ছবি : সংগৃহীত

পরবর্তী গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে। ঘটনাচক্রে, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক গেমসে চীনের যাত্রা শুরু হয়েছিল হলিউডের এই শহরেই। সেটি ছিল দশম গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক। গেমসে চীনের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন দৌড়বিদ লিউ ছাং ছুন। একা।

১৯৩২ সালের ৮ জুলাই তিনি শাংহাই থেকে জাহাজে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে যাত্রা করেন; পৌঁছান ২৯ জুলাই। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় তিনি শারীরিকভাবে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েন। তারপরও, পুরুষদের ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন লিউ। বলাবাহুল্য, দুর্বল শরীর নিয়ে তিনি কোনো পদক জিততে পারেননি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই লস অ্যাঞ্জেলেসেই চীনা ক্রীড়াবিদরা প্রথম স্বর্ণপদকটি জয় করেছিলেন! সেটা ১৯৮৪ সালের কথা। ১৯৪৯ সালে নয়াচীন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৫৮ সালে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক ক্রীড়া সংস্থার সাথে চীনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি গ্রহণের পর, ১৯৭৯ সালে চীন পুনরায় আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিতে নিজের বৈধ আসনটি ফিরে পায়। ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে লস অ্যাঞ্জেলেসে বসে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসের আসর। ২৯ জুলাই, গেমসের শুরুর দিকে, চীনের পুরুষ শুটার স্যু হাই ফেং স্বর্ণপদক জয় করেন।

এরপর থেকে অলিম্পিকসহ বিশ্বের বিভিন্ন ক্রীড়া-প্রতিযোগিতায় চীনা ক্রীড়াবিদরা একের পর এক সাফল্য অর্জন করতে থাকেন। ২০০৮ সালে বেইজিং গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে তারা দেশকে নিয়ে যান শীর্ষে। বিশ্বের ২০৪টি দেশ ও অঞ্চলের ১১৪৩৮ জন ক্রীড়াবিদ বেইজিং অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেন। চীন ৪৮টি স্বর্ণপদক জিতে গেমসে শীর্ষস্থান লাভ করে। ৩৬টি স্বর্ণপদক পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে থাকে যুক্তরাষ্ট্র।

২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকেও শীর্ষস্থানের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল চীন। গেমসের অধিকাংশ সময় স্বর্ণপদকপ্রাপ্তির দিক দিয়ে এগিয়ে ছিল দেশটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৩৯টি স্বর্ণপদক নিয়ে শীর্ষস্থানটি দখল করে যুক্তরাষ্ট্র, আর চীনকে ৩৮টি স্বর্ণপদক নিয়ে দ্বিতীয় স্থান নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

সদ্যসমাপ্ত প্যারিস অলিম্পিকেও চীন বলতে গেলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বর্ণপদকের সংখ্যার দিক দিয়ে শীর্ষস্থানে ছিল। গেমসের প্রথম স্বর্ণপদকটিও জিতেছিল চীন; শুটিংয়ে। ওদিকে, গেমসের শেষ স্বর্ণপদকটি জেতে যুক্তরাষ্ট্র। আর ওই পদকটিই দেশটিকে নিয়ে যায় শীর্ষস্থানে।

পদকটি আসে মেয়েদের বাস্কেটবল থেকে। ম্যাচে অধিকাংশ সময় এগিয়ে ছিল স্বাগতিক ফ্রান্সের মেয়েরা। কিন্তু শেষপর্যন্ত মাত্র ১ পয়েন্টের ব্যবধানে জিতে যায় মার্কিন ললনারা। ফরাসিরা জিতে গেলেই চীনের শীর্ষস্থান নিশ্চিত হয়ে যেতো।

প্যারিস অলিম্পিকে চীনা ক্রীড়াবিদরা ৪০টি স্বর্ণপদক জিতেছেন। দেশের বাইরে কোনো গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে এটা তাদের সেরা পারফরমেন্স। গেমসে তারা ২৭টি রৌপ্যপদক ও ২৪টি ব্রোঞ্জপদকও জিতেছেন। সব মিলিয়ে ৯১টি পদক।

