সংকট-সহিংসতা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাত কতটা প্রস্তুত?
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, ভবনধস ও ভূমিধস এবং সড়ক, রেল, নৌ ও অগ্নি দুর্ঘটনাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সংকটগুলোর মুখোমুখি হয়েছে। তবে, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিপুল সংখ্যক হতাহতের ঘটনা স্বাস্থ্য খাতকে নতুন সংকটের মুখোমুখি করেছে। পুরোনো সংকটের পাশাপাশি এই নতুন সংকট মোকাবিলায় কি করণীয় তাও ভাবা দরকার।
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, এবং ভূমিধসের মতো দুর্যোগের সময় স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও সম্পদ প্রয়োজন। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কিছু উন্নতি হয়েছে, তবে এখনো অনেক এলাকায় পর্যাপ্ত মেডিকেল সরঞ্জাম, ওষুধ এবং প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব দেখা যায়।
বিজ্ঞাপন
করোনা মহামারি মোকাবিলায় প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে টেস্টিং সক্ষমতা বৃদ্ধি, টিকা বিতরণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। তারপরও, ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আরও উন্নত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে।
যেকোনো ধরনের সংকটের সময় স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি হলো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রাপ্যতা। অনেক সময় দেখা যায়, প্রয়োজনের তুলনায় সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে। এতে সংকট মোকাবিলায় স্বাস্থ্য সেবা প্রদান ব্যাহত হয়। এটি প্রতিরোধে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সরঞ্জাম সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন।
সংকট মোকাবিলায় স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি এবং অন্যান্য সংকট-সহিংসতার সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের সঠিক প্রশিক্ষণ থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণে কিছু উন্নতি হয়েছে, তবে আরও প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ প্রয়োজন।
সংকট মোকাবিলায় স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি এবং অন্যান্য সংকট-সহিংসতার সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের সঠিক প্রশিক্ষণ থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণে কিছু উন্নতি হয়েছে, তবে আরও প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ প্রয়োজন।
প্রযুক্তির ব্যবহার স্বাস্থ্য খাতে সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতির একটি বড় দিক। টেলিমেডিসিন এবং ডিজিটাল স্বাস্থ্য সেবা কোনো কোনো সংকটের সময় স্বাস্থ্য সেবা প্রদান সহজতর করতে পারে। বাংলাদেশে প্রযুক্তির ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে, তবে আরও বিস্তৃত প্রযুক্তি সমাধান গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
তবে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের উদ্ভূত পরিস্থিতির ক্ষেত্রে ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিপুল সংখ্যক মানুষ একই সাথে বুলেট এবং ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মক ইনজুরি নিয়ে মৃত্যু এবং অর্ধমৃত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ কয়েকটি বড় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বিশেষায়িত হাসপাতাল ছাড়া এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার তেমন সুযোগ নেই। এইসব হাসপাতালেই কেবল বড় ধরনের ক্যাজুয়ালিটি বা ব্যাপক মানুষের একসাথে ইনজুরি হলে তা ব্যবস্থাপনার প্রস্তুতি থাকে।
প্রয়োজনীয় লোকবল এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের প্রাপ্যতার অভাব এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতার অভাবসহ নিয়মিত সংকট মোকাবিলার জন্য যে সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, এই ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। পক্ষ-প্রতিপক্ষ থাকার কারণে ডাক্তার এবং রোগীর নিরাপত্তা বিধান একটা বড় চ্যালেঞ্জ কেননা প্রতিপক্ষ এসে রোগী এবং ডাক্তারদের ওপর হামলা করতে পারে যেটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কিছুটা ঘটেছিল।
