বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান, স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও বাজার ব্যবস্থা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বহির্বিশ্বের কাছে এর গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে বিশ্বরাজনীতিতে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা ও পরিবর্তন যেমন ৯/১১-এর ঘটনা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, কোটা সংস্কার আন্দোলন, চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি, কিছু আঞ্চলিক শক্তির উত্থান, এশিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি, মধ্যপ্রাচ্যের ভিন্ন ভূরাজনীতির প্রভাব বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ ও বহির্বিশ্বের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে।

‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি নয় বিদ্বেষ’ নীতি এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের সাথে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তাজনিত এবং সামাজিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় জনসংযোগের সম্পর্ক গঠন করে।

বহির্বিশ্বের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক:

বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা,  রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা এবং বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপর জোর দেয়। বাংলাদেশ পারস্পরিক সহযোগিতা, সুবিধা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মানের ওপর জোর দিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি বৈচিত্র্যময় অন্তর্জাল গড়ে তুলেছে।

চীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিপরীত আচরণ করলেও সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশ-চীন স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তা এবং ভারতীয় বেশকিছু গণমাধ্যমে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক নিয়ে মিথ্যাচার, জল, বাণিজ্য এবং সীমান্ত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ ও ভারত কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে বজায় রেখেছে।

স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও বাজার ব্যবস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতি চাঙা করতে বিদেশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যকে আকর্ষণ করে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য ও বৈদেশিক সহায়তা জড়িত।

অন্যদিকে ন্যাম, জাতিসংঘ, সার্ক ও আইসি ও বিমসটেকের মতো বহুপাক্ষিক কূটনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী শান্তি, সহযোগিতা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিত পদক্ষেপের বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) যোগদানের পর থেকে বাংলাদেশের কাছে ন্যাম একটি গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম।

২০২৪ এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ১৯তম ন্যাম সম্মেলনেও বাংলাদেশ সব বৈশ্বিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির আহ্বান জানায়। বহুপাক্ষিকতাবাদে দৃঢ় বিশ্বাসী বাংলাদেশ জাতিসংঘে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি এবং অন্যান্য আরব ভূমি দখলের বিরুদ্ধে, ইউক্রেনের সংঘাতে মানবিক সহায়তা বিষয়ক দ্বিতীয় রেজুলেশনে বাংলাদেশের স্পষ্ট ভূমিকা লক্ষ্যণীয়। 

বহির্বিশ্বের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক:

স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও বাজার ব্যবস্থা বাংলাদেশের অর্থনীতি চাঙা করতে বিদেশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্যকে আকর্ষণ করে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, আন্তঃরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য ও বৈদেশিক সহায়তা জড়িত।

আঞ্চলিকভাবে চীন ও ভারতের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও বাংলাদেশের বাণিজ্য সমাঞ্জস্য থাকলেও বাংলাদেশের জন্য চীন, ভারত, জাপান গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। সেই সাথে ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশও তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাজার। ২০২৩ সালে ভারত বাংলাদেশে ৬০৫২টি পণ্য রপ্তানি ও ১১৫৪টি পণ্য বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে। ২০২৪ এর মে মাসে চীন ২.২২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করেছে এবং বাংলাদেশ থেকে ৭৭ মিলিয়ন ডলার আমদানি করেছে।

চীন বাংলাদেশের জন্য একটি বড় উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, অবকাঠামো প্রকল্পে প্রচুর বিনিয়োগ করছে। তবে, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং ঋণ ফাঁদ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠলে নেপাল, ভুটান ও পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়বে। 

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশসমূহ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ মূলত তৈরিকৃত পোশাক, তবে এর পাশাপাশি কৃষিজাত দ্রব্য ও ওষুধজাত পণ্য রপ্তানি করছে।

ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যান্ড এসিআই ইন্ডাস্ট্রি-এর ২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি ১৩.৩ শতাংশ বার্ষিক হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ যেহেতু বাণিজ্যের একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র, চীন ও ভারত উভয়েই বন্দর বিনিয়োগ ও কূটনীতিতে জড়িত হতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

২০২৬ সালে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও রপ্তানি সম্পর্কিত কিছু সুবিধা বাতিল হবে, তাই সময় ও অর্থনৈতিক কূটনীতির সঠিক ব্যবহার করে বহির্বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থিতিশীল রাখা প্রয়োজনীয়। 

নিরাপত্তাজনিত সম্পর্ক:

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট, চীন, ভারত ও পাকিস্তানের ব্যাপক সামরিক আধুনিকায়ন ও পারমাণবিকীকরণ এবং মিয়ানমারের পরিমিত সামরিক আধুনিকীকরণসহ ভারত-চীনের সাথে মিয়ানমারের সুসম্পর্ক এবং বর্ধিত সন্ত্রাসবাদ বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ও আধুনিকায়নের আগ্রহকে তৈরি করেছে।

আঞ্চলিক নিরাপত্তা স্বার্থে বাংলাদেশের সাথে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মায়ানমারের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার মতো বড় শক্তির সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতার চুক্তি রয়েছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনেও বাংলাদেশের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। 

সময়ের পরিক্রমায় ভূ-কৌশলগত দিক দিয়ে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে যা একসাথে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ ও প্রতিকূলতাও তৈরি হয়েছে। ২০০২ সালে চীন এবং বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা স্বাক্ষর করে যা ২০২৪ সালে আবারও জোরদার করা হয়।

পাশাপাশি চীন বাংলাদেশের কক্সবাজারের পেকুয়ায় বিএনএস শেখ হাসিনার নামে সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মাণ করছে যা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের লজিস্টিক এবং কৌশলগত উপস্থিতি নিশ্চিত করবে যা ভারতকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।

ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ খ্যাত রাজ্যগুলোর সাথে বাংলাদেশের সীমানা থাকায় এবং চীনের সাথে বাংলাদেশের একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তির কারণে ভারত তার নিজস্ব সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশের সাথে সামরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। যার ফলশ্রুতিতে চিকিৎসা সহায়তা, প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে এবং সন্ত্রাস দমনে যৌথ মহড়া অভিযানে দুই সেনাবাহিনী অংশগ্রহণ করে। 

বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠলে নেপাল, ভুটান ও পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়বে। 

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যকার গতিশীলতা বিবেচনা করে ২০২৩ এর এপ্রিলে বাংলাদেশ ‘ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গি’ নথিটি প্রকাশ করে যা সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক নিরাপত্তার সম্পর্ক নির্মাণে স্বতন্ত্র অবস্থানকে প্রকাশ করে।

নথিটির মাধ্যমে বাংলাদেশ কোনো দিকে না ঝুঁকে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে বিদ্যমান সহযোগিতাকে আরও গভীর করার ইচ্ছাকে প্রকাশ করে। ২০২৩ এর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৯তম দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা সংলাপে অংশগ্রহণ করে যেখানে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার সাথে দ্বিপাক্ষিক সামরিক ও সামুদ্রিক নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। 

আন্তঃরাষ্ট্রীয় জনসংযোগ:

বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মাধ্যমে বাংলাদেশ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দেশগুলো নিজেদের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষায় উৎসাহিত করছে যা একইসাথে জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া, রাষ্ট্রগুলোর সফট পাওয়ার বিনিময়ের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে ভবিষ্যৎ সেতু তৈরি করে।

যেমন প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং বাংলাদেশ বেতার মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বিদেশি শ্রোতাদের কাছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি পৌঁছে যাচ্ছে। 

পৃথিবীর প্রায় ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৮৬ লাখেরও অধিক শ্রমিক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখলেও বাংলাদেশের এখনো কোনো আন্তর্জাতিক সোশ্যাল সিকিউরিটি স্কিম নেই। কিন্তু বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের মাধ্যম সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ মালয়েশিয়া ও ওমানের মতো কিছু দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সামাজিক নিরাপত্তা চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে, যা অভিবাসী কর্মীদের জন্য পেনশন বহনযোগ্যতা এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো সুবিধা দেয়। আন্তঃরাষ্ট্রীয় জনগণের মধ্যে যোগাযোগ রাষ্ট্রগুলোর পর্যটন ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশসহ অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে। 

একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে এসে আমরা বৈশ্বিক মেরুকরণের নতুন ধারা দেখতে পাচ্ছি যা বাংলাদেশের সাথে বহির্বিশ্বের সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করে। দুই আঞ্চলিক শক্তি ভারত-চীনের বাংলাদেশকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও সামরিক প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের মাধ্যমে দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষার নীতিকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। আর নিঃসন্দেহে বহির্বিশ্বেও এর প্রভাব পড়েছে।

তাই বৃহৎ ও পরস্পর বৈরীভাবাপন্ন রাষ্ট্রগুলোর সাথে বাংলাদেশ ব্যালেন্স অব পাওয়ার ও ব্যালেন্স অব রিলেশন বজায় রেখে বহির্বিশ্বের সাথে পারস্পারিক শান্তি ও প্রগতির অর্জন করবে। 

অদিতি চক্রবর্তী ।। প্রভাষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়