ছবি : সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হওয়া, কলকারখানা বন্ধ রাখাসহ নানা অস্থিরতার ফলে পুরাতন অর্ডার বাতিল, সময়মতো শিপমেন্ট না দিতে পারা, সাপ্লাই চেন ভেঙে যাওয়া এবং নতুন অর্ডার না আসাসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।

প্রবাসী বাংলাদেশিরা আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে সমর্থন করতে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন, যার ফলে জুলাই মাসে রেমিট্যান্স দুই বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়। তবে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বৈধ পথে রেমিট্যান্সের পরিমাণ দ্রুত বাড়তে শুরু করে এবং আগস্টের শুরুতে কিছুটা স্থবির হলেও পরে তা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি বৈদেশিক শ্রমবাজার থেকে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স ও তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি আয়। এ দুই আয়ের উত্থান-পতনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। রেমিট্যান্স দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে, যেখানে প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো অর্থ সরাসরি পরিবারগুলোর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক।

অন্যদিকে, তৈরি পোশাক খাত দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি আয়কারী খাত, যা দেশের জিডিপির উল্লেখযোগ্য অংশ জোগান দেয় এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে।

বাংলাদেশি শ্রমিকরা মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ায় নির্মাণ, কৃষি, কারখানা এবং সেবা খাতে কাজ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের ১৭৬টি দেশে কাজের জন্য মানুষ যায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে ১১.৯৬ লাখ শ্রমিক কাজের উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ সালে ১১.৩৭ লাখ শ্রমিক কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ যান। বাংলাদেশ থেকে প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা খুবই কম। এ সমস্যার প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশে যে মানদণ্ডে দক্ষতা নিরূপণ করা হয় তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বৈশ্বিক মানদণ্ডে টেকে না।

বাংলাদেশে দক্ষতা নিরূপণের প্রক্রিয়া এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রমগুলো অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে, যেসব শ্রমিককে আমরা দক্ষ হিসেবে বিবেচনা করি, তারা বৈশ্বিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেন না। এর ফলশ্রুতিতে, প্রবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হন এবং তারা উচ্চতর মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।

এ অবস্থার উন্নতির জন্য দক্ষতা নিরূপণের প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংস্কার এবং আধুনিকায়ন করা অত্যন্ত জরুরি, যাতে আমাদের শ্রমিকরা বৈশ্বিক শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেন এবং দেশের জন্য আরও বেশি রেমিট্যান্স অর্জন করতে সক্ষম হন।

বাংলাদেশের শ্রমবাজারে সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা থাকলেও, প্রাইভেট সেক্টরের হাত ধরেই এ খাতে মূলত সফলতা এসেছে। মুক্তবাজারের নিয়মে মুনাফার লক্ষ্যে ব্যক্তি খাতের ব্যবসায়ীরা বিদেশে নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করে লাখ লাখ চাকরি প্রত্যাশীকে সেখানে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিভিন্ন কৌশলে তৈরি হওয়া সিন্ডিকেট এই সেক্টরের জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়েছে।

এর পাশাপাশি, প্রাইভেট সেক্টরের নানা অনিয়ম, বিশেষ করে শ্রমিকদের প্রতারণা ও জালিয়াতি, এই খাতকে দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এসব অনিয়ম আরও প্রকট হয়ে উঠছে, যা শ্রমবাজারের সামগ্রিক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে বৈদেশিক শ্রমবাজারে কৌশলগত সংস্কার এবং কার্যকর নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। প্রবাসীদের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্যে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও, বাস্তবে এই মন্ত্রণালয় বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশযাত্রায় নানা অযৌক্তিক বাধার সৃষ্টি করছে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জনশক্তি অধিদপ্তরের মূল দায়িত্ব হলো বিদেশগামী শ্রমিকদের ক্লিয়ারেন্স প্রদান করা। কিন্তু, দুঃখজনকভাবে এই ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া এতটাই অস্বচ্ছ এবং দীর্ঘসূত্রিতায় ভরা যে এটি শ্রমিকদের বিদেশযাত্রার সময় ও সুযোগ নষ্ট করে ফেলে। এই ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়ার মধ্যেই তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন সিন্ডিকেট, যেখানে দলীয় প্রভাব ব্যবহার করে দালালরা মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, যা বিদেশগামী শ্রমিকদের জন্য চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে।

বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ানোর জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ জনশক্তি খাতে কৌশলগত সংস্কার আনা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে, যেসব কর্মকর্তারা নানা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সিন্ডিকেট ও দালালচক্রের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে।

এছাড়া, বাংলাদেশি শ্রমিক প্রধান দেশগুলোর বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর শ্রমিকদের নাগরিক সুবিধা প্রদানে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। এসব দূতাবাসকে শ্রমিকদের সুরক্ষা, আইনগত সহায়তা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরা কোনোরকম হয়রানি বা প্রতারণার শিকার না হন।

প্রবাসীদের ভোগান্তি কমাতে এবং এয়ারপোর্টে তাদের সম্মানজনক সেবা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এ লক্ষ্যে, এয়ারপোর্টে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ কাউন্টার ও দ্রুত পরিষেবা ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।

প্রবাসীদের জন্য আলাদা হেল্পডেস্ক স্থাপন করা উচিত, যেখানে তাদের যেকোনো সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হবে। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রবাসীদের সম্মানজনক সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, তাই তাদের যাত্রাপথে যেকোনো ধরনের ভোগান্তি দূর করা জরুরি।

আমাদের লাখ লাখ বেকার যুবক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে ভালো চাকরির আশা করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যেকোনো শ্রমবাজারে টেকনিক্যালি দক্ষ লোকদের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। তাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমবাজারের সমন্বয় করে এমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যা বিশালসংখ্যক যুবকদের বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হবে।

বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে বিদেশি ঋণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কারণে এই প্রকল্পগুলো বাংলাদেশকে সুফল দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

ফলস্বরূপ, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। এমনকি কিছু কোম্পানি, যাদের কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই, শুধুমাত্র অর্থের বিনিময়ে প্রকল্প দেওয়া হয়েছে। সেখানে ছিল না কোনো কার্যকরী মনিটরিং ব্যবস্থা, ফলে প্রকল্পগুলো ব্যর্থ হয়েছে এবং অর্থ অপচয় হয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে শ্রমবাজার উপযোগী কারিকুলাম তৈরি করা এবং প্রয়োজনীয় ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের সুযোগ প্রদান করা জরুরি।

প্রশিক্ষিতদের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি এবং বেসরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে হবে এবং অনিয়ম রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে অনিয়মে জড়িত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর নিবন্ধন বাতিল করতে হবে, যাতে প্রকৃত অর্থে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা যায় এবং বৈদেশিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করা সম্ভব হয়।

নতুন দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি টেকসই বৈদেশিক কর্মসংস্থানের অন্যতম কার্যকর উপায়। তবে, বাংলাদেশের অনেক যুবক ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে যাত্রাপথে জীবন হারান, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ২০২২ সালে ইউরোপের রোমানিয়া বাংলাদেশে অস্থায়ী ভিসা সেন্টার চালু করলেও কিছু ক্ষমতাসীন রাজনীতিতে জড়িত ব্যবসায়ীরা রোমানিয়ান কর্মকর্তাদের জিম্মি করে ফেলেন, ফলে রোমানিয়া তাদের ভিসা কার্যক্রম স্থগিত করে এবং অফিস গুটিয়ে নেয়।

বাংলাদেশ সরকার যেখানে শ্রমবাজারের বহুমাত্রিকীকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেখানে ইউরোপের ভিসা সেন্টারের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এছাড়া, পূর্ব ইউরোপের বেশিরভাগ দেশে বাংলাদেশি দূতাবাস না থাকায়, শ্রমিকদের জন্য সেসব দেশে যাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে, যদিও সেখানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা রয়েছে।

সরকার বিএমইটিতে প্রতিটি দেশে অভিবাসন ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দিলেও, বাস্তবে মানুষ সরকারি ঘোষিত ব্যয়ের চেয়ে বেশি খরচ করে বিদেশ যায় এবং শ্রমিকরা আরও বেশি আর্থিক চাপের মুখে পড়ছেন। বাংলাদেশে বর্তমানে কর্মক্ষম জনশক্তি যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।

যদি এই জনশক্তিকে এখন কাজে লাগানো না যায়, ভবিষ্যতে কর্মক্ষম জনশক্তির সংকট তৈরি হবে এবং তখন বৃদ্ধ জনসংখ্যা বেড়ে যাবে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বজায় রাখতে হলে, বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সব ধরনের দৃশ্যমান বাধা দ্রুত দূর করতে হবে।

রাকিব হোসেন ।। গবেষক, উন্নয়নকর্মী
ratonrakib@gmail.com