ডাক্তারদের মধ্যেও কেউ কেউ প্রতিপক্ষ মানসিকতার কারণে ডাক্তার-সুলভ আচরণের ব্যত্যয় ঘটাতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে ডেডিকেটেড পুলিশ ফোর্স দিয়ে হাসপাতালের ডাক্তার এবং রোগীর নিরাপত্তা বিধান জরুরি। তাছাড়া এ ক্ষেত্রে প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রাইভেট ডোনার না পাওয়ার কারণে রক্তের তীব্র সংকট দেখা যায়।
আমাদের দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া (রানা প্লাজা ধসের সময় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং এবার ঢাকার এএনজেড হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল) সাধারণত জরুরি সেবা দিতে চায় না। কেননা জরুরি সেবার বিনিময় মূল্য পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে না।
তাছাড়া, পুলিশ কেসসহ নানা জুট-ঝামেলা থাকে যাতে বেসরকারি হাসপাতাল জড়াতে চায় না। এবারের ঘটনা যেহেতু সব পুলিশ কেস, তাই সরকারি হাসপাতাল ছাড়া কোনো গত্যান্তর ছিল না। তবে, এবারের ঘটনায় সরকার প্রতিপক্ষ হওয়াতে আরেকটা কনফিউশন হয়েছে। আহত আন্দোলনকারীদের মধ্যে ধারণা জন্মাতে পারে যে তারা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে গ্রেপ্তার হতে পারে। তাই আহতদের উপযুক্ত চিকিৎসা প্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
আমাদের দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণত জরুরি সেবা দিতে চায় না। কেননা জরুরি সেবার বিনিময় মূল্য পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে না। তাছাড়া, পুলিশ কেসসহ নানা জুট-ঝামেলা থাকে যাতে বেসরকারি হাসপাতাল জড়াতে চায় না।
তবে, স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন জরুরি অবস্থা মোকাবিলার সবচেয়ে বাধা হলো সময়মতো অর্থ প্রাপ্তি এবং তা সহজে খরচ করতে পারা। নিয়মিত অর্থায়ন পদ্ধতিতে অর্থছাড় এবং অর্থ খরচের যে জটিলতা আছে, সেই জটিলতার মধ্যে জরুরি স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া সম্ভব নয়। কেননা জরুরি অবস্থায় অর্থ ছাড় এবং অর্থ খরচে কোনো নিয়মকাননের বাহুলতা থাকলে তা জরুরি উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারে না। তাই, স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য একটি জরুরি তহবিল গঠন করা অপরিহার্য।
উল্লেখ্য, ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরের বাজেট বক্তৃতায় স্বাস্থ্যখাতে বিভিন্ন জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য দুই হাজার কোটি টাকার একটি জরুরি তহবিল গঠনের একটি ঘোষণা ছিল। এটি হয়তো বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একটা প্রচেষ্টা ছিল। সহজে অর্থ ছাড় এবং অর্থ খরচের বিধানসহ এটি যদি উপযুক্ত কাঠামোর ভিত্তিতে গঠন করা যায় তাহলে এক্ষেত্রে ভালো সূচনা হতে পারে।
যদিও বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক বাস্তবতায় তা কতটুকু বাস্তবায়িত হবে তা সময় বলে দেবে। বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী সৎ ও আন্তরিক মানুষ হওয়ায় তবুও আশাবাদী, হয়তো ভালো কিছু হবে। তবে, সৎ ও আন্তরিক মানসিকতা তখনই ফলদায়ক হয়, যদি এ খাতকে ভালোভাবে বুঝা যায়। আর এ জটিল খাতকে বুঝার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে তার বলয়ের বাইরে এসে নিজ উদ্যোগে দল-মত নির্বিশেষে এই খাতের বিশেষজ্ঞদের সাথে পরামর্শ করতে হবে।
পরিশেষে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, ‘মাচ ক্যাজুয়ালিটি’ এবং অন্যান্য সংকটের সময় দ্রুত ও কার্যকরী স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য একটি কার্যকরী জরুরি তহবিল গঠনসহ একটি সমুন্নত পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। একসঙ্গে কাজ করে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে, আমরা একটি শক্তিশালী স্বাস্থ্য খাত গড়ে তুলতে পারি, যা যেকোনো সংকট মোকাবিলায় সক্ষম হবে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ।। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক