গিনিপিগ গুলো কেমন দেখেন! যার কথায় দেশের লাখ লাখ মানুষ জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৮১ সাল থেকে কতজন অকাতরে জীবন দিয়েছেন। অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। আরও কত ধরনের সেক্রিফাইস! কিংবা তার নির্দেশে পুলিশসহ নিরাপত্তাবাহিনী এবং জীবন দিতে প্রস্তুতেরা পাখির মত নির্বিচারে গুলি করে, কুপিয়ে, পিটিয়ে, নির্মম নির্যাতন করে মানুষ খুন করেছে। ঘরের ভেতরে-ছাদে খেলারত শিশুও রেহাই পায়নি। সেই নেত্রী কিনা নিজের ও পরিবারের জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালালেন! অথচ এই তো সেদিন, কয়েকদিন আগেও বললেন, “শেখ হাসিনা পালায় না।”

প্রথম আলোর সোমবার (৫ আগস্ট) রাতের অনলাইন সংস্করণের দুটি প্রতিবেদনের শিরোনাম যথাক্রমে “শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার ঘটনায় বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগ” (https://www.prothomalo.com/politics/jvacuciaoy) এবং শেষ সময়েও বলপ্রয়োগ করে থাকতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা (https://www.prothomalo.com/politics/npi7qhf8sa)। প্রতিবেদন দুটি পড়লে শেখ হাসিনার মনের প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পারবেন। পাশাপাশি জানতে পারবেন জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুতদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট সম্পর্কেও। এই প্রতিবেদনটি পড়ার পাশাপাশি আপনারা শেখ হাসিনার ঢাকা ত্যাগের ভিডিওটি ভালো করে দেখতে পারেন। দেখবেন তেজগাঁওয়ের পুরাতন বিমানবন্দর ত্যাগে কত তাড়াহুড়ো ছিল তার। দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি পড়লে জানতে পারবেন নিজের জীবনের মায়া থাকলেও তিনি পুলিশ-আর্মিকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করাতে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন। তার ওই চেষ্টা সফল হলে কী হতো? আরও কিছু মানুষ মারা যেত। তাদের মধ্যে সাধারণ মানুষ, পুলিশ বা আর্মি সদস্য থাকতে পারতেন। যদিও তাতে বিজয় ছিনতাই হতো না, বিলম্বিত হতো। আর তেমনটি ঘটলে হয়তো শেখ হাসিনার সুস্থভাবে প্রস্থান ঘটতো না। তার শুভকাঙ্ক্ষিরা একপ্রকার জোর করেই তাকে পদত্যাগ করিয়েছেন। এরমাধ্যমে প্রাণহানি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। আর যা হয়েছে সেটা হচ্ছে, সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে।

জাতিসংঘের সংজ্ঞা (Article II) অনুযায়ী গণহত্যা বা জেনোসাইড কী? উত্তর হচ্ছে: Genocide is a crime committed with the intent to destroy a national, ethnic, racial or religious group, in whole or in part. It does not include political groups or so called “cultural genocide”.

এখন, এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, বাংলাদেশে সংঘটিত ‘মাস-কিলিং’কে তো সরাসরি গণহত্যা বলা যায় না, তাই না? কেননা, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক গণহত্যাকে তো গণহত্যা বলা যায় না!

উত্তর হচ্ছে, না। এটা গণহত্যাই। গণহত্যা বলতে দ্বিধা নেই। সংজ্ঞায় অন্যান্য কারণের মধ্যে racial বা বর্ণবাদীতাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ যারা করেন না বা ভিন্নমতের যারা আছে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে। কেবল প্রাণনাশ নয়, আর্থিক, সামাজিক, ধর্মীয় সবভাবে ভিন্নমতের লোকদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন। তিনি সমাজে একটা ভয়ঙ্কর racism সৃষ্টি করেছিলেন। আওয়ামী লীগ বা তার সঙ্গে থাকা বামপন্থিদের আদর্শের বাইরে যারা ছিলেন তাদের সঙ্গে চরম বর্ণবাদী আচরণ করা হয়। নামাজ পড়তে গেলে জামায়াত-শিবির আখ্যা দিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে কাউকে খুন আবার কাউকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাকে শহীদ আবরারের ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে। খালেদা জিয়ার মতো একজন সংবেদনশীল ও নির্ভরশীল জাতীয় নেত্রীকে বানোয়াট অপরাধে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ড. ইউনূসের অপরাধ হচ্ছে, তিনি নোবেল জয় করেছেন এবং শেখ হাসিনা বা তার বাবার চেয়ে বিশ্বে বেশি জনপ্রিয় ও পরিচিত। এমনি নানান দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে। যার সবকিছু রেশিয়াল আচরণের পরিচায়ক। 

এখন প্রশ্ন আসতে পারে ‘রেসিজম’ কী। যদি সার্চ ইঞ্জিন গুগলকে জিজ্ঞেস করি তাহলে উত্তর পাবো: Racism is the process by which systems and policies, actions and attitudes create inequitable opportunities and outcomes for people based on race. 

