ছবি : সংগৃহীত

দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংকিং সেক্টরের ভূমিকা অপরিসীম। অর্থনীতির সিংহভাগই নির্ভর করে ব্যাংকিং খাতের উন্নতির ওপর। যদি কোনো অনিয়মের কারণে বা সুশাসনের অভাবে ব্যাংকিং খাতে কোনো প্রভাব পড়ে, তবে তা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যায়।

কয়েক বছর ধরেই দেশের ব্যাংকিং খাত অনিশ্চিত সময় পার করছে। অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন ব্যাংক নির্বাহীদের মতে, বিভিন্ন খাতে ভুল নীতি গ্রহণ, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের কারণে দেশের অর্থনীতিতে, বিশেষ করে ব্যাংক খাতে বেশ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এছাড়া ৫ আগস্ট ২০২৪ এর পরপরই, কিছু ব্যাংকে মালিকানা পরিবর্তনসহ বেশকিছু দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি থেকে দেশের আর্থিক খাতকে রক্ষা করতে হলে দ্রুততার সাথে ব্যাংকিং খাতের অভিভাবক বাংলাদেশ ব্যাংককে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে অর্থাৎ ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় ধরনের ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। এসব কেলেঙ্কারিতে আত্মসাৎ হয়েছে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৫ বছর আগে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের সময় দেশে খেলাপি ঋণ ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়, যা দেশের অর্থনীতিকে চরম হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যে নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য সবার একীভূত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ব্যাংকিং নীতিমালা এমনভাবে প্রণীত হওয়া দরকার, যাতে তা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগতে পারে।

প্রথমেই আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। কয়েক বছরে ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এমনকি বিশিষ্টজনদের মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ক্ষুণ্ন হয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ করতে দেওয়ার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব। 

দ্বিতীয়ত, বর্তমানে ব্যাংক খাতের প্রকৃত অবস্থা কেমন, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি। ব্যাংকিং সেক্টরের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও জনসাধারণকে অবগত করার জন্য দ্রুতই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার বক্তব্য আসা উচিত। সেই অনুযায়ী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যাংকের সামগ্রিক অবস্থার উন্নতিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ব্যাংকিং সেক্টরে আইনের সুশাসন নিশ্চিত করা ও পর্যবেক্ষণের জন্য অতিদ্রুতই ব্যাংক কমিশন গঠন করে ব্যাংকগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি এবং তা থেকে উত্তরণের পথ আলোচনা করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক নির্বিশেষে বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাহাড়সম। কমিশনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ দ্রুত আদায়ের পন্থা ও প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যে নাজুক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য সবার একীভূত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ব্যাংকিং নীতিমালা এমনভাবে প্রণীত হওয়া দরকার, যাতে তা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগতে পারে।

তবে, খেলাপি ঋণ আদায় করতে গিয়ে আমানতকারীদের স্বার্থ যাতে বিঘ্নিত না হয়, সে বিষয়ে নজরদারী প্রয়োজন। ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী ও পরিচালক পর্ষদের সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বাধীন, প্রভাবমুক্ত ও উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করা অতিদ্রুত প্রয়োজন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কালে এই কমিটি গঠন করা গেলে ও তাদের কার্যবিধি প্রণয়ন সম্ভব হলে, ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাত যোগ্য পরিচালকের হাতে পরিচালিত হবে।

ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে অনেক সঞ্চয়কারী ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। এছাড়া দুই লাখের বেশি টাকা একদিনে তুলতে না পারার বাধ্যবাধকতা আমানতকারীদের মাঝে ব্যাংকের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এই সন্দেহ দূরীভূতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অতিদ্রুতই গ্রহণ করতে না পারলে দেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। এজন্য ব্যাংক সুশাসন নীতি অতি অল্প সময়ের মাঝেই গ্রহণ করতে হবে।

আর্থিক খাতের বিভিন্ন কেলেঙ্কারি, ঋণ খেলাপিতে থাকা, দেশের টাকা বাইরে পাচার করা ইত্যাদি অপকর্মের সাথে যারা যুক্ত হয়ে দেশের ক্ষতি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, পরবর্তীতে এ ধরনের অপকর্মের সাথে জড়িত না হওয়ার দৃষ্টান্ত যাতে তৈরি হয় ও সব পথ বন্ধ হয়ে যায়।

ব্যাংকগুলোর খুব দ্রুতই তার তারল্য সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকসহ সাতটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ধার হিসেবে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি দেখা যায়নি।

ব্যাংকগুলো তাদের ব্যবসা লাভবান করার জন্য প্রয়োজনে জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করে তাদের সাহায্যের প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। যেখান থেকে ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় কারিগরি পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে।

ফরেন রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দিন দিন নানা রকম অনিয়মের কারণে তা হ্রাস পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের হিসাব অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ রয়েছে ১৮.৩২ বিলিয়ন ডলার। যেহেতু ডলারের ওপর আমাদের বিনিয়োগ অনেকটাই নির্ভরশীল, সেজন্য এই ক্ষেত্রটি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। প্রবাসীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার মাধ্যমে তাদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী করা প্রয়োজন।

আর্থিক খাতের বিভিন্ন কেলেঙ্কারি, ঋণ খেলাপিতে থাকা, দেশের টাকা বাইরে পাচার করা ইত্যাদি অপকর্মের সাথে যারা যুক্ত হয়ে দেশের ক্ষতি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।

বাংলাদেশের ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর একজন অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ এবং দীর্ঘ সময় তিনি আর্থিক খাতে সুশাসন আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তার সময়োপযোগী পদায়ন ও অভিজ্ঞতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের ব্যাংকিং খাত স্বল্প সময়ের মধ্যে আবারও ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা রাখি।

আমাদের দেশের মানুষ কর্মঠ, পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমী। তাই তাদের যদি সঠিক পথ প্রদর্শন করা যায় ও জনকল্যাণে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যায়, তবে ব্যাংকিং সেক্টরের ঘুরে দাঁড়াতে খুব বেশি সময় লাগবে না। দেশটা আমাদের সবার, আমাদের সবারই দায়িত্ব দেশের উন্নয়নের অন্যতম অনুষঙ্গ ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করার কাজে ভূমিকা রাখা।

কতিপয় দুষ্কৃতিকারীর অপকর্মের দায়ে দেশের আপামর জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ লুণ্ঠিত হতে পারে না। সেই অর্থের সুরক্ষার দায়িত্ব ব্যাংকিং সেক্টরে নিয়োজিত প্রতিজন কর্মকর্তার। তাই দেশের বিদ্যমান আইনকানুনকে প্রয়োজনে সংশোধন করে ও সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে অস্থির ব্যাংকিং খাতে দ্রুতই সুশাসন ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি।

ড. রুমানা হক ।। অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং নির্বাহী পরিচালক, আর্ক ফাউন্ডেশন