বন্যা-পরবর্তী স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় করণীয় কী?
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য খাতে একদিকে স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরসহ স্বাস্থ্য প্রশাসনে চরম অচলাবস্থা চলছে। অন্যদিকে, বন্যাদুর্গত এলাকায় পানি কমতে থাকায় বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
তাছাড়া স্বাস্থ্য খাতের পাঁচ বছর মেয়াদি পঞ্চম উন্নয়ন কর্মসূচি সময়মতো অনুমোদিত না হওয়ায় টিকাদান কর্মসূচি, জলাতঙ্কসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগের বিস্তার রোধ, অসংক্রামক রোগের ওষুধ সরবরাহ, যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা সামগ্রীর সরবরাহ এবং পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রীর নিয়মিত জোগানও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। সুতরাং, এই অচলাবস্থা নিরসন এবং এসব ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য দ্রুত এবং কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য প্রশাসনে অচলাবস্থা মূলত স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরে সদ্য পদায়িত মহা পরিচালককে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সংকট। মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই অধিদপ্তরে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। তাছাড়া রয়েছে এই অধিদপ্তরে দুইজন অতিরিক্ত-মহা পরিচালককে অন্যত্র বদলি ও ডাইরেক্টর এবং লাইন ডাইরেক্টরদের অন্যত্র বদলি ভীতিসহ নানা টেনশন।
এই টেনশন শুধু স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিদপ্তর, বিশেষায়িত হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও বিদ্যমান। আরও চলছে দীর্ঘকাল ব্যাপী বৈষম্যের শিকার এবং প্রমোশন ও পদ বঞ্চিতদের আন্দোলন-সংগ্রাম।
তাছাড়া, হোমিওপ্যাথিক, আয়ুর্বেদিক এবং ইউনানি স্নাতকদের ডাক্তার হিসেবে স্বীকৃতি পেতে এবং স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন সহায়ক জনবল তৈরির প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন করতেও দেখা গেছে।
আরও পড়ুন
এই অচলাবস্থা নিরসনের জন্য একটি কার্যকরী সমাধান হতে পারে সার্চ কমিটি গঠন করা। এই সার্চ কমিটি স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় নেতৃত্ব বাছাইয়ের প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং যথাযথ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সার্চ কমিটি একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট রুলস অনুসরণ করে সততা, যোগ্যতা, দক্ষতা এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন তালিকা প্রণয়ন করবে।
এক্ষেত্রে এইসব পদে অধিষ্ঠিত হতে ইচ্ছুকদের নিকট থেকে শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতাসহ সংক্ষিপ্ত 'কারিকুলাম ভিটে' চাওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি তিনি কেন এ পদে নিয়োগ পেতে চান এবং নিয়োগ পেলে তিনি মেয়াদকালে স্বাস্থ্য খাতের কী উন্নয়ন সাধন করবেন সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ চাওয়া যেতে পারে।
আমাদের দেশের বর্তমান স্বাস্থ্য অর্থায়ন পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ যেকোনো জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য সহজে খরচ যোগ্য কোনো তহবিল নেই।
এই তালিকা থেকে সরকার সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে বেছে নেবে, যা স্বাস্থ্য খাতের অচলাবস্থা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই ক্ষেত্রে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন পদে যারা আসীন হবেন তাদের কাজে যোগদানের পূর্বে নিজেদের, পরিবারের সদস্যদের এবং তাদের স্বজন ও নিকট আত্মীয়দের সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করতে হবে।
বন্যাদুর্গত এলাকায় পানি কমতে থাকায় ডায়রিয়া/কলেরা, পেটের পীড়া, চুলকানি ও ঘাসহ নানা ধরনের চর্ম রোগ এবং বাচ্চাদের শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। আবার সাপসহ বিষাক্ত পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়েছে। এসব সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন প্রচুর রোগী বন্যাদুর্গত এলাকার উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স এবং জেলা হাসপাতালে ভিড় করছে।
