ছবি : সংগৃহীত

বিপুল পরিমাণ ছাত্র-জনতার তাজাপ্রাণের বিনিময়ে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যাত্রা শুরু করে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ছাত্ররা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা সরকার বিদায় নেন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেন, তখন সাধারণ মানুষ আশায় বুক বেঁধেছেন—এই সরকার নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেবে।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট ও অধিক মুনাফা করে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে খেলেও সরকারের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া ছাড়া কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। আয়ের পুরোটাই চলে যেত পরিবারের ৩ বেলার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

মাস শেষে বেতনের টাকায় পুরো মাস চালানো অনেক কঠিন হয়ে পড়েছিল। প্রতি মাসেই ধারদেনা করেই সংসারের অন্যান্য খরচ চালাতে হয়েছে। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম মৃত্যুকে পরোয়া না করে গণবিপ্লব ঘটিয়ে স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছে।

তাই এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা হলো ছাত্র-জনতা যেভাবে শেখ হাসিনার দুঃশাসনের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করেছে ঠিক একইভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার অতিদ্রুত নিত্যপণ্যের বাজারে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও কারসাজি বন্ধ করে পণ্যমূল্য সহনীয় মাত্রায় নিয়ে এসে মানুষকে স্বস্তি দেবে।

শেখ হাসিনার সরকার টানা তিন মেয়াদেরও বেশি ক্ষমতায় ছিল। প্রতিবারই আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে নিত্যপণ্য মূল্য কমিয়ে রেখে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার নানা প্রতিশ্রুতি ছিল। সবশেষ দায়িত্ব গ্রহণের সময়ও সরকারের অগ্রাধিকার কাজের মধ্যে নিত্যপণ্য মূল্য সহনীয় রাখার নানা প্রতিশ্রুতি ও নির্দেশনা ছিল।

বিশেষ করে দেশের মানুষকে ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়ানো, ঘরে ঘরে চাকরির ব্যবস্থা করা, কৃষকদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতসহ নানা প্রতিশ্রুতি। কিন্তু ক্ষমতা আরোহণের পরেই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। সরকার হয়ে যায় ব্যবসায়ীবান্ধব, এমনকি জাতীয় সংসদের সিংহভাগ সদস্যই ব্যবসায়ী মনোনয়ন দিয়েছিলেন।

সিটি করপোরেশনের মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, বিভিন্ন পর্যায়ে দলীয় নেতা নির্বাচনেও ব্যবসায়ীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। ফলে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর রক্ষা করতে পারেনি। সর্বস্তরের ব্যবসায়ীরা লুটপাট বাণিজ্য করে তাদের মতো করে চেটেপুটে খেয়ে বিদেশে টাকা পাচার ও ব্যাংক লুটে ব্যস্ত সময় পার করেছিলেন।

ব্যবসায়ীরা যখন এভাবে লুটপাট ও সিন্ডিকেট বাণিজ্য করে অস্বাভাবিকভাবে অধিক মুনাফা করে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেশের মানুষের জীবন জীবিকায় অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, তখন আওয়ামী লীগ সরকার নীরব থেকে ব্যবসায়ীদের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। পণ্যমূল্য কমানোর কথা বলে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার পরিবর্তে বারবার কৃত্রিম সংকটকে উসকে দেওয়ার মতো ঘটনাগুলো এবং মানুষের মতামত ও দুঃখ কষ্টকে কোনোভাবে আমলে না নিয়ে সবসময় জনমতকে উপেক্ষা ও অস্বীকার করার পাশাপাশি দমন পীড়ন দিয়ে ভিন্নমতকে দমাতে ব্যস্ত ছিলেন।

বাজার বিশ্লেষকরা যখন বলতেন, মানুষ কষ্টে আছেন ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, সরকার সঙ্গে সঙ্গে এগুলো অস্বীকার করতেন এবং ব্যবসায়ীদের সুরে কথা বলতেন। তাই ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশকে যেন অধিক মুনাফার স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে সবগুলো নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করেছেন।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সুবিধাবাদী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট ও অধিক মুনাফা করে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে খেলেও সরকারের পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া ছাড়া কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

একটা সময় বড় বড় ব্যবসায়ী ও করপোরেট গ্রুপরা অধিক মুনাফা, সিন্ডিকেট ও কারসাজির সাথে জড়িত থাকলেও এখন পাড়া মহল্লার দোকান ও ভ্যানগুলোও এসব কারসাজিতে জড়িয়ে পড়েছে। ফলে পুরো দেশটাই যেন একটা লুটপাটের হাটে পরিণত হয়েছে।

আর বিগত সরকার উন্নয়নের কল্পকাহিনি ও অস্বীকারের পন্থা বেছে নিয়ে মানুষ মুখ বন্ধ রেখেছিল। যার কারণেই একটানা তিন মেয়াদের বেশি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও শেষ মেয়াদের পাঁচ বছর এবং চতুর্থ মেয়াদের ছয় মাসের মধ্যে দেশে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি।

বলা যায়, এই সময়ে নিত্যপণ্যের বাজার ছিল দেশের মানুষের কাছে আতঙ্কের বিষয়। এই সময়ে চাল, ডাল, তেল, মাছ, মাংস, সবজি, আলু-পেঁয়াজের মতো খাদ্যপণ্যের দাম যেমন তিন থেকে দশগুণ পর্যন্ত বেড়েছে, তেমনি খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবার দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ফলে মানুষের আয়ের সিংহভাগ অর্থই চলে যাচ্ছে খাদ্যের জোগান দিতে। ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে পড়ে দায়দেনা নির্ভর।

বিগত সরকার সবসময় নিজেদের ব্যবসায়ীবান্ধব হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। যার কারণে সরকারের চতুর্থ মেয়াদে ব্যবসায়ীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা বেপরোয়া ও সাহসী হয়ে ওঠে। যেহেতু ব্যবসায়ীরা সরকারের অংশীদার হয়ে মন্ত্রী, এমপি, মেয়র ও ক্ষমতাসীন দলে ক্ষমতার ভাগ বসান, তখন সরকার ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আইনের কোনো প্রয়োগ করতে পারেনি।

তারা দেশের আইনের কোনো তোয়াক্কা করেননি। ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে কারসাজির জন্য ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এই ১৫ বছরে এভাবে কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে না হওয়ায়, ব্যবসায়ীরাও সরকারকে কোনোভাবে সমীহ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। ফলে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো পণ্যমূল্য বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের পকেট কাটলেও সরকারি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও নীরব ছিলেন।

এই সুযোগে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট করা, সরকারি প্রণোদনা, ভর্তুকি, করহ্রাসসহ নানা সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে। তেল, চাল, ডিম, গমসহ অনেক পণ্য হাতেগোনা কয়েকটি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। তারা পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করেই বাজারে কৃত্রিমভাবে মূল্য বৃদ্ধি করেন।

সিন্ডিকেট বলতে আমরা সবাই বুঝি, একটি বিশেষ পণ্যের উৎপাদক বা সরবরাহকারীদের অনানুষ্ঠানিক সংঘ, যারা একত্রিত হয়ে বাজারে পণ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে তাদের সর্বময় ক্ষমতা প্রয়োগ করে এক বা একাধিক পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেন। ব্যবসায়ীরা বারবার বাজার অর্থনীতির কথা বলে সরকারকে বিভ্রান্ত করেছে।

বাজার অর্থনীতির মূল মন্ত্র হচ্ছে, সরকার ব্যবসা বাণিজ্য করবে না, বেসরকারি খাত ব্যবসা করবে। আর জোগান ও চাহিদার ভিত্তিতে বাজারের মূল্য নির্ধারিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এ তত্ত্বটি কাজ করছে না। কারণ এখানে ব্যবসায়ীরা সরবরাহ সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতির সঙ্গাটি কার্যকর করতে দেয় না।

বিগত সময়ে দেখা গেছে, দেশের বড় বড় করপোরেট হাউজগুলো সরকারের বড় অর্থ জোগানদাতা। আর এই করপোরেট হাউজগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণ করতো মন্ত্রী, আমলা ও সরকারদলীয় নেতারা। এই চক্রটি এখন নিজেরাই বাঁচার জন্য গা ঢাকা দিয়েছেন অথবা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

যদিও রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তনের সাথে সাথে আরেকটি চক্র মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এসময়টায় চক্রটির মুখোশ উন্মোচন ও সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে না পারলে তারাও আবার একই প্রক্রিয়ায় কারসাজি করে জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাবে।

সব ধরনের নিত্যপণ্যের দামই আকাশছোঁয়ার মূল কারণ সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিল দেশের বাজার ব্যবস্থা। দুঃখজনক হলো অব্যাহত মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তাদের যখন দম বন্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সে অবস্থায়ও নানা অজুহাতে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অধিক মুনাফা করে মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছেন।

১৫ বছরে কোনো শাস্তির মুখোমুখি হতে না হওয়ায়, ব্যবসায়ীরাও সরকারকে কোনোভাবে সমীহ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। ফলে ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো পণ্যমূল্য বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের পকেট কাটলেও সরকারি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও নীরব ছিলেন।

নিত্যপণ্যের উৎপাদন, মজুত ও সরবরাহ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক; বাজার ও মুজতে পণ্যের কোনো ঘাটতি নেই। এরপরও সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণেই পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন কৌশলে এ কারসাজিতে লিপ্ত ছিল। তারা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এক বা একাধিক পণ্যকে টার্গেট করে পরিকল্পিতভাবে দাম বাড়িয়েছে। আর কৌশলে যুক্ত হয়েছে কমিশন এজন্টেস প্রথা, স্লিপ প্রথা। যার মাধ্যমে বাজারে মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও শেয়ার বাজারে কারসাজি করে শেয়ারের দাম বৃদ্ধির মতো কৌশল।

অন্যদিকে বাজার তদারকিতে ব্যবসায়ীদের পরিকল্পিত বাঁধা, তদারকি সংস্থাগুলোর সক্ষমতার অভাবেই বাজারের পুর্ণাঙ্গ তথ্য না থাকায় তারা উৎপাদক/আমদানিকারক, পাইকারি ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে শুধুমাত্র খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ে তদারকি করায় প্রকৃত অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। আর এ সুযোগে অস্বাভাবিক মূল্য বাড়িয়ে অল্প কয়েকদিনে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

বাজারের লাগাম টানতে বিগত সরকার আলু, পেঁয়াজ ও ডিমসহ অনেক পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু এসব পণ্যের ক্ষেত্রে দাম কার্যকর করা যায়নি। আলু, ডিম, পেঁয়াজ নিয়ে কারা কারসাজি করছেন তার তথ্য সরকারের জানা। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। নিত্যপণ্য সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণের পাশাপাশি ভোক্তাদের সমঅংশগ্রহণ দরকার। নিত্যপণ্যের কারসাজি রোধে বিদ্যমান আইন প্রয়োগে রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা না করে যথাযথভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

বাজারে কোনো মহল বা গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে কঠোর হস্তে দমনের জন্য প্রতিযোগিতা কমিশন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী যেকোনো অপতৎপরতা রোধে শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শনের সরকারকে দৃশ্যমান আন্তরিকতা দেখাতে পারলেই জনআঙ্খাকার প্রতিফলন ঘটবে। 

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)