দূর হোক শিক্ষার বৈষম্য
বাংলাদেশে সরকারি কলেজগুলোর মাধ্যমে সবচেয়ে কম খরচে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী নিজ এলাকায় থেকে উচ্চশিক্ষা পেয়ে থাকেন। এসব কলেজে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকরা পাঠদান করে থাকেন। দীর্ঘদিন এই শিক্ষকরা পেশাগত বৈষম্যের শিকার। এ বৈষম্য আন্তঃ এবং অন্তঃ উভয় ধরনের।
শিক্ষকতাকে মহান পেশা বলা হলেও সরকারি চাকরিতে শিক্ষকতার মূল্যায়ন খুব একটা দেখা যায় না। শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ হচ্ছে অধ্যাপক। এই অধ্যাপক পদে আরোহণ এই সার্ভিসের সব সদস্যের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এটা অনেকটা স্বপ্নের মতো।
বিজ্ঞাপন
অথচ এই অধ্যাপকের পদটি সরকারি বেতন কাঠামোয় আছে ৪র্থ গ্রেডে। এর উপরে ওঠার কোনো সুযোগ নেই শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের। নিকট অতীতে দুজন কর্মকর্তা প্রথম গ্রেড পেলেও সেটা তার চাকরির বিবেচনায় নয়, পারিবারিক পরিচয়ের কল্যাণে।
সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের বাইরে যত অধ্যাপকের পদ আছে সবগুলোই তৃতীয় গ্রেডের। শুধু তাই নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বিনা পদোন্নতিতে উচ্চতর বেতন গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর তথ্য বলছে, বর্তমানে সরকারি কলেজগুলোয় গড়ে একজন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থী আছেন ৯৭ জন। যেখানে ইউজিসির তথ্যমতে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ১৯ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছেন একজন শিক্ষক।
মফস্বলের কলেজ ও বড় কলেজগুলোয় এই চিত্র ভয়াবহ। ঢাকার অনেক কলেজে সংখ্যায় অতিরিক্ত শিক্ষক থাকলেও মফস্বলের কলেজগুলোয় শিক্ষকই পাওয়া যায় না।
আরও পড়ুন
আবার বড় বড় কলেজগুলোয় শিক্ষকের পদের স্বল্পতার কারণে শিক্ষক শিক্ষার্থী অনুপাত অকল্পনীয়। চট্টগ্রামের পটিয়া সরকারি কলেজে ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে পাঠদান করান মাত্র ৪৯ জন শিক্ষক। এর মূল কারণ বিভাগগুলোর স্টাফিং প্যাটার্ন।
১৯৮২ সালে এনাম কমিটি বিভিন্ন দপ্তরের পদ সংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তাতে সরকারি কলেজের যেসব বিভাগে অনার্স থাকবে সেখানে ১২ এবং যেখানে মাস্টার্স থাকবে সেখানে ১৬টি পদের সুপারিশ করা হয়েছিল। বিভিন্ন সরকারি কলেজে স্থানীয় চাহিদার ভিত্তিতে অনার্স ও মাস্টার্স খোলা হলেও এনাম কমিটির প্রস্তাবনা অনুসারে পদ সৃজন করা হয়নি।
এর কুফল লক্ষ্য করা যায় পদোন্নতির সময়। উচ্চতর পদের অপ্রতুলতার কারণে শিক্ষকরা একই পদে দশকের পর দশক বসে থাকেন। আমি ৮ বছর ধরে সহকারী অধ্যাপকের চাকরি করি। আমার আগের অন্তত ৫টি ব্যাচের শিক্ষকগণ এখনো পদোন্নতি পাননি। পদোন্নতির ফিট লিস্টে আমার নাম উঠতেই আরও ৩ বছর লাগতে পারে। পদোন্নতি তো আরও দূরে।
মফস্বলের কলেজ ও বড় কলেজগুলোয় এই চিত্র ভয়াবহ। ঢাকার অনেক কলেজে সংখ্যায় অতিরিক্ত শিক্ষক থাকলেও মফস্বলের কলেজগুলোয় শিক্ষকই পাওয়া যায় না।
শুধু পদ স্বল্পতা নয়, শিক্ষকদের পদোন্নতি দিতে সবার অনীহার কারণে প্রমোশন-জ্যাম তৈরি হয়েছে। সাড়ে ৫ বছরে একটি মাত্র ফুল সাইকেল প্রমোশন হয়েছে। অথচ এর আগে বছরে দুইবার ফুল সাইকেল প্রমোশন হতো।
আবার সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের বিশেষায়িত কলেজগুলোর পদোন্নতি জটিল ও সময় সাপেক্ষ। সঙ্গীত কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোর মতো বিশেষায়িত কলেজে একটি যৌগিক বিষয়ে অনেক মৌলিক বিষয় পড়ানো হয়। ফলে একটি বিষয় পড়ানোর জন্য বহু বিষয়ের শিক্ষক প্রয়োজন হয়।
যেহেতু ১২ জন শিক্ষকের কমে একটি বিভাগে অধ্যাপকের পদ সৃজন হয় না, তাই এসব কলেজে উচ্চতর পদ নেই বললেই চলে। তাই বিসিএস পরীক্ষায় এসব কলেজের জন্য শিক্ষক পাওয়া যায় না। বিশেষায়িত কলেজগুলো একদিকে শিক্ষক সংকটে অন্যদিকে কর্মরত শিক্ষকদের হতাশার মধ্য দিয়ে চলছে।
আরও পড়ুন
কলেজের পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের বিভিন্ন দপ্তর, বিভিন্ন প্রকল্প, শিক্ষা বোর্ড, বেইনব্যাইস, এনসিটিবি, নায়েমসহ বিভিন্ন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট দপ্তরে শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকদের কাজ করার সুযোগ আছে।
এসব দপ্তরে ইনসেনটিভ বোনাসসহ বিভিন্ন বাড়তি পেশাগত সুবিধা আছে। তাই শিক্ষা ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তারই এখানে পদায়নের আগ্রহ থাকে। কিন্তু এসব দপ্তরে কীভাবে পদায়ন হয় শিক্ষা ক্যাডারের অধিকাংশ সদস্যই জানেন না।
সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের বিশেষায়িত কলেজগুলোর পদোন্নতি জটিল ও সময় সাপেক্ষ। সঙ্গীত কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোর মতো বিশেষায়িত কলেজে একটি যৌগিক বিষয়ে অনেক মৌলিক বিষয় পড়ানো হয়। ফলে একটি বিষয় পড়ানোর জন্য বহু বিষয়ের শিক্ষক প্রয়োজন হয়।
হঠাৎ একেকটি পদায়নের আদেশ দেশে বিস্মিত হতে হয়। দুর্মুখরা বলেন, এসব নাকি সবই রাজনৈতিক প্রভাব ও তদবিরে হয়ে থাকে। কেন একটা আদর্শ নীতিমালার আলোকে এসব দপ্তরে পদায়ন হবে না? একই সত্য অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে পদায়নের ক্ষেত্রেও।
দেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে দেখা যায়, কনিষ্ঠ কর্মকর্তার (অথবা মেধাতালিকায় পেছনে অবস্থানরত) অধীনে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাগণ চাকরি করছেন। কী যোগ্যতায় কনিষ্ঠ অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ হলেন কেউ তা জানে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আমাদের যে আশার পথ দেখিয়েছে সেই পথ ধরে শিক্ষায় বৈষম্য বিলোপ হোক এটাই প্রত্যাশা।
জয়দীপ দে ।। সহকারী অধ্যাপক (চারু ও কারুকলা), সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা