ছবি : সংগৃহীত

বর্ষায় আপনার নগরের জমে থাকা জলের স্রোত যখন গিয়ে নদীতে পড়ে, সেই স্রোতে কেবল শুদ্ধ বৃষ্টির জলই থাকে না—সেখানে মিশে থাকে নাগরিকদের শৌচালয় থেকে নির্গত নোংরা জল, রাজপথের ধারে জমে থাকা নাগরিকদের মলমূত্র, মৃত পশুপাখির শব, সাথে আরও নানাপ্রকার বর্জ্য। সেই স্রোতধারা গিয়ে নদীতে মেশে, নদী জলের ভারে ভরে ওঠে, নদীর স্রোত বদলে যায়, নদী অর্জন করে চারিদিক প্লাবিত করার শক্তি।

নদীর জল কি তাতে দূষিত হয়? নিশ্চয়ই হয়—কখনো কম, কখনো বেশি। কিন্তু নগর যখন নোংরা করে রাখবেন তখন প্রতি শ্রাবণে প্রতি বর্ষণে নগর থেকে গিয়ে নদীতে মেশা জলের ধারা নদীর জল দূষিত করবেই। এই শ্রাবণে আমাদের দেশে একটা আন্দোলন শুরু হয়েছে, আন্দোলনে মানুষের স্রোত প্রবল হয়েছে কিন্তু এই স্রোতের ধারা আর কেবল চাকরিতে নিয়োগের শর্ত সংক্রান্ত একটি স্বার্থবাদী আন্দোলনে সীমিত থাকেনি। তবে কি নানা মানুষের মিশেল হওয়া এই আন্দোলন একদিন প্লাবিত করবে সম্পূর্ণ রাষ্ট্র? ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেবে এতদিন ধরে শিকড় গেঁড়ে বসে থাকা জগদ্দল?

পৃথিবীজুড়ে খুব কম রাজনীতিবিদই খুঁজে পাওয়া যায় রাষ্ট্রীয় জীবনে মানুষের অধিকারের গুরুত্ব সম্পূর্ণ অনুধাবন করতে পেরেছে। মানুষের অধিকার মানে কী? স্বাধীনতা। কথা বলার স্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—যে স্বাধীনতা রাষ্ট্র বা সমাজ চাইলেই খর্ব করতে পারে না।

কথা বলার স্বাধীনতার অর্থ কেবল কথা বলার স্বাধীনতাই নয়—এর সাথে অন্তর্ভুক্ত হয় রাষ্ট্রীয় জীবনে সব স্তরে মতামত দিয়ে নাগরিকদের অংশগ্রহণের অধিকার। সেই অর্থে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা বা অর্থপূর্ণ ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা সেও বাকস্বাধীনতারই অংশ হয় বটে। সেই সাথে মানুষের সৃজনশীল ও দার্শনিক মতামত প্রকাশ প্রচলিত জ্ঞান, প্রথা-প্রতিষ্ঠান, বিশ্বাস ও চিন্তাকে নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের অধিকার সে তো আছেই।

রাষ্ট্রনায়কদের অনেকের মধ্যেই দেখা যায়, অতীতেও দেখা গেছে, উঁচু উঁচু ইমারত সড়ক ইত্যাদি নির্মাণ ও নাগরিকদের বৈষয়িক আরাম আয়েশ নিশ্চিত করার মধ্যেই সার্থকতা বা সাফল্য দেখতে পায় আর সেটা করতে গিয়ে মানুষের অধিকার সঙ্কুচিত করে ফেলে। এইসব করতে গিয়ে কী হয়? মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা যখন খর্ব হয় তখন মানুষ কথা বলার ধরন পাল্টে ফেলে এবং নতুন ধরনটা হয় অনেক সময় একেকটা টর্নেডোর মতো বিস্ফোরণ রূপে।  

মানুষের অসন্তোষ খুব দীর্ঘ সময় চেপে রাখা যায় না। আর যদি গায়ের জোরে কেউ চেপে রাখতেও চায়, জমে যাওয়া সেইসব ছোট ছোট অসন্তোষ জমে জমে একসময় বিস্ফোরিত হয়। জমে থাকা অসন্তোষ হয় স্তূপীকৃত বারুদের মতো—সামান্য স্ফুলিঙ্গেই বিশাল অগ্নোৎপাত ঘটাতে পারে। আর জমে যাওয়া অসন্তোষের পরিমাণ যত বেশি হয়, বিস্ফোরণের তীব্রতাও তত বেশি, বহিঃপ্রকাশ আরও তীব্র হয়। কিন্তু অসন্তোষ যত বেশিই জমা হোক না কেন, বিস্ফোরণের জন্যে কিন্তু ক্ষুদ্র একটা স্পার্কই যথেষ্ট।

ইতিহাসের পথে খুব পেছনে যাওয়ার দরকার নেই, এই শতকেই আমাদের একরকম চোখের সামনেই এইরকম এক বিস্ফোরণ আমরা দেখেছি বিশাল অঞ্চল জুড়ে—আরব বসন্ত। সে এক প্রবল জনস্রোত তোলপাড় করে ফেলেছিল আরব বিশ্বের এ মাথা থেকে ঐ মাথা। প্রবল প্রতাপের জন্য যেসব শাসককে আমরা চিনতাম যুগ যুগ ধরে, ওদের প্রায় ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে দিয়েছিল অতি সাধারণ সব ছেলেবুড়োর সেই মিলিত জনস্রোত।

করবেই। এই শ্রাবণে আমাদের দেশে একটা আন্দোলন শুরু হয়েছে, আন্দোলনে মানুষের স্রোত প্রবল হয়েছে কিন্তু এই স্রোতের ধারা আর কেবল চাকরিতে নিয়োগের শর্ত সংক্রান্ত একটি স্বার্থবাদী আন্দোলনে সীমিত থাকেনি।

আরব বসন্ত কীভাবে শুরু হয়েছিল সেকথা কি মনে আছে?

তিউনিসিয়ার একটি ছোট শহরে সড়কের ধারে একটা ভ্যানগাড়িতে করে ফল-সবজি বিক্রি করতো ছাব্বিশ বছর বয়সী যুবক মোহাম্মদ বুয়াজিজি। একদিন বুয়াজিজিকে এসে ধরেছে পৌরসভার একজন নারী কর্মকর্তা—বুয়াজিজি যে রাস্তায় ফল বিক্রি করছে, ওর কি সেটার জন্যে লাইসেন্স আছে? বুয়াজিজির লাইসেন্স নেই। এই নিয়ে শুরু হয় কথা কাটাকাটি।

মহিলা বুয়াজিজির ভ্যানটিকে ধাক্কা মেরে কিছু ফল-সবজি ফেলে দেয়, বুয়াজিজিও তাকে কয়টা কটু কথা শুনিয়ে দেয়। মহিলা ঠাস করে বুয়াজিজির গালে মারে এক চড়। রাগে, দুঃখে, অপমানে পরদিন বুয়াজিজি সড়কে দাঁড়িয়ে নিজের গায়ে তেল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আগুনে আত্মাহুতি দেয় বুয়াজিজি।

ছোট একটি শহরে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা টুইটারে, ফেসবুকে ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। সেই ঘটনার প্রতিবাদ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেছে গোটা তিউনিসিয়ায়, সড়কে মানুষের স্রোত নেমেছে, এই স্রোত তিউনিসিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে যায় অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোয়। আরব রাষ্ট্রগুলোয় তো বেশিরভাগই কর্তৃত্ববাদী সরকার। এরপরের ইতিহাস তো সবাই জানা।

ছোট একটা ঘটনা তিউনিসিয়ার মানুষকে এইরকম খ্যাপিয়ে তুলল কী করে? কেনই তিউনিসিয়ার গণবিক্ষোভের এই জোয়ার ছড়িয়ে গেল এক দেশ থেকে আরেক দেশে—এইভাবে প্রায় গোটা আরব বিশ্বে? সেটার জন্যে আপনাকে দেখতে হবে তিউনিসিয়ার সে সময়কার রাজনৈতিক অবস্থা।

তখন তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন জাইন এল আবিদিন বেন আলী—একজন কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রপতি। দেশে ছিল না কোনো কার্যকর গণতন্ত্র। বেন আলী ১৯৮৭ সনে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির অধীনে বিধিসম্মতভাবেই প্রধানমন্ত্রী হন। এর কিছুদিনের মধ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে নিজে রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করেন।

