সহিংসতায় উদ্যোক্তারা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়
দুর্যোগ—প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক নানাবিধ। বিষয়টার সাথে আমরা সবাই পরিচিত, কিন্তু এটা মোকাবিলার টুলগুলোর সাথে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরিচিত না। আবার কোনো কোনো দুর্যোগ মোকাবিলার কোনো টুলই থাকে না। এমনটাই হয়েছিল ১৮ জুলাই ইন্টারনেট বন্ধের পর।
ইন্টারনেট বন্ধের সাথে আমাদের এফকমার্স, ই-কমার্স, ডিজিটাল মার্কেটিয়ার, ই-ট্যুরিজম, ডিজিটাল এজেন্সি এবং আইটি সেক্টর ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। সেই চ্যালেঞ্জটা এমনই অবধারিত ছিল যে সবাই বুঝে গিয়েছিল সংকট নিরসনের উপায় নিজেদের হাতে আর নেই। যার প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েছে অর্থনীতিতে এবং আমরা সেটার পরিমাণটা আন্দাজ করতে না পারলেও ঠিকই ক্ষতিটা অনুধাবন করতে পারছি।
বিজ্ঞাপন
দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যানগত তথ্যে সমৃদ্ধ না, আপডেটেড তথ্য ঘাটতি আছে। তারপরেও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর সূত্রমতে ইন্টারনেট বন্ধজনিত কারণে ই-কমার্স খাত প্রতিদিন প্রায় ১৫০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এফ-কমার্সে প্রতিদিন প্রায় ৫০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
ই-লজিস্টিকস অর্থাৎ কুরিয়ার সার্ভিস খাতে প্রতিদিন লোকসান হয়েছে ১০ কোটি টাকা। ই-পর্যটন ও ই-কমার্স সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ডিজিটাল ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে প্রতিদিন প্রায় ৩০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে প্রথম ১০ দিনে ক্ষতির পরিমাণ ১৪০০ কোটি টাকা।
সিএমএসএমই (কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ) খাতের ব্যবসায়ীরা ইন্টারনেট বন্ধের ফলে যে পরিমাণ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেটা অপূরণীয় কারণ; বেশিভাগেরই কোনো ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ফান্ড নেই। তারা নানা ঘাত-প্রতিঘাত ঠেলসতে ঠেলতে ব্যবসাকে একটা পর্যায় পর্যন্ত এনে দাঁড় করিয়েছে।
...তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যবসায়ীর কোনো ব্যাংকিং ট্রানজেকশন নেই ও আপডেটেড বিজনেস ডকুমেন্টস নেই। একারণেই সংকটকালীন ফান্ড ম্যানেজমেন্টের জন্য তারা ব্যাংকের সহযোগিতা প্রত্যাশা করতেও ব্যর্থ হবে।
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যবসায়ীর কোনো ব্যাংকিং ট্রানজেকশন নেই ও আপডেটেড বিজনেস ডকুমেন্টস নেই। একারণেই সংকটকালীন ফান্ড ম্যানেজমেন্টের জন্য তারা ব্যাংকের সহযোগিতা প্রত্যাশা করতেও ব্যর্থ হবে। ফান্ড সংকটের কারণে পুনরায় ব্যবসা শুরু করতে অনেকেরই দীর্ঘ একটা বিরতির আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সিএমএসএমই সেক্টরের নারীরা এফ-কমার্সে লাইফস্টাইল পণ্য নিয়ে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও প্রোডাকশন লেভেলে তাদের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ থাকে। ব্যবসায়ীর কাজ বন্ধ থাকা মানে প্রোডাকশন হাউজ বন্ধ থাকা, আর প্রোডাকশন বন্ধ থাকলে সেই কর্মযজ্ঞের সাথে যুক্ত হাজার হাজার শ্রমিকের কাজ বন্ধ থাকা, টেইলারিং এর সাথে যুক্ত কর্মীরা বেকার হয়ে যায় এবং সেইসাথে কুরিয়ার সার্ভিসের সাথে যুক্ত সব কর্মীর জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
অনলাইন ব্যবসা আসলে একটা সাপ্লাই চেইন। একটার সাথে আরেকটা নিবিড়ভাবে যুক্ত। যেকোনো একটার অভাবে তাই বাকি প্রক্রিয়াগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে।
ইন্টারনেট বন্ধের কারণে বড় রকমের ঝুঁকিতে পড়েছে ফল ব্যবসায়ীরা। কয়দিন আগে ছিল লিচুর, এখন আমের সিজন। আমের রাজধানী খ্যাত উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও রংপুরে আমের বড় হাব গড়ে উঠেছে। সেখান থেকে চাষিরা সারা দেশে আম সরবরাহ করে থাকে। বড় মাধ্যম অনলাইন। অনলাইন বিপণন সুবিধার কারণে প্রচুর লোকজন আম ব্যবসায় ঝুঁকছে।
২০২৩ সালে শুধু রংপুরে ৯০৫ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়েছে। বিপণন মূল্য ছিল ২৫০ কোটি টাকা। ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে পাল্লা দিতে এবারে আরও বেশি পরিমাণ জমিতে তারা আম চাষ করেছে এবং বিপণন সম্ভাবনাও অধিক। আমের অন্য শহরগুলোর ক্ষেত্রেও একই বাস্তবতা।
সাম্প্রতিক ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতার কারণে কয়েক কোটি টাকার আম বিপণন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতার কারণে যানবাহন অচলাবস্থায় কুরিয়ারে আটকা পড়ে পচে গিয়েছে আরও কয়েক কোটি টাকার আম। আমরা হয়তো ভাবছি ইন্টারনেট শুধু অনলাইন ব্যবসার জন্যেই জরুরি। তা কিন্তু না। ব্যবসা অনলাইন কিংবা অফলাইন এখন ইন্টারনেটের ব্যবহার বহুমাত্রিক।
সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রিলান্সিং সেক্টর তরুণ প্রজন্মের কাছে খুবই আকর্ষণীয় খাত। দক্ষতা থাকলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করার অনেক বড় কর্মক্ষেত্র এটা। শুধু ২০২৩ সালেই ফ্রিল্যান্সিং সেক্টর থেকে দেশ আয় করেছে ১০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। দেশে কত সংখ্যক মানুষ ফ্রিল্যান্সার সেটার সঠিক কোনো তথ্য উপাত্ত নেই।
তবে বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির সূত্রমতে, দেশে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ১০ লাখের মতো যারা বাংলাদেশ থেকে ১৫৩টি মার্কেটপ্লেসে কাজ করছেন। নানা বিষয়ে আউটসোর্সিং করে নিজেরা আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছেন সেইসাথে দেশকে নিয়মিত রেমিট্যান্স জোগান দিয়ে আসছেন। ফ্রিল্যান্সিং-এর অন্যতম অনুষঙ্গ হলো ইন্টারনেট। ফ্রিল্যান্সারদের প্রয়োজন হয় দ্রুতগতির নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ।
সুতরাং ইন্টারনেট বন্ধের কারণে তাদের প্রচুর কাজ হাতছাড়া হয়ে গেছে। অনেকেই চলমান কাজের ডেডলাইন মিট করতে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় গিয়েছেন যাতে করে ইন্টারনেট সুবিধা পান এবং কাজগুলো শেষ করতে পারেন।
অনলাইন ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ই-লজিস্টিকস। লজিস্টিকস বিশাল সম্ভাবনাময় একটা খাত। আগামী দিনের অর্থনীতির সম্প্রসারণ লজিস্টিকস খাতের উন্নয়নের ওপরে নির্ভর করবে।
লজিস্টিকস কোম্পানি প্রতিদিন প্রায় ৮ লাখ পণ্য সেবা দিয়ে থাকে অর্থাৎ গ্রাহকের ঘর অব্দি সেবা পৌঁছে দেয় এবং এই কাজটি করেন ৫০ হাজারের মতো ডেলিভারি নির্বাহী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্র আছেন যারা পড়ালেখা ও থাকাখাওয়া নির্বাহ করেন অবসর সময়ে চুক্তিভিত্তিক ডেলিভারির এই কাজ করে। দেশে এফ-কমার্স ও ই-কমার্স ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। তাদের পণ্য ডেলিভারি সেবা দিয়ে থাকেন আরও প্রায় ৫ লাখ মানুষ। বিরাট অংশগ্রহণ!
অনলাইন ব্যবসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ই-লজিস্টিকস। লজিস্টিকস বিশাল সম্ভাবনাময় একটা খাত। আগামী দিনের অর্থনীতির সম্প্রসারণ লজিস্টিকস খাতের উন্নয়নের ওপরে নির্ভর করবে। কারণ পণ্যের উৎপাদন খরচ, বিপণন, সরবরাহ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং টেকসই সাপ্লাই চেইন প্রতিষ্ঠায় কার্যকর লজিস্টিকস সেবা অপরিহার্য।
ব্যবসা খাতের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতি অথচ শুনতে অবাক লাগবে জাতীয় লজিস্টিকস নীতিমালা প্রণীত হয়েছে মাত্র এবছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে। এছাড়া এফবিসিসিআই লজিস্টিকস শিল্পের উন্নয়নের জন্য ২০ বছর মেয়াদি রোডম্যাপ তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সবমিলিয়ে দারুণ ব্যবসা অনুকূল একটা সাপোর্ট সিস্টেম পেতে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
এত কথা কেন বললাম? কারণ যেকোনো সহিংসতা, হরতাল কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতা কিংবা দেশের অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে প্রথমেই ধাক্কা খায় পরিবহন ব্যবস্থাপনা। টেকসই লজিস্টিকস নীতিমালা নিরবচ্ছিন্ন সেবা পেতে সাহায্য করবে।
জুলাই মাসে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ও পারিপার্শ্বিক কারণে কুরিয়ারে আটকে থেকে যে পরিমাণ খাদ্য উপাদান নষ্ট হয়েছে তেমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণও সম্ভব হবে। দেশে এখন প্রচুর কুরিয়ার কোম্পানি। অনলাইন ব্যবসা বৃদ্ধির এটা একটা বড় কারণ।
সিএসএবি’র তথ্য অনুযায়ী দেশে পাঁচশোর মতো কুরিয়ার কোম্পানি আছে। এই খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত আছে প্রায় ২০ লাখ জনবল এবং বাৎসরিক বাজার খাত প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। ইন্টারনেট বন্ধের কারণে চূড়ান্ত রকমের ধস নেমেছে সেই লজিস্টিকস খাতে।
একবিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেট আমাদের জন্য অবশ্যম্ভাবী নিয়তি। দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে ব্যবসা খাতকে টিকিতে রাখার পরিকল্পনা থাকতে হবে সরকারের। যেকোনো দুর্যোগ, সংঘাত, সহিংসতা, অস্থিরতায় ব্যবসা খাত যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এভাবে আলাদা করে ফেলতে হবে। কারণে-অকারণে দুর্যোগ ঝড় ঝাপটা আসতেই পারে কিন্তু তাই বলে জানমাল সবকিছু নিয়ে সেখানে ঝাঁপ দেওয়া কিংবা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা কোনো কাজের কথা না।
দেশের অর্থনৈতিক অচলাবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অর্থনীতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। আর মানুষকে টিকিয়ে রাখতে হলে দরকার দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যবসা অনুকূল পরিবেশ এবং সাপোর্ট সিস্টেমকে শক্তিশালী ও নিরাপদ রাখা।
ওয়ারেছা খানম প্রীতি ।। প্রেসিডেন্ট, হার ই-ট্রেড