ছবি : সংগৃহীত

কোটা সংস্কারের আন্দোলন ঘিরে এক অন্যরকম বাংলাদেশকে দেখলো সারা বিশ্ব। আর এর নেপথ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ভূমিকা বিশাল।

বলার অপেক্ষা রাখে না বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমগুলোয় এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রথমে ৬ জন শিক্ষার্থী হত্যা এবং পরবর্তীতে এর জের ধরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভের জেরে ২ শতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সুবাদে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

একটি বৈরী পরিস্থিতি অতিক্রম করে দেশ এখন অনেকটাই শান্ত, তবে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাঙচুর আর ধ্বংসলীলার চিহ্ন। এই আন্দোলনটি মূলত দুই ভাগে বিভক্ত; প্রথমভাগের আন্দোলনটি ছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক আন্দোলন এবং দ্বিতীয় ভাগটি ছিল সহিংস সংঘাত, যেখানে সাধারণ ছাত্রদের কোনো ভূমিকা ছিল না, বরং সরকার পতনের লক্ষ্যে এক ধরনের ধ্বংসলীলায় পরিণত হয় এটি।

পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, প্রথমভাগের আন্দোলনের সংবাদগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয় গুরুত্বের সাথে পরিবেশন করা হলেও এর দ্বিতীয় ভাগটি সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমগুলোয় আসেনি, যা এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের জন্য কোনো ইতিবাচক সুবিধা নিয়ে আসতে পারেনি।

আন্দোলনের প্রথমভাগে যেসব গণমাধ্যমগুলো এই সংবাদগুলো গুরুত্বের সাথে প্রকাশ হতে থাকে এদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল আল জাজিরা, যারা কোটা সংস্কারের দাবিতে লাখো ছাত্রের রাজপথে সমবেত হওয়া এবং এর এক পর্যায়ে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন এবং পুলিশের সাথে সংঘাত এবং এর মধ্য দিয়ে ৬ জন ছাত্রের মৃত্যুর খবর দিয়েছে।

এর বাইরে এএফপি, এপি নিউজ, এবিসি নিউজ, ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, আরব নিউজ—এসবের প্রতিটিতেই আন্দোলনের প্রথমভাগের ছাত্রবিক্ষোভ এবং এর জেরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে শিক্ষার্থী নিহতের সংবাদ অনেকটা একইভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

এক্ষেত্রে অনেকটা ব্যতিক্রম ছিল ভারতের গণমাধ্যমগুলো। শুরুতে এই আন্দোলনকে ঘিরে তারা অনেকটা সাদামাটা সংবাদ পরিবেশন করলেও পরিস্থিতি সহিংস আকার ধারণ করার পর থেকে তাদের সংবাদের শিরোনামগুলোও পাল্টে যায়।

এক্ষেত্রে অনেকটা ব্যতিক্রম ছিল ভারতের গণমাধ্যমগুলো। শুরুতে এই আন্দোলনকে ঘিরে তারা অনেকটা সাদামাটা সংবাদ পরিবেশন করলেও পরিস্থিতি সহিংস আকার ধারণ করার পর থেকে তাদের সংবাদের শিরোনামগুলোও পাল্টে যায়।

ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যমের সাথে সাথে পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার, আজকাল, দৈনিক প্রতিদিনসহ সংবাদ পত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোয় গুরুত্বের সাথে বাংলাদেশের সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে এবং আন্দোলনে উভয়-ভাগের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোয় প্রকাশিত এবং প্রচারিত এই আন্দোলনের অগ্রভাগের সংবাদগুলোর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এর কিছু কিছু আমাদের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। ইতিমধ্যে আমরা জানতে পেরেছি এই আন্দোলনের জের ধরে বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিরাও আন্দোলন এবং মিছিল করেছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে এ ধরনের একটি বিক্ষোভের জেরে ৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ আরও ৫৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়েছে। জানা গেছে দেশটিতে বসবাসরত শ্রমিকদের, যাদের ভিসার মেয়াদ ইতিমধ্যে অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, তাদের ভিসা আর নবায়ন না করা এবং বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিষিদ্ধ করেছে দেশটির সরকার।

উল্লেখ্য মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সৌদি আরবের পর আমিরাত বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার, যেখানে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৩ জন এমপি বাংলাদেশ সরকারের বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা জানতে চেয়েছেন। এ সবকিছুই গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে উদ্ভূত।

সাম্প্রতিক সময়গুলোয় সারাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটলেও বৈশ্বিক গণমাধ্যম সূচকে আমাদের অবস্থার অবনমন ঘটেছে। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বরডার্স (আরএসএফ)-এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী ২০২৩ সালের তুলনায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের ২ ধাপ অবনমন ঘটে ৬৫তম স্থানে অবস্থান করছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান ছাড়া এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান অপরাপর দেশগুলোর নিচে। বিশ্লেষকরা বলছেন, একদিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অপরদিকে গণমাধ্যমগুলো কর্পোরেট মালিকানায় নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ফলে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি কাজ করছে। দেশের সাম্প্রতিক অস্থির অবস্থায় আমরা এর কিছুটা সাদৃশ্য দেখেছি।

পরিস্থিতিকে সহনীয় এবং জনজীবনের স্বস্তি আনয়নে সরকার কাজ করছে। হামলা এবং নাশকতার সাথে জড়িত সন্দেহে কয়েক হাজার মানুষকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরাও চাই প্রকৃত অপরাধীরা তাদের অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন পান।

ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাইটগুলোসহ ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দেশের অধিকাংশ মানুষ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত এবং প্রচারিত সংবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন, যা অনেক ক্ষেত্রে অনেককে বিভ্রান্ত করেছে।

আবার একথাও বলতে হবে যে এই আন্দোলন এবং আন্দোলনকে ঘিরে সহিংস পরিস্থিতির শুরুতে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কন্টেন্টগুলো অনেকাংশে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে এবং সরকারবিরোধী তৎপরতায় উদ্বুদ্ধ করেছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে সাময়িকভাবে এগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ফেসবুক এবং টিকটিক কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন কন্টেন্টের বিষয়ে তাদের অবস্থান জানতে চাওয়া হয়েছে। আগামী ৩১ অক্টোবর তাদের প্রতিনিধিদের সশরীরে হাজির হয়ে এ সংক্রান্ত সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে কিছু ভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে দিয়ে একশ্রেণির রাজনৈতিক সুবিধাভোগী মানুষ এর সুবিধা নিতে চেয়েছেন—এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেয়। অন্ততপক্ষে আমাদের রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থাপনায় যে ধরনের হামলা এবং ধ্বংস সাধন করা হয়েছে এর থেকে এটা পরিষ্কার।

পরিস্থিতিকে সহনীয় এবং জনজীবনের স্বস্তি আনয়নে সরকার কাজ করছে। হামলা এবং নাশকতার সাথে জড়িত সন্দেহে কয়েক হাজার মানুষকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমরাও চাই প্রকৃত অপরাধীরা তাদের অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন পান।

অপরদিকে এটাও সবার প্রত্যাশা থাকবে, এর মধ্য দিয়ে কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হন। সেই সাথে সরকারের এটাও স্মরণে রাখা দরকার যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ রাখাও একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতে পারে। গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিত করাও সরকারের দায়িত্ব। এটা করা গেলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার অনেক কমে আসবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ কিছু আন্তর্জাতিক মহলের টার্গেটে পরিণত হয়ে আছে, এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কর্তৃক উদ্ভূত সংবাদগুলো যেন দেশের শান্তিকামী মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য দেশীয় গণমাধ্যমগুলোর অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে সরকারের আরও সচেষ্ট হওয়া উচিত।

ড. ফরিদুল আলম ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়