ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি দীর্ঘকালীন বিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। দীর্ঘ আলোচনার পরও এই চুক্তি সম্পাদন করা সম্ভব হয়নি, যার প্রধান কারণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসরকার এবং বিশেষ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি গুরুত্ব বহন করছে।

বাংলাদেশ এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে চুক্তির ক্ষেত্রে সমঝোতার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে রাজ্যসরকারের স্বার্থ এবং রাজনৈতিক জটিলতা। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে, তিস্তা চুক্তি কি শুধুই কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে বন্ধুত্বের সংকট, নাকি এই চুক্তির পেছনে রয়েছে গভীর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাত?

তিস্তা নদী ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত অন্যতম একটি অভিন্ন নদী, যা দুই দেশের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে একটি জটিল এবং অমীমাংসিত সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি ভাগাভাগির বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার শুরু হলেও চুক্তিটি চূড়ান্ত করা যায়নি, যার মূল কারণ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতা।

তিস্তার পানির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছে পশ্চিমবঙ্গ, যা উজানে পানির ব্যবহার বাড়িয়েছে এবং বাংলাদেশের জন্য তীব্র সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এই সমস্যার সমাধানে কূটনৈতিক এবং আলোচনা ভিত্তিক পন্থার ওপর জোর দিয়েছেন।

তিনি মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা এই সমস্যাটি শুধু আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব। তার মতে, তিস্তা চুক্তির প্রয়োজনীয়তা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং ভারতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ড. ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই একত্রে বসে সমস্যার সমাধান করতে হবে। যদি আমরা জানি কতটুকু পানি আমরা পেতে যাচ্ছি, তাহলে আমাদের অর্থনীতি এবং কৃষি পরিকল্পনা করতে সহজ হবে।’

তিস্তা চুক্তি : সমস্যার শিকড়

তিস্তা নদী বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পানি সম্পদ। এর প্রবাহ ভারতের সিকিম এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা তিস্তার পানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।

তবে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে নদীর পানি বণ্টন এবং ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে পানির অভাব দেখা দেয়, যা বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৭২ সাল থেকেই বিভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তবে তিস্তার পানির বণ্টন চুক্তি এখনো অমীমাংসিত রয়েছে।

এই চুক্তির মূল সমস্যা হলো দুই দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, রাজনৈতিক স্বার্থ এবং পানির চাহিদা, যা দুই দেশের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অবস্থান তিস্তা চুক্তির পথে প্রধান বাধা হিসেবে দেখা দেয়।

২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সময় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই চুক্তিকে অনুমোদন দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং দাবি করেন যে পশ্চিমবঙ্গে পানির সংকট রয়েছে। সেই থেকে তিস্তা চুক্তি আর আলোর মুখ দেখেনি।

তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জলসম্পদ সমস্যা। তিস্তা নদীর পানি বাংলাদেশের উত্তরের কয়েকটি জেলার কৃষি ও অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। তবে শুষ্ক মৌসুমে উজানে ভারতের পানি উত্তোলন এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে পানিবণ্টনের বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশের উত্তরের জেলাগুলোয় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে।

এটি শুধু একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাতেও প্রভাব ফেলছে। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সময় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই চুক্তিকে অনুমোদন দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং দাবি করেন যে পশ্চিমবঙ্গে পানির সংকট রয়েছে। সেই থেকে তিস্তা চুক্তি আর আলোর মুখ দেখেনি।

আন্তর্জাতিক আইন ও বাংলাদেশের দাবি

তিস্তা নদী শুধু একটি অভিন্ন নদীই নয়, এটি দুই দেশের সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। অভিন্ন নদী হিসেবে তিস্তার পানি ভাগাভাগির বিষয়ে কোনো চুক্তি না থাকায় উজানে ভারতের কার্যক্রম বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক নদীর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পানিবণ্টন হওয়া উচিত, যেখানে উজানের দেশ উজানের পাশাপাশি ভাটির দেশেরও অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তিস্তা চুক্তি নিয়ে মতপার্থক্য দূর করার জন্য ভারতের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত এই সমস্যাটি দুই দেশেরই জন্য ক্ষতিকর। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, বিষয়টির সমাধান হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পানিবণ্টন করতে হবে, যেখানে বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশগুলোর অধিকার রক্ষা পাবে।

মমতার ভূমিকা ও পশ্চিমবঙ্গের সংকট

২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে চুক্তিটি শেষ মুহূর্তে ভেস্তে যায়। তার প্রধান উদ্বেগ ছিল পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের কৃষি এবং সেচ ব্যবস্থা। তার মতে, যদি চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে বেশি পরিমাণ পানি সরবরাহ করা হয়, তবে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হতে পারে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অবস্থানকে শুধু আঞ্চলিক স্বার্থের দিকে নজর দেওয়ার মতো বলে বিবেচনা করা হয় না, বরং এটি ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তার রাজনৈতিক সম্পর্কেরও একটি প্রকাশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বিভিন্ন জাতীয় প্রকল্প এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির বিরোধিতা করেছেন, যাতে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার নেতৃত্বকে দৃঢ় করা যায়।

তিস্তা চুক্তি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা একটি সমস্যা, যা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য বড় ইস্যু। তিস্তা চুক্তি বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে...

তার এ ধরনের অবস্থান তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে একটি অভ্যন্তরীণ বিরোধের জন্ম দিয়েছে, যা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

সমালোচকরা মনে করেন, মমতা এই চুক্তিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেন এবং পশ্চিমবঙ্গের জনগণের স্বার্থ রক্ষার নামে বাংলাদেশকে চুক্তি থেকে বঞ্চিত করছেন। তবে পশ্চিমবঙ্গের এই অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব গভীরতর হচ্ছে এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন আরও বাড়ছে।

সমাধানের পথ : আলোচনা ও সহযোগিতা

তিস্তা চুক্তির সমাধানে কূটনৈতিক আলোচনার প্রয়োজন, যা উভয় দেশের জন্যই সমানভাবে লাভজনক হতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তা ইস্যুতে সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে, যেখানে উভয় দেশই তাদের স্বার্থ বজায় রাখার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার এই সমস্যার সমাধানে আগ্রহী এবং ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা চালানোর পরিকল্পনা করছে। এই আলোচনায় মূল বিষয় হলো, উজানে তিস্তার পানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা এবং ভাটির দেশ বাংলাদেশের জন্য ন্যায্য ভাগ নিশ্চিত করা।

তিস্তা চুক্তির মতো সমস্যাগুলো আন্তর্জাতিক আইনের আলোকে সমাধান করা গুরুত্বপূর্ণ। অভিন্ন নদীর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পানির ন্যায্য ভাগ নিশ্চিত করা জরুরি। এই সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আরও সম্পর্কের জটিলতা তৈরি হতে পারে, যা দুই দেশের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে।

তিস্তা চুক্তি দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা একটি সমস্যা, যা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য বড় ইস্যু। তিস্তা চুক্তি বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে, যেখানে উভয় দেশই তাদের স্বার্থ বজায় রাখার পাশাপাশি কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে অগ্রসর হতে পারে।

তিস্তার পানিবণ্টনের সমাধান না হলে এই সমস্যা দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে আরও জটিলতা তৈরি করবে। তবে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আগ্রহ এবং ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধানের সম্ভাবনা রয়েছে।

অধ্যাপক ড. সুজিত কুমার দত্ত ।। সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়