ছবি : সংগৃহীত

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপাচার্য পদ নিয়ে আমার সুনির্দিষ্ট কিছু ভাবনা আছে। সেই ভাবনার বাস্তবায়ন সম্ভব, যদি কেউ আন্তরিক হন। যদিও ভিসি হওয়ার ব্যাপারে আমার আগ্রহ নেই বললেই চলে। কিন্তু যিনি ভিসি হবেন তিনি যদি এইসব বিষয় মাথায় রাখেন তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান আরও মজবুত হবে এবং শিক্ষার্থীদের জীবন মঙ্গলময় হবে।

আমার ভাবনা হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কেবল শিক্ষার্থীদের আবাসিক ব্যবস্থা থাকবে এবং থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে শিক্ষক কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা।

যেই দেশের শিক্ষার্থীরা অপ্রতুল আবাসিক সুবিধার কারণে অমানবিকভাবে ছাত্রাবাসে থাকে সেখানে শিক্ষক কর্মকর্তাদের জন্য বিলাসী আবাসিক ভবন কি মানায়? শিক্ষার্থীরা হলের গণরুমে, হলের ছাদে, বারান্দায় অনিরাপদ অবস্থায় রাত্রিযাপন করে জেনেও আমরা শিক্ষক হয়ে ওই একই ক্যাম্পাসে বিলাসী ভবনে কীভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ঘুমাই?  

প্রথম বর্ষেই শিক্ষার্থীদের আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ প্রথম বর্ষটাই শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময় ছিটকে পড়ে গেলে উঠে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেই জায়গায় আমাদের প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীরা যে পরিমাণ নির্যাতনের শিকার হয় তা অকল্পনীয়। অথচ এইসব আমরা জেনেও মুখে কুলুপ এঁটে থাকি।

শুধু তাই না প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা শিক্ষকরা নির্যাতনকারী শিক্ষার্থীদের সব ধরনের সাপোর্ট দিয়ে যায়। ভাবা যায়, সরকারি দলের ছাত্রনেতা একা একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকে! এমনকি কেউ কেউ পাশের আরেকটি রুমকে ড্রয়িং রুম হিসেবেও ব্যবহার করে থাকে। এইসব কি প্রভোস্টের প্রশ্রয় ছাড়া সম্ভব? 

প্রথম বর্ষেই শিক্ষার্থীদের আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ প্রথম বর্ষটাই শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময় ছিটকে পড়ে গেলে উঠে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

আমি ভিসি হলে ৪ বছরের অনার্সকেই টার্মিনাল ডিগ্রি হিসেবে কার্যকর করতাম। চাকরির নিয়োগ কর্তাদের বোঝাতাম বিসিএস থেকে শুরু করে সব ধরনের চাকরির জন্য ৪ বছরের অনার্সই যথেষ্ট। একে সফল করতে পারলে শিক্ষার্থীদের আবাসিক সংকট অনেকটা কেটে যাবে।

মাস্টার্স করবে নির্ধারিত শিক্ষার্থীরা যারা একাডেমিয়াতে বা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা বা গবেষণাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেবে। জীবনটা ছোট। কেন সবাই মাস্টার্স করে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের দেড় থেকে দুই বছর বা ততোধিক সময় অপচয় করবে?

আমার ভাবনা হলো, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি ক্যাম্পাসে উন্নতমানের ক্যাফেটেরিয়া নির্মাণ জরুরি, যেখানে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা খাওয়া-দাওয়া করতে পারে। নিজেরা লাইন ধরে ট্রেতে খাবার এনে আবার খাবার শেষে ট্রে নির্দিষ্ট স্থানে রেখে চলে যাবে। সেই ক্যাফেটেরিয়াতে ছাত্র এবং শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত কোনো স্থান থাকবে না। ছাত্র-শিক্ষক একত্রে একই স্থানে বসে খাওয়াদাওয়া করবে যাতে ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।

উন্নতমানের জিমনেসিয়ামের ব্যবস্থা করা আবশ্যক কারণ উন্নত মনের জন্য অবশ্যই ভালো স্বাস্থ্য প্রয়োজন। এছাড়া শিক্ষার্থীরা সারা বছর জুড়ে যেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে থাকতে পারে তার সুযোগ বৃদ্ধি করতাম। লাইব্রেরিকে আরও উন্নত করতাম। বিশেষ করে লাইব্রেরিকে সেন্ট্রালভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করতাম যাতে শিক্ষার্থীরা আরামে পড়াশোনা করতে পারে এবং এতে বইগুলো ভালোভাবে সংরক্ষিত হতো।