আবার এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যেহেতু শহীদদের বেশিরভাগ তরুণ এবং ছাত্রছাত্রী। মেধাবী প্রজন্ম। পরবর্তী অ্যাকশনগুলোর টার্গেটও ছিল শিক্ষার্থীরা। তাই এই ঘটনাকে যদি গণহত্যা বলতে না চাই, তাহলে একে “মেরিটোসাইড” বলা খুবই উপযুক্ত। এটা জেনোসাইডের বিকল্প শব্দ; কেননা, মেধাবীদের কেবল চাকরিবঞ্চিত করার পদক্ষেপ হিসেবে কোটার মাধ্যমে মেধা খেয়ে ফেলার ব্যবস্থাই নেননি, সর্বশেষ আন্দোলনে নির্বিচারে খুন করা হয়েছে।

ওপরে বর্ণিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি, শেখ হাসিনা ১৬ বছরের শাসনামলে নীতি-কৌশল, কাজ, দৃষ্টিভঙ্গি সব দিয়েই তার সঙ্গে থাকা ব্যক্তিদের প্রতি সদয় ছিলেন এবং বাকিদের কোনো ক্ষেত্রে অধিকার ছিল না। সবাইকে দেশের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছেন। এই ১৬ বছরে অন্তত চারবার বড় ধরনের হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন দেশে। অসংখ্য মানুষকে গুম করেছেন। গুম থেকে অনেকেই ফেরত আসেনি। অনেককে কবর পর্যন্ত দিতে পারেননি সন্তান-পরিবার। এক কথায় তিনি যা করেছেন তা রেশিয়াল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। সুতরাং, ১৬ বছরে তার চার দফা হত্যাযজ্ঞকে চারটি গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করা যায়। এই চারটির মধ্যে আছে : মাওলানা সাঈদীর রায়ের পর একদিনে শতাধিক নাগরিককে খুন, শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের আলেম ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের খুন ও লাশ গায়েব, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে-পরে বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের খুন-গুম এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে খুন-গুম।
 
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনরোষের মুখে শুধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার ঘটনা মানতে পারছেন না আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রীরা। তারা বলছেন, তিনি দেশ ছেড়ে যদি যাবেনই, তাহলে শেষ মুহূর্তে দলের নেতা-কর্মীদের কেন আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি দাঁড় করালেন?

এই যে গণহত্যা তা তিনি সরকারি বাহিনী আর দলীয় হেলমেটবাহিনী দিয়ে করিয়েছেন। সরকারিবাহিনীতে দু’ধরনের লোকেরা গণহত্যায় হুকুম তামিল করেছেন শেখ হাসিনার। এক ধরনের হচ্ছে হারুন-বিপ্লবদের মত দলীয় ক্যাডাররা। আরেক ধরনের হচ্ছে সরকারের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের বিনিময়ে। এছাড়া দেশের পুরনো দল হিসেবে আওয়ামী লীগের আদর্শে অনুপ্রাণিত গোষ্ঠী আছে। যেই গোষ্ঠী তারা সুশীলসমাজে থাকুক আর নানান পেশায়- তারা চরম প্রতিক্রিয়াশীল। আপনাদের মনে আছে, টকশোতে শাজাহান খান বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিঞার চোখ তুলে নিতে চেয়েছিলেন। অর্থ্যাৎ, শেখ হাসিনার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে খুনি-সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তারা নেত্রীর প্রতি এমনই মোহান্ধ ছিলেন যে, তার জন্য জীবন দিতে ও নিতে প্রস্তুত ছিলেন। 

অথচ জীবনের মায়ায় তিনি নিজেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। আর প্রাণহানির শঙ্কার মধ্যে রেখে গেলেন আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতাকর্মীদের।

এখন, আমরা বিপরীত দিকটিও একটু তলিয়ে দেখি। উল্লিখিত প্রতিবেদনে দেখবেন, যেই নেত্রীর নামে কটুভাষায় একটি রাজনৈতিক স্লোগান দিলেও তার হেলমেটবাহিনী 
পারলে বিরোধী-সমালোচকদের জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলতেন, অথচ এখন তারাই তার সমালোচনা করছেন। একদিন যেহেতু, আপনারাই আপনাদের স্বপ্নের নেত্রীর সমালোচনা করবেন তাহলে রাজনৈতিক বক্তব্য, বিবৃতি ও স্লোগান কেন আপনারা সহ্য করেননি? একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্য প্রকাশ-প্রচারে পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিয়েছেন আদালতের মাধ্যমে! 

আপনারা ফেসবুক ঘাটলে দেখবেন, অসংখ্য মানুষ পোস্ট দিয়েছে যে, আপনার নেতা-নেত্রীরা কিন্তু পালাবে। তাদের পালাবার জায়গা আছে। আপনি পালাবেন কোথায়? তাই সাধারণ মানুষের ওপর হামলার আগে ভাবুন। কিন্তু নেত্রীর নির্দেশে তারা এতটাই উজ্জীবিত ছিলেন যে, দিনে-দুপুরে প্রকাশ্য রাস্তায় মানুষের জীবন নিতে কুণ্ঠিত হয়নি। মেরে লাশের ওপর উন্মত্ত নৃত্য করার দৃশ্য আপনারা নিশ্চয়ই ভোলেননি। নিশ্চয়ই ভোলেননি পিলখানা থেকে আর্তচিৎকার করে বাঁচানোর অনুরোধ করা সত্ত্বেও আর্মিকে অ্যাকশন চালাতে না দেওয়ার কথা।

 এ প্রসঙ্গে আমি অবশ্যই ধন্যবাদ দেবো ও কৃতজ্ঞতা জানাবো বাংলাদেশ আর্মির মধ্য ও জুনিয়র কর্মকর্তাদের প্রতি। তারা তাদের বসদের স্রেফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা জনতার ওপর গুলি চালাতে পারবেন না। এরপর চাপে পড়ে বসেরা রণে ভঙ্গ দেন ও শেখ হাসিনার সঙ্গ ত্যাগ করেন। এজন্য অবশ্য সোমবার শেষমুহূর্তেও যখন শেখ হাসিনা রক্ত পান করতে চেয়েছিলেন, তখন তারা বকাঝকা খাওয়া সত্ত্বেও অ্যাকশনে না যাওয়ার কথা সাফ জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনা যাতে পদত্যাগ করেন সেজন্য শেখ রেহানা, দরবেশ বাবাসহ অন্যদের বোঝাতে অনুরোধ করেন। এমনকি সজীব ওয়াজেদ জয়কে নক করেন।

আর শেষ পর্যন্ত, ‘জনতা ৪৫ মিনিটের মধ্যে গণভবনে ঢুকে যাবে’—বলার পর তিনি পদত্যাগে রাজি হন। কিন্তু “শেখ হাসিনা পালায় না”— এমন কথা যে তার প্রতারণা ও চাতুর্যপূর্ণ ছিল, তা প্রমাণ করে তড়িঘড়ি দেশত্যাগ করেন আর লাখ লাখ কর্মী-সমর্থকদের রেখে যান মৃত্যু ঝুঁকিতে।

আবার তিনি এমন দম্ভোক্তিও করেছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্পর্কে “সাহস থাকলে দেশে আয়”।

শেখ হাসিনাকে অনেকেই সাইকোপ্যাথ বলে অভিহিত করে থাকেন। আমি যখন প্রথম এমন শব্দ শুনি উনার ব্যাপারে, তখন তা আমি নিতে পারছিলাম না। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে, তাকে যথার্থই বিশেষায়িত করা হয়েছে। ২০০০ সালে উচ্চ আদালতের যেই বিচারক তাকে “রঙ হেডেড ওম্যান” বলেছেন, তিনি যে যথার্থ ছিলেন সেটা গত ১৬ বছরে পদে পদে প্রমাণিত হয়েছে। 

আবার পাগল যে কখন কী করে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা থাকে না। হাসিনার ক্ষেত্রেও তাই। লম্ফ-ঝম্ফ-দম্ভ করে তিনি পালিয়ে গেলেন। এরপর ছেলেকে দিয়ে বলালেন, “মা আর রাজনীতি করবেন না।”

কারণ, তিনি বুঝে গেছেন, এই লাখ লাখ কর্মীর আনুগত্য যেমন তিনি হারিয়ে ফেলেছেন, তেমনি তিনি জীবদ্দশায়ই পার্টিকে কবর দিয়ে ফেলেছেন। তার ক্ষমতার ওপর ভর করে যে গোষ্ঠী তৈরি হছে, তারা কেবল ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভক্ষণে। যে চাটুকার গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তারা তাকে ডুবিয়েছেনই, সুপরামর্শ দেননি। সর্বশেষ চাটুকারিতায় উদ্বেলিত হয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি কট অ্যান্ড বোল্ডআউট হলেন।

আজ বড় বেশি মনে পড়ছে মতিউর রহমান রেন্টুর কথা। তিনি শেখ হাসিনার চরিত্রের বিভিন্ন দিক বর্ণনা করে গেছেন “আমার ফাঁসি চাই” বইতে। সেটি এতদিন বাড়াবাড়ি মনে হলেও গত একমাসে অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হয়েছে।

মুসতাক আহমদ
উইসকনসিন, যুক্তরাষ্ট্র