ছবি : সংগৃহীত

গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতন হয়েছে ফ্যাসিবাদী সরকারের। গঠিত হয়েছে ছাত্র জনতার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পূর্তিতে অবতরণ ঘটেছে পুরোনো সংকটের। একেক দেশের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জে হিমশিম খেতে হচ্ছে নতুন সরকারকে তার ওপর সামনে আসছে আন্তর্জাতিক কূট চালের নানা অপতৎপরতাও।

দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, ৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই রোহিঙ্গারা আবারও দলে দলে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে উখিয়া ও টেকনাফের স্থল ও নৌ পথে সীমান্তের ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে। এবার তাদের অনুপ্রবেশের সংখ্যাটাও কিন্তু নেহাত কম নয়। কোথাও শোনা যাচ্ছে দশ হাজার আবার কোথাও শোনা যাচ্ছে বিশ হাজারেরও বেশি।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন এত রোহিঙ্গা আবারও বাংলাদেশে প্রবেশ করছে? আমরা কি পারি না তাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে? তবে রোহিঙ্গা সংকট সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমাদের খুব গভীরে প্রবেশ করতে হবে। চোখ, কান খোলা রেখে মাপতে হবে নির্ধারক ও অনুঘটক বিষয়গুলো।

বাংলাদেশের সাথে দুটি দেশের প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। দেশ দুটি হলো ভারত ও মিয়ানমার। বর্তমান সময়ে ভারতের সাথে আমাদের কাগজে-কলমে না হলেও আপাতদৃষ্টিতে তিক্ত সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। মিয়ানমারের সাথে যে সম্পর্ক খুব মধুর তেমনটা কিন্তু নয়। মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধে বরাবরই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ককে প্রশ্নবিদ্ধ করে আসছে। তার কারণও আমাদের সবারই জানা—তা হলো রোহিঙ্গা ফ্যাক্টর। প্রতিবেশী দেশের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় না রাখলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি পড়বে এটা সবাই বুঝি। তাহলে করণীয় কী?

মিয়ানমারের নৃ-গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সামরিক বাহিনী বা সরকারের সংঘাতের ইতিহাস বেশ পুরোনো। ১৯৪৮ সাল থেকে বিদ্রোহ চলছে সেখানে। এখন সেটা আরও জোরদার ও বিস্তৃত হয়ে উঠেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর সঙ্গে সামরিক বাহিনীর লড়াইয়ের ফলে।

বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের নেতৃত্বে আছে আরাকান আর্মি, আরাকান রোহিঙ্গা ইসলামিক ফ্রন্ট, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি, আরাকান লিবারেশন পার্টিসহ ছোট বড় বিভিন্ন দল-উপদলের গ্রুপ। তবে তিন মাস ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রাথিডং শহর ছাড়াও আশেপাশের প্রদেশে যে গৃহযুদ্ধ চলছে তাতে অনেকটা ব্যাকফুটে রয়েছে জান্তা সরকার।

স্বাধীনতার খুব কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে আরাকান আর্মি ও রাখাইন রাজ্য। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে রাখাইনে সরকার গঠনের অপেক্ষায় রয়েছে আরাকান আর্মি। বলা ভালো, রোহিঙ্গারা মূলত পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলের উত্তরাংশে বসবাস করছে। তারা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বটে।

আরকান আর্মি মিয়ানমারের স্বাধীনতাকামী একটি গোষ্ঠী। বাংলাদেশের কি উচিত হবে এই মুহূর্তে আরাকান আর্মির সাথে সম্পর্ক রাখা? বাংলাদেশ যদি সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করতে না পারে তাহলে কি তৃতীয় কোনো শক্তির সহায়তা নেবে?

পৃথিবীর প্রায় সব দেশ এখন অভিবাসী সমস্যায় আক্রান্ত। এটি একটি জাতীয় সমস্যাও বটে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট বেশ পুরোনো হলেও রোহিঙ্গা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক কার্ড খেলাও কিন্তু বেশ রহস্যের সৃষ্টি করেছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো দেশের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্ক রাখার বিষয়ে কোনো প্রবিধান নেই। এখন কি উচিত নয় মিয়ানমারের সাথে আমাদের সম্পর্ক পুনরায় নির্ধারণ করা? মিয়ানমার নীতিতে আমাদের অবস্থান নির্ধারণ করার এখনই সুযোগ বলছেন বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। 

ইতিহাস বলছে, আরাকান আর্মির সাথে রোহিঙ্গাদের সম্পর্ক ভালো না। মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের লোভ দেখিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদানের সুযোগ করে দিয়ে আরাকান আর্মির বিপরীতে দাঁড় করিয়েছে। এতে করে রোহিঙ্গাদের সাথে আরাকান আর্মির জাতিগত সংঘাত আরও তীব্র হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, এত সব সমীকরণে আদৌ রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে কি পরিবর্তন ঘটবে?

বাংলা সাহিত্যে একটা প্রবাদ আছে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। আমরা কি এর যথার্থ ব্যবহার করতে পারি না? মিয়ানমারের জান্তা সরকার যেমন রোহিঙ্গাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। আমাদেরও উচিত আরাকান আর্মির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে রোহিঙ্গাদের সমস্যার সমাধান করা। বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও এই বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক দেখলাম। তবে খুব কৌশলে এ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। না হলে যে প্রতিঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে সেটা মাথায় রাখতে হবে।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশ এখন অভিবাসী সমস্যায় আক্রান্ত। এটি একটি জাতীয় সমস্যাও বটে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট বেশ পুরোনো হলেও রোহিঙ্গা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক কার্ড খেলাও কিন্তু বেশ রহস্যের সৃষ্টি করেছে।

লোকের মুখে কান পাতলে এখনো শোনা যায়, শুধুমাত্র নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আশায় নাকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের নিয়ে বৈশ্বিক সুবিধা ভোগ করার চেষ্টা করেছেন। মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়ার নাম করে তাদের প্রত্যাবর্তনের কোনো দৃশ্যমান সমাধান না করে বরং জিইয়ে রেখেছেন তিনি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ১২ লাখের যে গল্প শুনি বাস্তবে তা তিন চারগুণেরও বেশি। তা কি আমাদের জানা আছে?

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন সমস্যা যে শুধু বাংলাদেশের একার তা কিন্তু নয়। আসিয়ান (Association of Southeast Asian Nations) ভুক্ত দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতেও একই সমস্যা রয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও রোহিঙ্গাদের নিয়ে বেশ চাপে আছে। মধ্যপ্রাচ্যেও রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের এখন ইউরোপে দেখা যায়। সবারই যদি রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা হয় তাহলে কেন আমরা এর সমাধান করি না?

বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা কর্মহীন। রাষ্ট্রের ওপর সরাসরি নির্ভরশীল তারা। তাদের লালন-পালনে রাষ্ট্রের বৃহৎ অর্থ খরচ হয়। এত বিশাল সংখ্যক কর্মহীন ও নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী নিয়ে কীভাবে দেশের প্রতিভূ উন্নয়ন করবো আমরা?

তার ওপরে তাদের আশ্রয় দিয়ে আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হীনতায় ভুগচ্ছি। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবনার জগৎকে আরও সম্প্রসারিত করতে হবে। এখনই সময় এসেছে আবেগ বাদ দিয়ে বিবেক দিয়ে কাজ করার। বিগত সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে এক প্রকার ব্যর্থ হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে আমরা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারবো? দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে কি সেই ক্ষমতা আছে? দৃশ্যমান পরিস্থিতির কি কিছুটা উন্নতি হয়েছে?

মাদকের ভয়াবহ রুট হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মূলত রোহিঙ্গা ও দেশের কিছু স্থানীয় দালালরা এই চক্রের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের দেশ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাউস থেকে শুরু করে বাংলাদেশ-ভারত হয়ে গোল্ডেন ক্রিসেন্টের দেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানে এই মাদক চালান চলে যায় অনায়াসে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও রোহিঙ্গাদের নিয়ে বেশ চাপে আছে। মধ্যপ্রাচ্যেও রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে, রোহিঙ্গাদের এখন ইউরোপে দেখা যায়।

মাদকের এই ভয়াবহ রুট সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। কারা এই মাদকের বাহক হিসেবে কাজ করছে তাদের আমরা ধরছি না কেন? কেন আমাদের তৎপরতা নেই? তাদের ধরলে তো রোহিঙ্গাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড আমরা ভাঙতে পারবো।

চলুন দেখা যাক, কীভাবে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আন্তরিক হতে পারবে। মিয়ানমারের ওপর চাপ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক মিশনগুলোর প্রচার কার্যক্রম বেগবান করতে হবে। স্থায়ী, সফল এবং স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তনের উদ্দেশ্যে রোহিঙ্গাদের যৌক্তিক দাবি বিবেচনায় নিতে হবে। 

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও উপ–আঞ্চলিক সংস্থা, যেমন সার্ক, আসিয়ান, বিমসটেক এবং ওআইসিকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে প্রভাবিত করতে হবে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের শান্তি ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে জাতিসংঘের নিশ্চয়তা প্রদানকারীর ভূমিকা পালন নিশ্চিত করতে হবে।

অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলে প্রচার করতে হবে। রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করাতে হবে আন্তর্জাতিক বহুমুখী চাপের দ্বারা। এজন্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ও প্রত্যাবর্তনের পথ খোলা রেখে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে।

শুধু কূটনৈতিক পদক্ষেপ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। প্রয়োজন বাস্তবতার। এত বিশাল জনগোষ্ঠীর ভরণপোষণের ভার বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল ও উন্নয়নশীল দেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য বহন করা যে অসম্ভব তা বিশ্ববাসীকে বোঝাতে হবে। প্রত্যাবর্তনই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র স্থায়ী সমাধান এই নীতি ফলাও করে প্রচার করতে হবে। প্রয়োজনে সংকট নিরসনে চীনের সাথে খোলা মনে আলোচনা করতে হবে।

প্রশান্ত কুমার শীল ।। শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
vprashantcu@gmail.com