শীর্ষস্থান অর্জনকারী যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণপদকের সংখ্যাও ৪০টি। কিন্তু রৌপ্য (৪৪) ও ব্রোঞ্জ (৪২) বেশি জেতায়, পদক তালিকার এক নম্বর স্থানটি পায় দেশটি। জাপান ২০টি স্বর্ণ, ১২টি রৌপ্য ও ১৩টি ব্রোঞ্জ পেয়ে তালিকার তৃতীয় স্থানে আছে। শীর্ষ দুই দেশের সাথে তৃতীয় স্থান অধিকারী দেশের পার্থক্য এখানে দেখার মতো।

প্যারিসে, এক প্রেস ব্রিফিংয়ের সময়, চীনা ক্রীড়াবিদদের সার্বিক পারফরমেন্স সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা। উত্তরে চীনা ক্রীড়া-প্রতিনিধিদলের উপ-নেতা চৌ চিনছিয়াং বলেন, ‘এক কথায় এটি ছিল একটি ব্রেকথ্রু।’ কেন ব্রেকথ্রু?

চীনা ক্রীড়াবিদরা দেশের বাইরের কোনো অলিম্পিকে সর্বোচ্চ সংখ্যক স্বর্ণপদকই শুধু জেতেননি, বরং এমন সব ইভেন্টে স্বর্ণপদক জিতেছেন—যেগুলোয় আগে তাদের তেমন উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই। মেয়েদের টেনিসের এককে এবার স্বর্ণপদক জিতেছেন চীনের চেং ছিনওয়েন। টেনিসের এককে এর আগে কেউ চীনের হয়ে অলিম্পিক স্বর্ণপদক জেতেননি।

পুরুষদের ১০০ মিটার ফ্রিস্টাইলে চীনের ফান চানলে তো বিশ্বরেকর্ডই গড়েছেন! সাঁতারে চীন সামনে এগুচ্ছে বটে, কিন্তু পুরুষদের ফ্রিস্টাইলে—যেখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাঁতারুদের আধিপত্য স্পষ্ট—বিশ্বরেকর্ড ভাঙা একটি সত্যিকারের ব্রেকথ্রু বটে। টিনিএজার সাইক্লিস্ট তেং ইয়াওয়েনের স্বর্ণজয়ী পারফরমেন্সও ছিল চমকপ্রদ।

চীন ঐতিহ্যগতভাবেই ৬টি ক্রীড়ায় শক্তিশালী—ডাইভিং, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, জিমন্যাস্টিকস, শুটিং ও ভারোত্তোলন। এই ছয়টি ক্রীড়ায় চীনারা স্বর্ণপদক জিতেছেন মোট ২৭টি। এর মানে, যেসব ক্রীড়ায় চীনারা তেমন একটা শক্তিশালী নয়, সেসব ক্রীড়ায় তারা স্বর্ণপদক জিতেছেন ১৩টি। একে সত্যিকারের ব্রেকথ্রু বলতেই হবে।

ডাইভিংয়ে চীন বিশ্বসেরা। কিন্তু এবারই প্রথম ডাইভিংয়ের সবকটি (৮টি) স্বর্ণপদক ঘরে তুলতে পেরেছে চীন। টেবিল টেনিসের সবকটি স্বর্ণপদকও (৫টি) জিতেছেন চীনারা। এর মধ্যে মেয়েদের দলীয় ইভেন্টের স্বর্ণপদকটি ছিল গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে চীনের ৩০০তম স্বর্ণপদক (এখন পর্যন্ত মোট ৩০৩টি)। ব্যাডমিন্টন, জিমন্যাস্টিকস, শুটিং ও ভারোত্তোলনেও চীনাদের পারফরমেন্স ছিল সন্তোষজনক। 

কোনো কোনো চীনা ক্রীড়াবিদ প্রত্যাশিত ফল অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন—এ কথাও স্বীকার করতে হবে। নারী সাঁতারু চাং ইয়ুফেই-এর নাম আসবে সবার আগে। টোকিও অলিম্পিকে একাধিক স্বর্ণপদকজয়ী এই সাঁতারু প্যারিসে একটি সোনাও জিততে পারেননি। তাকে একটি রৌপ্য ও ৫টি ব্রোঞ্জ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। সাঁতারে আরও দু’একজন তারকা ব্যর্থ হয়েছেন। তা না-হলে, চীন সহজেই পদক তালিকার শীর্ষস্থানে থাকতে পারতো।

ভলিবলে চীনা মেয়েরা বরাবরই ভালো। ১৯৮১ সালের ১৬ নভেম্বর ওসাকায় জাপানকে হারিয়ে চীনের নারীরা প্রথম বিশ্ব ভলিবল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এরপর আরও ৪ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন (১৯৮৫, ২০০৩, ২০১৫, ও ২০১৯) এবং ৩ বার অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন (১৯৮৪, ২০০৪, ও ২০১৬) হয় চীনের নারী ভলিবলাররা। কিন্তু তারকাসমৃদ্ধ দলটি প্যারিস অলিম্পিকে সুবিধা করতে পারেনি। বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে এখন চীনা নারী ভলিবল দলের অবস্থান ৬-এ (২০২৪ সালের ১০ জুলাই-এর হিসাব)।

যেসব ক্রীড়ায় চীন তেমন শক্তিশালী নয়, তেমন একটি হচ্ছে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড। আগেই বলেছি, অলিম্পিকে প্রথম চীনের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন একজন দৌড়বিদ, কোনো সাঁতারু বা ডাইভার বা টেবিল টেনিস খেলোয়াড় নন। কিন্তু ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডেই চীন তেমন একটা উন্নতি করতে পারেনি।

২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিকে চীনা হার্ডলার লিউ সিয়াং স্বর্ণপদক জিতেছিলেন এবং পরে বিশ্বরেকর্ডও ভেঙেছিলেন। কিন্তু তার উত্তরসূরিরা সে অর্থে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারেননি। টোকিও অলিম্পিকে আমরা মেয়েদের শটপুট ও হ্যামার থ্রোতে চীনা মেয়েদের ভালো পারফরমেন্স দেখেছিলাম। কিন্তু তারা এবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারেননি।

আমার বিশ্বাস, ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে চীনা ক্রীড়াবিদরা যখন প্রত্যাশিত ফলাফল অর্জন করতে শুরু করবেন, তখন চীন বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের পরাশক্তিতে পরিণত হবে। চীনের লক্ষ্যও তাই। চীনের সরকার দেশকে ক্রীড়ায় শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। এই চাওয়ার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ১৯৫২ সালের ১০ জুন, যখন চেয়ারম্যান মাও সে তুং ‘ক্রীড়া ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের উন্নয়ন’ শীর্ষক ধারণা পেশ করেন। এর পরই চীনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ’ ও ‘সরকারি ক্রীড়া কমিটি’। 

এরপর হোয়াং হো নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে। চীন ক্রীড়া খাতে শক্তিশালী দেশ হতে একের পর এক বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেগুলো বাস্তবায়ন করেছে ও করছে। দেশটিতে বর্তমানে ডজন খানেক ক্রীড়া একাডেমি আছে, যেগুলো থেকে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন।

দেশে খেলাধুলা নিয়ে গবেষণা করার জন্য আছে ৩০টির অধিক প্রতিষ্ঠান। আর শিশু-কিশোরদের জন্য ক্রীড়া-প্রশিক্ষণ স্কুল আছে কয়েক হাজার। গোটা চীনজুড়ে গড়ে উঠেছে ৫ লক্ষাধিক স্টেডিয়াম। সাম্প্রতিককালে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাধুলার ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। পাশাপাশি, বিশ্ব ও এশিয়ার বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থায় চীনা প্রতিনিধির সংখ্যা আড়াই শতাধিক, যাদের মধ্যে অনেকে মহাসচিব পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করেছেন বা করছেন।

আগেই বলেছি, পরবর্তী গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে, ২০২৮ সালে। অলিম্পিক ক্রীড়ায় যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম পরাশক্তি। গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ১৯ বার দেশটি পদক তালিকার শীর্ষস্থান দখল করেছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আছে এর পরেই ৭ বার শীর্ষস্থান নিয়ে। আর কোনো দেশ একাধিক বার পদক তালিকার শীর্ষস্থানটি পায়নি।

ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি ও চীন একবার করে পদক তালিকার শীর্ষস্থান লাভ করেছে। চীন অন্তত দু’বার তালিকার শীর্ষস্থানের খুব কাছে গিয়েও শেষ পর্যন্ত পারেনি। লস অ্যাঞ্জেলেসে কি পারবে? স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে শীর্ষস্থান দখল করা অবশ্যই সহজ হবে না। তবে, হাতে এখনো ৪ বছর। চীন এই চার বছরে অলিম্পিকের শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে কতোটা প্রস্তুত হতে পারে, সেটা এখন দেখার বিষয়।

আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)
alimulh@yahoo.com