বছরখানেক আগে তৎকালীন বিরোধী দলের এক প্রবীণ নেতা আমাকে দুঃখ করে বললেন, ‘আর রাজনীতি করা যাবে না।’ জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? উনি বললেন, ‘এখন রাজনীতি করলেই লোকে চোর ভাবে।’ এই কথায় দুঃখ পেয়েছিলাম, কিন্তু যারা রাজনীতিবিদদের চোর বলেন, তাদের দোষারোপ করতে পারিনি। সব বাঘ মানুষ খায় না, কিন্তু বাঘ দেখলে আমরা সবাই ভয় পাই।

এই কথোপকথনের পর দেশে সরকারের পতন হয়েছে। পরিবর্তিত হয়েছে অনেক সমীকরণও। তরুণরা দেখিয়েছে বিজয়ের রাস্তা। যবনিকা পড়েছে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির উপাখ্যানেরও। প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে দুর্নীতির নানা ঘটনা।

এখন কথা হলো, ১৫ বছর আমরা কেন চুপ ছিলাম? নাকি চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম? কোথায় ছিল রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম? কেন মূল সারির গণমাধ্যম বাদ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠেছিল বিপ্লবের হাতিয়ার? সেই আলোচনা না হয় অন্যদিন করা যাবে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মতিউরের ছাগলকাণ্ডের মতো পুকুর চুরির ঘটনা আমাদের জানিয়ে দেয় ভিন্ন বার্তা।

গণমাধ্যমকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। জনগণ প্রত্যাশা করে সমাজের যত অনিয়ম, দুর্নীতির খবর গণমাধ্যম প্রকাশ করবে নিঃসংকোচে। এখন প্রশ্ন হলো, গণমাধ্যম কি সবধরনের দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে? উত্তর হয়তো আপনারাই ভালো দিতে পারবেন।

অতীতে আমরা দেখেছি গণমাধ্যমে দুর্নীতির খবর প্রকাশে ছিল তীব্র লুকোচুরির খেলা, সেটা সেলফ সেন্সরশিপ হোক কিংবা স্তুতি সাংবাদিকতা দিয়ে জনগণকে মোহে আচ্ছন্ন করা হোক, আবার সাংবাদিকদের চাকরি কেড়ে নেওয়ার ভয় দেখানোর নির্মম পদ্ধতিই হোক, সব জায়গার রসায়ন কিন্তু ছিল একটাই।

সরকারের পতন হয়েছে। পরিবর্তিত হয়েছে অনেক সমীকরণও। তরুণরা দেখিয়েছে বিজয়ের রাস্তা। যবনিকা পড়েছে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির উপাখ্যানেরও। প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে দুর্নীতির নানা ঘটনা।

তাহলে আমরা কীসের নিরিখে বলতাম গণমাধ্যম স্বাধীন? যেখানে মালিকপক্ষের স্বার্থ ও ব্যবসার লগ্নি কষে সংবাদ পরিবেশন করা লাগতো। তার ওপরে রয়েছে রাষ্ট্রের ডিজিটাল ও সাইবার সিকিউরিটি আইন দিয়ে প্রভাবশালীদের হয়রানি করার অপকৌশল।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকরা ছিল বেশি অভিযুক্ত। অভিযুক্তের মধ্যে ৩২ শতাংশের বেশি রাজনীতিবিদ, ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ ছিল সাংবাদিক। সাংবাদিকেরা প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছে। ঢাকার বাইরের সাংবাদিকেরা বেশি অভিযুক্ত। [প্রথম আলো, ৩০ এপ্রিল ২০২৪]

প্রশ্ন হলো, সরকারের বিপরীতে গিয়ে এভাবে কাজ কি করা যায়? বা করা গেলেও তা আসলে কতক্ষণ? প্রতিনিয়ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার ভয় তাড়া করেছে দেশের গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের। এই অবস্থায় গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন? আর গণমাধ্যমকর্মীরা কতটা উদার হয়ে দুর্নীতির খবর প্রচার করতে পেরেছে?

এই বাস্তবতায় কীভাবে আমরা প্রত্যাশা পারি গণমাধ্যম সত্যি কথা প্রকাশ করবে? গণমাধ্যমের মুখ চেপে ধরার চেষ্টা হয়েছে যুগের পর যুগ। এত প্রতিকূলতার পরও গণমাধ্যম যে একেবারে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে না এমনটি কিন্তু নয়। প্রকাশের ভঙ্গিতে পার্থক্য থাকলেও আংশিক মৌলিক বিষয় কিন্তু বজায় রাখতে সংগ্রাম করছে বারংবার।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় কার্যালয় থেকে প্রশাসনিক রাষ্ট্র কাঠামোতে ছিল চরম দুর্নীতির চারণক্ষেত্র। দলের নমিনেশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে রদবদল কিংবা উপরি সুবিধা পাইয়ে দিতে ঘুষ বা উৎকোচ ছিল ট্রেন্ড।

দুর্নীতির উত্তম চাষাবাদ করে সামাজিক পরিসরে একে করা হয়েছিল তুমুল জনপ্রিয়। মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল দুর্নীতির ভাইরাস। মানুষ ভুলেই গিয়েছিল দুর্নীতি ছাড়া সমাজে কোনো কাজ হয়। সেটা হোক মন্ত্রণালয়ের কোনো বড় প্রকল্প কিংবা ছোটখাটো কোনো কারণিক কাজ। সর্ব কার্যসিদ্ধিতে ঘুষ আবশ্যক। এটি ছিল প্রথা।

সমাজের মধ্যে প্রচলিত মিথ সৃষ্টি করে প্রচার হয়েছিল ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই করা যাবে না সহজে। সিপিডি’র তথ্য বলছে, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৪টি খাতে ব্যাংক থেকে লুট করেছে প্রায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। আবার গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)-এর তথ্য বলছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সেই হিসাবে ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকা।

শাসক পক্ষ সবসময় চাইতো ভয় দিয়ে সমাজকে নিজেদের আয়ত্তে রাখতে। তাইতো সমাজের ছোটখাটো অনেক দুর্নীতির খবর উপেক্ষিত ছিল মূলধারায়। যা একটু দুর্নীতির খবর প্রকাশ পেত তা আসলে চাপে পড়ে প্রকাশ হতো।

বিগত বছরগুলোয় ঘুষ ছাড়া সরকারি অফিসে কয়টি 'সেবা' নিতে পেরেছেন? আমার বিশ্বাস একটিও না। পুলিশ ঘুষ খায় কিংবা ভূমি অফিসে ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না এই এজেন্ডা কারা তৈরি করলো? সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেবা গ্রহীতার কাছ থেকে 'সেবা' দেওয়ার সময় সগৌরবে ঘুষ নিতো, যার আরেক নাম 'স্পীড মানি'।

মানুষ ভুলেই গিয়েছিল দুর্নীতি ছাড়া সমাজে কোনো কাজ হয়। সেটা হোক মন্ত্রণালয়ের কোনো বড় প্রকল্প কিংবা ছোটখাটো কোনো কারণিক কাজ। সর্ব কার্যসিদ্ধিতে ঘুষ আবশ্যক।

এসব অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ছিল নীরব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেও ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত আর বিচারব্যবস্থা ছিল রাষ্ট্রের তালুতে ফলে দুর্নীতির খবর যে সবাই জানবে তার আশাও ছিল কম।

দুর্নীতির দায়ে সরকার দলীয় মন্ত্রী-এমপি, ঋণ খেলাপি, প্রতারক, মানি লন্ডারিংয়ে অভিযুক্তদের ধরার খবর গণমাধ্যমে আসলে আমাদের ভালো লাগে কিংবা খুশি লাগে। কিন্তু এ খুশি বা আনন্দ কতক্ষণ থাকে এটি এখন দেখার বিষয়। তারা ঠিকই আইনের ফাঁক দিয়ে আবার বেরিয়ে আসে। কৌশলে সবকিছু ম্যানেজ করে নেয়।

সাংবাদিকতার একাডেমিক পরিসরের জায়গা থেকে আলোচনা করলে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, বর্তমান সময়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করার কম প্রবণতা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা আর অনুসন্ধানে যেতে আগ্রহী নয়। বাজার সাংবাদিকতার নামে কপি পেস্টের রাজত্বের প্রসার। দুর্নীতির খবর তুলে আনতে যে পরিমাণ শ্রম, মেধা ও সময়ের প্রয়োজন তা আমরা দিতে রাজি না।

তার সাথে রয়েছে দূরদর্শিতা ও পর্যবেক্ষণের অভাব। একটি নিগূঢ় প্রতিবেদন তৈরি করতে যে পরিমাণ গবেষণা দরকার তাও আমরা দিতে রাজি না। তাহলে ভালো প্রতিবেদন আসবে কীভাবে? মানছি আমাদের অনেক বাঁধা আছে। আমরা কি পারি না এসব পাশে রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে।

এরপরও এগিয়ে যেতে হবে। দুর্নীতির খবর প্রচার করতে হবে। এখন যে রাতারাতি সমাজ থেকে দুর্নীতি ও ঘুষ একেবারে উঠে যাবে এমনটি নয়। এরপরও এখন দুর্নীতির খবর জানছি, আওয়ামী লীগের বড় বড় দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপিদের খবর জানছি। এদের যদি কঠিন শাস্তি দেওয়া না হয় তবে এই সমাজ থেকে দুর্নীতি বন্ধ হবে না। তবে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে যে কিছুটা পরিবর্তন আসবে এটি সুনিশ্চিত।

প্রশান্ত কুমার শীল ।। শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

vprashantcu@gmail.com