এরপর থেকে পরপর কয়েকবার পাতানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকেন বেন আলী। আর এইরকমভাবে যারা ক্ষমতা দখল করে রাখতে চায়, ওদের শাসনে দেশে মানুষের অধিকারের কি অবস্থা হয় সেই কথা তো আর ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই—তিউনিসিয়ার মানুষের অধিকারও সীমিত ছিল, ক্ষুণ্ন ছিল কর্তৃত্ববাদী বেন আলী সরকারের অধীনে।

মানুষের অসন্তোষ খুব দীর্ঘ সময় চেপে রাখা যায় না। আর যদি গায়ের জোরে কেউ চেপে রাখতেও চায়, জমে যাওয়া সেইসব ছোট ছোট অসন্তোষ জমে জমে একসময় বিস্ফোরিত হয়।

দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ ভালো ছিল না, তবে এত খারাপও ছিল না যে মানুষ অভাবের চোটে হাহাকার করবে। এর মধ্যেও তিউনিসিয়ায় উন্নয়ন ঠিকই হচ্ছিল। মানুষের ক্ষোভটা ছিল মূলত অধিকার না থাকার ক্ষোভ, স্বাধীনতা না থাকর ক্ষোভ। বেন আলীর শাসনের কমবেশি চব্বিশ বছর ধরে মানুষের এইসব ছোট ছোট ক্ষোভ জমা হয়ে বারুদের স্তূপের মতো হয়ে গিয়েছিল—বুয়াজিজির আত্মাহুতি সেই বারুদের স্তূপে স্ফুলিঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে মাত্র।

আর গোটা আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশের অবস্থাও তো, অন্তত মানুষের অধিকারের প্রশ্নে, একইরকম ছিল। ফলে অন্যান্য দেশের মানুষের মনেও ক্ষোভ জমা হয়েছিল। আপনার ঘরে যদি বিস্ফোরক পদার্থ জমা হয়ে থাকে, পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে তো আপনার ঘরেও বিস্ফোরণ ঘটাবে। সেই বিস্ফোরণটাই ছিল ২০১০ সালের আরব বসন্ত।

কৌতূহল জাগানিয়া ব্যাপার হচ্ছে, সেইসময় তিউনিসিয়ায় কথা উঠেছিল যে ছোট শহরটির নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে কি স্বার্থান্বেষী তৃতীয় পক্ষের অনুপ্রবেশ ঘটেছে? কেননা সরকার কিন্তু প্রাথমিক বিক্ষোভের পরপরই পৌরসভার সেই নারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। সেই মহিলাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, বুয়াজিজির মৃত্যুর জন্যে তাকে সাজাও দেওয়া হয়েছিল। আরব বসন্তের পরে দীর্ঘদিন কারাগারেই রাখা হয়েছিল।

কথা উঠেছিল যে, দায়ী ব্যক্তিকে তো সাজা দেওয়া হয়ে গেছে, তাহলে এখন আর কীসের আন্দোলন, এগুলো তো তৃতীয় একটি পক্ষের ইন্ধনে হচ্ছে ইত্যাদি। তৃতীয় পক্ষ কি তখন আসলেই আরব বসন্তে অনুপ্রবেশ করেছিল? নিশ্চয়ই করেছিল—কেন করবে না?

নানারকম রাজনৈতিক মত ও পথের লোক তখন ঠিকই রাজপথে ছিল—লাখ লাখ মানুষ যখন রাজপথে থাকে সেখানে তো নানা মত ও পথের লোকজন থাকবেই। কিছু কিছু দুষ্ট পক্ষও নিশ্চয়ই সেখানে ছিল। কিন্তু কথা তো ওঠে তাহলে সেটা—প্রথমেই যেটা বলেছি—আপনি যদি নগরের মানুষের মলমূত্র করার জন্য পর্যাপ্ত আধুনিক টয়লেটের ব্যবস্থা না রাখেন তাহলে আষাঢ় বা শ্রাবণে যখন ঝুম বৃষ্টি নামবে তখন ফুটপাথে জমে থাকা মলমূত্রের স্তূপ নদীতে গিয়ে তো মিশবেই।

জনস্রোত যখন বড় আকার ধারণ করে তখন তো আর মনেও থাকে না স্রোতের শুরুটা কোথায়—বৃষ্টির পানিতে নাকি সেপটিক ট্যাংকের ময়লাতে। আরব বসন্তের ফলাফল কি ভালো হয়েছিল? বিস্ফোরণ যখন শুরু হয় যায়, সেই প্রশ্ন আর তখন প্রাসঙ্গিক থাকে না।

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট