বন্যার অর্থনৈতিক সংকট ও চ্যালেঞ্জসমূহ
প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেকোনো দেশ বা সমাজের জন্য ভয়াবহ ও ক্ষতিকর। এ দুর্যোগ মানুষের জীবন ও অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ভৌগোলিক অবস্থান, ভূতাত্ত্বিক গঠন ও জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই কমবেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। এর মধ্যে বন্যা অন্যতম। পৃথিবীর মোট ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩.৫ শতাংশ বন্যাপ্রবণ এলাকা। অন্যদিকে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৬.৫ শতাংশ মানুষ বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে বসবাস করে। অতীতে বন্যা বাংলাদেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে বিশেষ করে ১৯৬৬, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৮, ২০১৭ ও ২০২২ সালে।
বিজ্ঞাপন
২০২৪ সালের আগস্ট মাসে অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে দেশের পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এতে দশ লক্ষাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ও ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা ৫৬ লাখের বেশি। একে অনেক বিশেষজ্ঞ স্মরণকালের ধ্বংসাত্মক বন্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বন্যার কারণে খেতের ফসল, ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, গাছপালা, মাছের খামার, শিল্প-কারখানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে—দেশের নারী, শিশু, বয়োবৃদ্ধ এবং প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী।
গ্রান্থাম রিসার্চ ইন্সটিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট এবং সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্স প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বন্যায় প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ জলমগ্ন হয় এবং ১ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ক্ষতি হয়। উদাহরণস্বরূপ ২০২২ সালের বন্যায় ১ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে এবং ৭.৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
এমনিতেই বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সন্তোষজনক পর্যায়ে নেই, তার ওপর চলতি বন্যার কারণে খাদ্য নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এ বন্যায় ২ লাখ ৯১ হাজার ৩৩ হেক্টর শুধুমাত্র ধানি জমিই আক্রান্ত হয়েছে। ১৯,৬৮০ হেক্টর জমিতে আমনের বীজতলা তৈরি করা ছিল, যা পুরোপুরি আক্রান্ত হয়েছে।
গত মৌসুমের জাতীয় গড় (বিবিএসের গত মৌসুমের উৎপাদন গড়) ধরে হিসাব করলেও এই পরিমাণ জমিতে অন্তত ৮৪১,২৩৪ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হওয়ার কথা রয়েছে। কৃষি বিভাগ বলছে, ১২টি জেলার যেসব ধানি জমি আক্রান্ত হয়েছে সেগুলোয় ধানের উৎপাদন পুরোপুরিই ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
তালিকায় ধানের পরেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শাকসবজির উৎপাদন। আদা, হলুদ, মরিচ, ফলবাগান, তরমুজ, পেঁপে, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ ও টমেটো, পান, আখসহ এবারের বন্যায় ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৩৮২ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে, যেগুলো একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো মজুদ খাদ্যশস্য, খেতের ফসল, গৃহপালিত হাঁস-মুরগি, মাছের খামার হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। দেশের ১২ জেলায় চলমান বন্যায় গবাদিপশু, হাস-মুরগি, পশুখাদ্য এবং মাছ ও মাছের পোনা, অবকাঠামোসহ এই খাতে এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে বলে জানান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই কমবেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। এর মধ্যে বন্যা অন্যতম। পৃথিবীর মোট ভৌগোলিক অঞ্চলের ৩.৫ শতাংশ বন্যাপ্রবণ এলাকা।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় জেলার ছয়টি উপজেলায় শুধুমাত্র কৃষিতেই ক্ষতি হয়েছে ৪৫১ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। এতে প্রায় দুই লক্ষাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় জেলার ৩০ হাজার ৩৫২ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মোট ফসলি জমির ৭৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। তারমধ্যে ১ হাজার ৮৬৫ হেক্টর আমন বীজতলা, ২৬ হাজার হেক্টর আমন, ১ হাজার ৮৫৪ হেক্টর আউশ, আবাদকৃত ৫২৫ হেক্টর শরৎকালীন সবজির পুরো অংশ, ৬৯ হেক্টর ফলবাগান, ৭ হেক্টর আদা, ১৬ হেক্টর হলুদ এবং ১৬ হেক্টর আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অতি দরিদ্ররা, সর্বহারা দরিদ্ররা তালিকাভুক্ত হবে। ২০০৭ সালের সিডর ঘূর্ণিঝড় এবং ২০০৯ সালের আইলা ঘূর্ণিঝড়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে। এতে দারিদ্র্যের হার হ্রাসে বর্তমানের নিম্নগতির ধারা আরও নিম্নমুখী হবে।
উল্লেখ্য, সরকারি তথ্যানুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর দারিদ্র্যের হার ১ দশমিক ৭ শতাংশ কমলেও ২০১০ থেকে ২০১৬ সময়কালে তা কমেছে ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে (সূত্র : বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রণীত হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে-২০১০, ২০১৬)। অর্থাৎ দারিদ্র্য হ্রাসের গতি নিম্নমুখী। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নিম্নবিত্তরা প্রয়োজনীয় সরকারি সাহায্য না পেলে সব হারিয়ে দরিদ্রদের কাতারে এসে দাঁড়াবে, যা দরিদ্রতা হ্রাসে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
আরও পড়ুন
বন্যায় দেশের পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ অঞ্চল ডুবে গিয়েছে ফলে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ কাঁচা-পাকা মিলে ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে গণমাধ্যমের সংবাদে জানানো হয়েছে। রেল যোগাযোগ বিঘ্নসহ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোনো কোনো অংশে পানি ওঠায় গাড়ি চলাচলও ব্যাহত হচ্ছে।
পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়ি থেকে শুরু করে মৌলভীবাজার পর্যন্ত জনজীবন বিপন্ন, পর্যুদস্ত। দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু চট্টগ্রাম বন্দর। পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে কমলাপুর আইসিডিগামী কন্টেইনারের স্তূপ জমেছে। পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে কন্টেইনার জটের সম্ভাবনা রয়েছে।
মহাসড়ক বিপর্যস্ত হওয়ায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আমদানি-রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের চলাচল কমে গেছে। এতে বাজারে আমদানি করা পণ্যের সংকট দেখা দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামতে চলতি অর্থবছরের পরিবহন ও যোগাযোগ খাতের বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।
এমনিতেই মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে অর্থনীতি, বন্যা যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। দুর্যোগকে সামনে রেখে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করে। বন্যা মোকাবিলার পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণেও কঠোর নজরদারি এক বড় চ্যালেঞ্জ।
২০২৪ সালে দুইবার বন্যায় সিলেট পর্যটন শিল্পে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ক্ষতি সামলাতে না পেরে অনেকেই এখন হোটেল বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবছেন এবং কর্মীদের ছাঁটাইও করছেন অনেকে জানিয়েছেন সিলেট হোটেল মোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি। করোনার দীর্ঘ মন্দা কাটিয়ে এই খাত যেই একটু ঘরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল তখনই বন্যার ধাক্কা শুরু হলো।
এছাড়া বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুনঃনির্মাণ ও মেরামত, চলতি অর্থবছরে শিক্ষা খাতের উন্নয়নমূলক বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে।
পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায়, সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়েছে। সরবরাহ কম থাকায় প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। চট্টগ্রামে এক কেজি কাঁচামরিচের দাম হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। চিড়া, মুড়ি, বিস্কুট বা শুকনো খাবারের সংকটের পাশাপাশি দামও বেড়েছে।
এমনিতেই মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে অর্থনীতি, বন্যা যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। দুর্যোগকে সামনে রেখে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করে। বন্যা মোকাবিলার পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণেও কঠোর নজরদারি এক বড় চ্যালেঞ্জ। বন্যার কারণে দেশের অর্থনীতিতে এই ধরনের বিরূপ প্রভাব জনগণের উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
বন্যার কারণে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, জ্বর, সর্দি, কাশি এবং চর্মরোগ দেখা দেয়। বন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে এবং পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ে। যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের বিঘ্নতা স্বাস্থ্য অর্থনীতিতে নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।
সাম্প্রতিককালের বন্যা সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বন্যা বেশিদিন দীর্ঘায়িত হলে মানুষের সুস্থতা ও সমৃদ্ধির ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। প্রত্যাশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সংস্থাগুলো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং সুন্দর, সমৃদ্ধির বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।
রুনা সাহা ।। সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়