ছবি : সংগৃহীত

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে থামাতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ঘটনাকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার উপায় নেই। এ আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ, দ্রোহ, তাদের আবেগ এবং যুক্তিসঙ্গত চাওয়া সবকিছুই বুঝতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

আবার, ছাত্রদের আন্দোলন যেভাবে তৃতীয় পক্ষ দখল করে নিয়েছে তাও কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর ফলে সরকারের যেসব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনো সুনির্দিষ্ট হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে তার পরিমাণ অঢেল। এটা কি কেউ আশা করেছিল? নিশ্চয়ই নয়।

রাষ্ট্র যারা চালাচ্ছেন, যারা সরকার গঠন করেছেন তাদের যে জনসম্পৃক্ততা নেই, সাধারণ জনগণের, শিক্ষার্থীর, শ্রমিকের কান্না যে তাদের কাছে পৌঁছায় না, কিংবা পৌঁছালেও এসবের কোনো গুরুত্ব যে তাদের কাছে নেই, তা তারা বারবার প্রমাণ করেছেন।

যে বিষয়টি শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেত তাকে বর্তমান পরিস্থিতিতে নিয়ে এসেছে সরকার। তাদের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হলো, এতদিন ধরে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে কেন সরকারের এই দূরদর্শিতা তৈরি হলো না?

যেকোনো আন্দোলন আমলে না নেওয়ার জন্য সরকার আন্দোলনকারীদের ‘জামায়াত-শিবির’ তকমা দেয়। এই আন্দোলনে তা প্রমাণিত হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবিদাওয়ায় রাজনীতির কোনো গন্ধ ছিল না। কিন্তু সেই আন্দোলনে শেষমেশ মৌলবাদী শক্তির প্রবেশ ঘটেছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এত বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, শ্রমিকরা ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করলে সরকার তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে। তাদের পক্ষে না দাঁড়িয়ে বরাবরই মুনাফাখোর শিল্পগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় তৎপর ছিল তারা।

যতটা সরলীকরণ করে আমরা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে দেখি, সেটা সঠিক না। এদেশের ছাত্রসমাজ সত্য আর মিথ্যা, অধিকার আর অধিকারহীনতা, ন্যায্য আর অন্যায্যতা, সমতা আর বৈষম্যের পার্থক্য ততটাই ভালো করে বোঝেন-জানেন, ততটা আমাদের রাজনীতিবিদরাও বোঝেন না।

এ প্রজন্ম জানে—রাষ্ট্র যারা চালান, ক্ষমতায় যারা থাকেন, তারা প্রত্যেকেই শুধু ‘জি হুজুর’ শুনতে চান। কোনো ধরনের প্রশ্নকে তারা পছন্দ করেন না, ভয় পান। তরুণ প্রজন্ম জানে, প্রশ্নহীন জীবন মৃত্যুর সমান। তাই তারা প্রশ্ন করছে।

শিক্ষক হিসেবে আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী সবাই কি শিবির করছে? যারা সত্যিকার অর্থে জামায়াত-শিবির করে সরকার এত বছরে তাদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি কেন? এই ব্যর্থতা কার?

১৫ বছরের শিক্ষকতা জীবন থেকে আমি দেখেছি, এ রাষ্ট্রের অধিকাংশ শিক্ষার্থী হতাশায় ভোগে। প্রথম প্রথম আমার মনে হতো, ব্যক্তিজীবন, ক্যারিয়ার ইত্যাদিই হয়তো এই হতাশার মূল কারণ। কিন্তু যখন তাদের কাছ থেকে বোঝার চেষ্টা করি তখন দেখি, রাষ্ট্রের সর্বত্র দুর্নীতি, বিচারহীনতা, বৈষম্য, চাটুকারিতা, অন্যায্যতা, অসমতা, ক্ষমতার দাপট শিক্ষার্থীদের হতাশ করে তুলছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন আসলে হঠাৎ ফোটা কোনো ফুল নয়, বরং দীর্ঘদিনের পুষে রাখা ক্ষোভ, হতাশা, জেদ, অক্ষমতার তুমুল বহিঃপ্রকাশ। এতদিন ধরে চলা আন্দোলন ২১ জুলাই ২০২৪-এ সরকার মেনে নেয়।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় সামগ্রিকভাবে বাতিল (রদ ও রহিত) করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় প্রদান করা হয়। রায়ে বলা হয়, কোটাপ্রথা হিসেবে মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো।

১৫ জুলাই ২০২৪ থেকে চলা আন্দোলন সামাল দিতে সরকারের এতদিন লাগলো কেন? এর উত্তর দেবে কে? যাদের প্রাণ গেল তাদের পরিবারকে উত্তর দেবে কে?

দৃষ্টি এবার একটু ভিন্ন দিকে ফেরাই। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন যেসব উপাচার্য নিয়োগ পেয়েছেন তাদের অধিকাংশই দলকানা, অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন। তারাও সরকারকে সঠিক বার্তা দিতে পারেননি।

অবশ্য তাদের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো সার্ভিস প্রত্যাশা করাটাও বোকামো। এসব প্রশাসকের জনপ্রিয়তা বা যোগ্যতা এতটাই কম যে, তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো আস্থাই অর্জন করতে পারেন না। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করতে পারেনি বিচারবিভাগও। এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল?

১৫ বছরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের তালিকা করে তাদের কীর্তির একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করলে দেখা যাবে, এদের অধিকাংশই দুর্নীতি, স্বজনপ্রিয়তা, দলবাজি, অর্থলিপ্সুতা, প্রকৃতি বিনাশসহ আরও অনেক কাণ্ড ঘটিয়েছেন।

অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীবান্ধব, দেশপ্রেমিক, সৎ, যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিলে আজ পরিস্থিতি ভিন্ন রকমের হতো। কিন্তু আমাদের ভাগ্যই হয়তো এমন যে, যেই যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ।

তা না হলে, এত বছরে বারবার আমাদের এত গণতন্ত্রহীনতার মুখোমুখি হতে হবে কেন? এত সহিংসতা দেখতে হবে কেন? এসব তো আমরা শেষ করে এসেছিলাম গত শতাব্দীতে। ন্যায্যতার লড়াইয়ের যে আগুন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে বেড়াচ্ছে এদেশের জনগণ সে আগুন চাইলেও নেভাতে পারবে না।

ড. পারভীন জলী ।। অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়