এসব রোগীর চিকিৎসা প্রদান, দুর্গত এলাকায় স্বাস্থ্য ক্যাম্প আয়োজন এবং ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভবতী মায়েদের সেবা প্রদানসহ সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় মাঠ প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশেষ করে সাপের কামড়ের নিরাময়ের অ্যান্টি-ভেনম এবং অন্যান্য রোগের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এটি মূলত আমাদের প্রচলিত স্বাস্থ্য অর্থায়ন পদ্ধতির দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ।
আরও পড়ুন
একদিকে, আমাদের দেশের বর্তমান স্বাস্থ্য অর্থায়ন পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ যেকোনো জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য সহজে খরচ যোগ্য কোনো তহবিল নেই। অন্যদিকে, জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং অগাস্টের পাঁচ তারিখের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের বেশিরভাগ হাসপাতাল ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ক্রয় করার জন্য 'বাৎসরিক ক্রয় পরিকল্পনা' অনুমোদনের সুযোগ পায়নি।
ফলে প্রচলিত অর্থায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ক্রয় করার নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করাও অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হচ্ছে না। আবার, 'এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানির' নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা কিংবা দরপত্রের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে বাজার থেকে ওষুধের জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
প্রচলিত অর্থায়ন পদ্ধতিতে দেশের 'পাবলিক-ফিন্যানশিয়াল ম্যানেজমেন্ট রুলস' অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতে সরকারি অর্থ খরচের যে বিধান রয়েছে তা মেনে বন্যাদুর্গত এলাকার স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জামাদির জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
...বারবার না হাতড়িয়ে, যেকোনো দুর্যোগে দুর্গত জনগণের জরুরি স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের জন্য 'জরুরি স্বাস্থ্য সেবা তহবিল' নামে একটি জাতীয় তহবিল গঠন করা আবশ্যক।
এই ক্ষেত্রে প্রত্যেক বন্যাদুর্গত এলাকায় স্থানীয় পর্যায়ে একটি আপৎকালীন জরুরি তহবিল গঠন করা অপরিহার্য। এই তহবিলে সরকার জরুরি ভিত্তিতে কিছু থোক বরাদ্দ দিতে পারে। আবার স্থানীয়ভাবেও বিভিন্ন মানব হিতৈষী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ জোগাড় করা যেতে পারে।
কিন্তু, বারবার না হাতড়িয়ে, যেকোনো দুর্যোগে দুর্গত জনগণের জরুরি স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতের জন্য 'জরুরি স্বাস্থ্য সেবা তহবিল' নামে একটি জাতীয় তহবিল গঠন করা আবশ্যক। এই তহবিলেও নিয়মিত ভিত্তিতে সরকারি 'থোক বরাদ্দ' ব্যবস্থা চালুর পাশাপাশি মানব হিতৈষী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান, প্রবাসী এবং উন্নয়ন অংশীজনদের নিকট থেকে অর্থ জোগাড় করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, ২০২৪-২৫ সালের বাজেটে জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য দুই হাজার কোটি টাকার একটি থোক বরাদ্দের ঘোষণা ছিল। এই ঘোষণা কার্যকর করার মাধ্যমে এই তহবিল গঠনের সূচনা হতে পারে। তবে, এ তহবিল সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য 'জরুরি স্বাস্থ্য সেবা তহবিল ব্যবস্থাপনা অথরিটি' নামে একটি শক্তিশালী স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠন করা অনিবার্য।
অন্যদিকে, অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা স্বাস্থ্য খাতের 'পাঁচ বছর মেয়াদি উন্নয়ন কর্মসূচি'র বর্তমান ধরন এবং কাঠামো নিয়েও ভাববার সময় এসেছে। এ ক্ষেত্রে একটি জোরালো মত হচ্ছে বর্তমান প্রেক্ষাপটে 'অপারেশনাল প্ল্যান' ভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচি'র কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা এ ক্ষেত্রে ডুপ্লিকেশনসহ অর্থ খরচের ক্ষেত্রে নানা অপচয়ের অভিযোগ আছে।
তাই চাহিদা নিরূপণের মাধ্যমে অতি প্রয়োজনীয় সেবা চালুর রাখার জন্য আপৎকালীন ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় অর্থ অনুমোদনের পাশাপাশি 'পাঁচ বছর মেয়াদি উন্নয়ন কর্মসূচি' রিভিউ করার জন্য একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক