ছবি : সংগৃহীত

মানুষের কিছু কিছু অসংক্রামক দীর্ঘস্থায়ী রোগ দেখা দেয়, তার মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বিশেষ এক ধরনের ডায়াবেটিস, যা কেবল গর্ভকালেই হয়ে থাকে। গর্ভকালীন সময়ে গর্ভবতী মায়ের রক্তে সুগারের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেড়ে গেলে তাকে গর্ভকালীন বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস মেলিটাস [Gestational Diabetes Mellitus (GDM)] বলা হয়।

ইনসুলিন এক ধরনের হরমোন, যা অগ্ন্যাশয়ে তৈরি হয়। এটি শরীরকে রক্তের গ্লুকোজের লেভেল নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। যদি শরীর যথেষ্ট পরিমাণে ইনসুলিন উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণও বেড়ে যায়। গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা থেকে নিঃসৃত হরমোন ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

হরমোনের লেভেল ও নতুন শারীরিক পরিবর্তনের কারণে মায়ের শরীর সঠিক পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গিয়ে ডায়াবেটিস দেখা দেয়।

গর্ভকালীন কোনো অন্তঃসত্ত্বা নারীর খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৫ দশমিক ১ মিলিমোল/লিটার এবং গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ৮ দশমিক ৫ মিলোমোল/লিটার হলে তার গর্ভকালীন ডায়াবেটিস আছে বলে ধরা হয়।

এছাড়া অন্তঃসত্ত্বা নারীর খালি পেটে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৭ মিলিমোল/লিটার এবং গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর ১১ দশমিক ১ মিলোমোল/লিটার হলে তার ওভার্ট ডায়াবেটিস বা গর্ভধারণের আগে থেকেই ডায়াবেটিস আছে বলে ধরা হয়।

গর্ভকালীন রক্তের যেকোনো পরীক্ষার সময় ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা দরকার। এই সময় রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নরমাল হলেও গর্ভাবস্থার ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে আবারও ডায়াবেটিস পরীক্ষা জরুরি। সাধারণত গর্ভের প্রথম ১২ সপ্তাহে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে, তাদের আগেই ডায়াবেটিস ছিল হিসেবে ধরা হয়। আর গর্ভের ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে যদি ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, তাকেই বলা হয় গর্ভকালীন ডায়াবেটিস।

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশের গ্রামে ৮ শতাংশ ও শহরে প্রায় ১৩ শতাংশ নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অর্থাৎ গড়ে বাংলাদেশে প্রায় ১০ শতাংশ নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো গর্ভবতী ৮৩ শতাংশ নারীই জানেন না যে, গর্ভাবস্থার ২৪ থেকে ২৮ সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করাতে হয়।

কারা গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে?

যেকোনো গর্ভবতী নারী গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন, তবে কারো কারো ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা অন্যদের তুলনায় বেশি। এই ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণগুলো হলো—

(১) অতিরিক্ত শারীরিক ওজন এবং কায়িক শ্রম বা ব্যায়াম না করা।

(২) বয়স ৩০ বছরের অধিক।

(৩) অতীতে কোনো সন্তান যদি বেশি ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে থাকে (চার কেজি বা বেশি)।

(৪) আগে যদি গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়ে থাকে।

(৫) পরিবারে কারো ডায়াবেটিস থাকলে। বাবা অথবা মায়ের, ভাইবোন, নিকট আত্মীয়, কারো ডায়াবেটিস থাকলে।

(৬) বারবার অ্যাবরশন বা সন্তান নষ্ট হওয়ার ইতিহাস থাকলে।

(৭) অজ্ঞাত কারণে পেটে অথবা জন্মের পরপরই সন্তান মারা যাওয়ার ইতিহাস থাকলে।

(৮) গর্ভথলিতে পানির (অ্যামনিয়াটিক ফ্লুইড) পরিমাণ বেশি বা কম থাকলে।

(৯) গর্ভাবস্থায় ঘন ঘন ইনফেকশন হলে, তলপেটে ব্যথা, মাসিকের রাস্তায় চুলকানি, চর্মরোগ ইত্যাদি দেখা দিলে।

(১০) কারও পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম থাকলে।

(১১) দক্ষিণ এশীয়, কৃষ্ণাঙ্গ, আফ্রিকান-ক্যারিবিয়ান বা মধ্যপ্রাচ্যের অধিবাসীদের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের লক্ষণ :

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের সাধারণত কোনো বিশেষ লক্ষণ থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গর্ভকালীন চেকআপের সময় এটি ধরা পড়ে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে রক্তে সুগারের মাত্রা অনেকখানি বেড়ে গেলে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যেমন ঘন ঘন পিপাসা লাগা, আগের তুলনায় ঘনঘন প্রস্রাবের বেগ আসা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, ক্লান্ত বোধ করা, বারবার ছোটখাটো অসুখ হচ্ছে, যেমন ঘন ঘন শরীরে ফোঁড়া হচ্ছে, বারবার প্রস্রাবে ইনফেকশন হচ্ছে, জিহ্বায় সাদা সাদা ক্যানডিডার আক্রমণ, মহিলাদের যৌনাঙ্গে ঘন ঘন ছত্রাক জাতীয় রোগের আক্রমণ, হাতে-পায়ের আঙুলের মাঝে ছত্রাকের আক্রমণ ইত্যাদি। কোথাও সামান্য কাটা-ছেঁড়া বা ঘা হওয়ার পর তা দ্রুত শুকাচ্ছে না।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস কী কী জটিলতা হতে পারে?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকার পরেও গর্ভকাল অনেকটাই স্বাভাবিক থাকে এবং গর্ভের সন্তানও সুস্থভাবেই জন্মগ্রহণ করে। তবে কিছু ক্ষেত্রে মা ও গর্ভের শিশুর কিছু সমস্যা হতে পারে এবং প্রসবকালীন নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন—

মায়ের জটিলতা :

(১) গর্ভবতী অবস্থায় ব্লাড প্রেশার বেড়ে যেতে পারে। চিকিৎসা না করালে এটি গর্ভকালীন বিভিন্ন মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন প্রি-এক্লাম্পসিয়া বা একলাম্পশিয়া হয়ে খিঁচুনি হতে পারে।

(২) গর্ভাবস্থার পূর্ণ হওয়ার আগেই সন্তান প্রসব হয়ে যাওয়া, একে বলা হয় প্রিম্যাচিউর লেবার।

(৩) গর্ভথলিতে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি বা কম হতে পারে।

(৪) ঘন ঘন ইনফেকশন হওয়া ও ইনফেকশনের কারণে সময়ের আগেই পানি ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

(৫) মৃত সন্তান প্রসব করা।

(৬) প্রসব-পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে।

গর্ভের শিশুর জটিলতা :

(১) বড় শিশু বা সন্তান আকারে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হওয়া যাকে বলে ম্যাক্রোসোমিয়া। এর ফলে জন্মগত আঘাত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

(২) শিশুর জন্মগত ত্রুটি, সময়ের আগে জন্ম ও গর্ভেই মৃত্যু হতে পারে।

(৩) নবজাতক হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা জন্মের পর শিশুর শরীরে সুগারের মাত্রা কমে খিচুনি, শ্বাসকষ্ট এবং দেহের তাপমাত্রা বজায় রাখার যে ক্ষমতা তা হারিয়ে ফেলতে পারে।

(৪) ভবিষ্যতে শিশুর ওজন আধিক্য বা ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিস গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের পরে মা ও সন্তানের জন্য বিভিন্ন সমস্যার কারণ হতে পারে। তবে যদি এটি প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়ে এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয় তবে সমস্যাগুলোর ঝুঁকি অনেকটাই কমে আসে।

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসা :

গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য জটিলতাগুলো এড়ানোর জন্য রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। রোগীদের মনে রাখতে হবে, বারডেমের প্রতিষ্ঠাতা এবং এ দেশে ডায়াবেটিস চিকিৎসার পথিকৃৎ প্রফেসর মোহাম্মদ ইব্রাহিমের মূল তিনটি বিখ্যাত উপদেশই ডায়াবেটিসের চিকিৎসার মূলমন্ত্র। তা হলো ইংরেজিতে তিনটি ‘ডি’—

(১) প্রথম ‘ডি’—ডায়েট বা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ৬০ থেকে ৮০ ভাগ রোগী এতেই ভালো থাকেন।

(২) দ্বিতীয় ‘ডি’—ডিসিপ্লিন বা শৃঙ্খলা। সুশৃঙ্খল জীবনযাপনই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূল চাবিকাঠি।

(৩) তৃতীয় ‘ডি’—ড্রাগ বা ওষুধ, খুব অল্প সংখ্যক রোগীরই এর প্রয়োজন পড়বে।

প্রথমত খাবারের দিকে নজর দিতে হবে। এ সময় সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। খাবারের সাথে সাথে প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম ও হাঁটাহাঁটির অভ্যাস করতে হবে। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। খেয়াল রাখতে হবে, অতিরিক্ত খাবার কন্ট্রোল করা উচিত নয়, এতে গর্ভস্থ বাচ্চার ক্ষতি হতে পারে।

যদি এসবের পরেও রক্তে সুগারের মাত্রা না কমে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য ওষুধের প্রয়োজন পড়বে, মুখে খাবার ট্যাবলেট বা ইনসুলিন ইনজেকশন। তবে গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার বড়ির পরিবর্তে ইনসুলিনের ব্যবহার নিরাপদ ও অধিক কার্যকর।

গর্ভধারণের আগে থেকে ডায়াবেটিস থাকলে আগেই ওষুধ পরিবর্তন করে চিকিৎসকের পরামর্শে ইনসুলিন শুরু করতে হবে। সম্ভাব্য সমস্যাগুলো এড়ানোর জন্য গর্ভাবস্থা ও প্রসবকালীন সময়ে নিয়মিত ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সন্তান প্রসবের পর সেরে যায় কি না?

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মায়েদের বেশিরভাগেরই সন্তান প্রসবের পর ছয় সপ্তাহের মধ্যে ডায়াবেটিস আর থাকে না। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস থাকলে সন্তান প্রসবের পর যখন প্লাসেন্টা বের হয়, তখনই ব্লাড সুগার নেমে যায়। প্লাসেন্টা থেকে যে হরমোনগুলো তৈরি হয়, সেগুলো ইনসুলিনকে কাজ করতে দেয় না। সুতরাং সেটি যখন শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়, তখন ইনসুলিন তার কার্যক্ষমতা ফেরত পায়, ব্লাড সুগার নরমাল হয়।

তবে যাদের গর্ভকালীন ডায়াবেটিস একবার হয়, তাদের ভবিষ্যৎ গর্ভধারণের ক্ষেত্রে আবারও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সেই সাথে মায়ের টাইপ ২ ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকিও বাড়ে। তাই তাকে অবশ্যই একটা সুনিয়ন্ত্রিত খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যে থাকতে হবে।

কোনোভাবেই ওজন বাড়তে দেওয়া যাবে না। সন্তান জন্মদানের ৬ থেকে ১৩ সপ্তাহ পরে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে, ডায়াবেটিস আছে কি না। যদি ডায়াবেটিস না থাকে, তাহলেও বছরে অন্তত একবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে।

ভবিষ্যৎ গর্ভধারণের পরিকল্পনা :

আবারও গর্ভধারণের পরিকল্পনা করলে অবশ্যই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে। যদি ডায়াবেটিস থাকে, তবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সন্তান ধারণের পূর্বপ্রস্তুতি নিতে হবে। পরিকল্পিতভাবে গর্ভধারণের মাধ্যমে মা ও সন্তান সুস্থ থাকতে পারে। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে ওজন নিয়ন্ত্রণ, কায়িক শ্রম ও ব্যায়াম এবং সঠিক খাদ্যাভ্যাস, সর্বোপরি স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে হবে।

অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