আমার ভাবনা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা থাকবে প্রচ্ছন্নভাবে, সক্রিয় নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বা তাদের আলাদা বার্তা থাকবে না। তাছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরীক্ষকের বর্তমান যেই পদ্ধতি আছে তা বন্ধ করা জরুরি। এতে সময় ক্ষেপণ বন্ধ হতো। মনে রাখতে হবে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে একটি মাসও যদি বাঁচানো যায়, তাই মঙ্গল।

শিক্ষার্থীদের এই বয়সের প্রতিটা দিনই গুরুত্বপূর্ণ। যে শিক্ষক যে কোর্স পড়াবেন তিনিই প্রশ্ন করবেন এবং তিনিই উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবেন। বাকিদের প্রয়োজন নেই। 

আমার ভাবনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ৭ কলেজের যুক্ত থাকার প্রয়োজন নেই। আমি বরং সরকারকে উপদেশ দিতাম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তৈরি করা হোক, যার অধীনে এই সাতটি কলেজসহ ঢাকার বাইরের আরও কিছু বড় বড় কলেজকে এফিলিয়েটেড কলেজ বানানো হবে। এই কলেজগুলোয় কেবল ৪ বছরের অনার্স পড়ানো হবে আর মাস্টার্স করবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে।

কলেজগুলোয় উচ্চ মাধ্যমিক এবং ডিগ্রি (পাসকোর্স) থাকবে না। বাদবাকি বাংলাদেশের কোনো কলেজে অনার্স পড়ানো হবে না। সেই কলেজগুলোয় কেবল এইচএসসি ও ডিগ্রি (পাসকোর্স) থাকবে। এইচএসসি হলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কলেজে অনার্স থাকায় এইচএসসি অবহেলিত হচ্ছে। 

…ভিসির ক্ষমতার দরকার নেই। বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশনের নীতিমালাকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানো জরুরি।

আমার ভাবনায় ভিসির ক্ষমতার দরকার নেই। বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশনের নীতিমালাকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজানো জরুরি। শিক্ষক নিয়োগে কমপক্ষে ৩টি স্তর রাখতাম। প্রতিটি স্তরে শর্টলিস্ট করা হবে এবং সবশেষে ভিসি বা প্রোভিসিসহ একটি সেরেমনিয়াল বোর্ডে নিয়োগ চূড়ান্ত হওয়ার ব্যবস্থা করতাম। কয়েকটি স্তর থাকলে দলীয়করণ, নেপোটিজম ইত্যাদি বন্ধ হয়ে যেত।

শিক্ষক নিয়োগ ও প্রোমোশনের বিষয়টা সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট অনুষদের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কাজে ভিসিদের সম্পৃক্ত থাকার কারণে ভিসিরা সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে নেতৃত্ব দিয়ে উন্নত করা যায় সেইসব নিয়ে ভাববার সময় পান না।

আমি ভিসি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ বর্তমানে যা দেওয়া হয় ন্যূনতম তার থেকে তিন-চারগুণ বেশি বরাদ্দের জন্য জোরালো দাবি জানতাম এবং একই সাথে সব শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবি করতাম। 

এইসব পড়ে আপনাদের ধারণা হতে পারে আমি বুঝি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছি। একদমই না। আমার প্রশাসনে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।

আমি আমার ভাবনাগুলো একজন পরামর্শক হিসেবে জানালাম। কেউ যদি কোনোভাবে লেখাটি পড়ে একটু হলেও উৎসাহিত হয়ে এর কিছু বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেন তাহলেই এই লেখার সার্থকতা। আমি জীবনে কিছু পাওয়ার জন্য বা পদপদবির জন্য কিংবা চাকরির ক্ষেত্রে প্রোমোশনের জন্য দৌড়াইনি এবং দৌড়াব না। নিজের শক্ত মেরুদণ্ড নিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দই আলাদা। আমি শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের পড়িয়ে আনন্দ পাই, সে জায়গায় থাকতে চাই।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়