে যায়, তাহলে আমরা সহজে কোনো ব্যাটারি সঞ্চয় ছাড়াই সোলার পাওয়ারকে কাজে লাগাতে পারব।
সুনীল অর্থনীতি বেগবান করার সময় হয়েছে। সামুদ্রিক গবেষণা, মৎস্যসম্পদ, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, ইকোলজি ইত্যাদি নিয়ে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন।
এই গৃহী-চরিত্রের লোডকে বদলে দিয়ে তাকে ‘শৈল্পিক’ তথা ইন্ডাস্ট্রিয়াল করা একটা বিরাট কাজ, যার জন্য বিশাল দক্ষযজ্ঞের প্রয়োজন। সমন্বিত পরিকল্পনানুসারে, দেশের চূড়ান্ত জ্বালানি ব্যবহারের (final energy consumption) ২৯ শতাংশ শিল্প কারখানায় আর ৪৮ শতাংশ বাসাবাড়িতে হয়। সঠিক শিল্পায়ন আমাদের জন্য এখনো সুদূরে।
৭। একটি যুগোপযোগী এনার্জি ডেটা সেন্টার এখন সময়ের দাবি। যুক্তরাষ্ট্রের ‘এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের’ আলোকে বাংলাদেশের একটি জাতীয় জ্বালানি তথ্যাগার প্রয়োজন। শুধু বিদ্যুতের নয়, গ্যাস, তেল ও এলএনজি সরবরাহ কোন লাইনে কত যাচ্ছে, কোন অঞ্চলে কতখানি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, কোথায় বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে এসবই যেন মনিটর করা সম্ভব হয়। বুয়েটে এমন একটি সেন্টার হতে পারে।
৮। সুনীল অর্থনীতি বেগবান করার সময় হয়েছে। সামুদ্রিক গবেষণা, মৎস্যসম্পদ, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, ইকোলজি ইত্যাদি নিয়ে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। সামুদ্রিক ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধান, অফশোরে বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প গ্রহণ এখন জরুরি।
৯। গবেষণায় জোর দিতে হবে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জ্বালানি নিরাপত্তা বিষয়ক গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। জ্বালানি বিষয়ে ভাবাবেগ নয়, বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের সাহায্যে তথ্য-নির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে গবেষণালব্ধ জ্ঞান বিশেষ সহযোগী।
১০। জ্বালানি শিক্ষায় স্কুল কারিকুলামকে অন্তর্ভুক্ত করলে জ্বালানি সচেতনতা স্কুল পর্যায় থেকেই তৈরি হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আপনাআপনিই জ্বালানি শিক্ষিত হয়ে গেলে আমাদের দুশ্চিন্তা কমবে।
১১। আগামী বছরের বাজেটগুলোয় সমন্বিত জ্বালানি মহাপরিকল্পনার ধাপগুলোকে (স্বল্পমেয়াদে যা যা করতে বলা হয়েছে) অনুসরণ করে প্রণয়ন করতে হবে, পরিকল্পনাটির সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও। আমাদের দেখানো উচিত আমরা অন্তত একটি পরিকল্পনাকে অত্যন্ত সিরিয়াসলি নিয়েছি, আমরা এতে বিশ্বাস করি এবং আস্থা রেখেছি। পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন না করে নতুন আরেকটি রোডম্যাপ তৈরি করার ‘খেলা’ থেকে আমাদের বের হওয়া দরকার।
ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী ।। পরিচালক, জ্বালানি ও টেকসই গবেষণা ইন্সটিটিউট; অধ্যাপক, তড়িৎকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়