ছবি : সংগৃহীত

স্লোগান একটি জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় পরিচয় বিনির্মাণের আন্দোলন ফুটিয়ে তোলার নিয়ামক। স্লোগান ব্যবহার করে চালিত গণসংযোগ সংশ্লিষ্ট আন্দোলনরত গোষ্ঠী তাদের পছন্দের রাজনৈতিক, শ্রেণীভিত্তিক, সামাজিক, গোত্রীয়, ধর্মীয় পরিচয়কে, তাদের সাথে ঘটা অন্যায়, অত্যাচার, বঞ্চনাকে তাদের দাবিতে প্রতিফলিত করতে ব্যবহার করে।

এটি এমন এক হাতিয়ার যার ব্যবহারে রক্তপাত হয় না কিন্তু অস্ত্রের চেয়ে শক্তিশালী রূপে মানুষকে এক মত এক দাবিতে সংযুক্ত করতে পারার ক্ষমতা রাখে। ১৯৬৯ সালের আইয়ুব পতন আন্দোলনে তৎকালীন ছাত্রসমাজের বিখ্যাত ‘তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি’ স্লোগানটি এ ভূখণ্ডের স্বাধীন বাংলাদেশ পরিচিতি, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মর্যাদার বেদি স্থাপন, বাঙালি চেতনা, ঐক্য ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের গোড়াপত্তন করে। আজও এই স্লোগানের রাজনৈতিক তাৎপর্য অসীম যা বাংলাদেশি নাগরিক তথা সব বাঙালি ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির মানুষদের রোমন্থন করে।

স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমানে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রসমাজ একই আদলে স্লোগান মুখর হওয়ার চেষ্টা করলেও তা বিতর্ক সৃষ্টি করে। ছাত্রদের শাব্দিক অসতর্কতা দৃষ্টিকটু ও হতাশাব্যাঞ্জক। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পর একটি ছাত্র আন্দোলনে রাজাকার শব্দের উচ্চারণ কী করে এলো?

স্বাধীন বাংলাদেশে মূলধারার সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহৎ ছাত্র আন্দোলন কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত হয় ২০১৮ সালে যার ফলশ্রুতিতে দেশের সরকারি চাকরিতে প্রবেশে সব ধরনের কোটা বাতিল করে শুধুমাত্র মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হওয়ার বিধান করে নির্বাহী বিভাগ।

পরবর্তীতে ২০২৪ সালে অতিসাম্প্রতিক সময়ে কোটা পুনর্বহাল করার বিচারিক ও নির্বাহী আদেশে নতুন করে চাকরিতে কোটার যৌক্তিক বণ্টনের বিষয়টি উঠে আসে যা নতুন সংস্কার আন্দোলনের দিক উন্মোচন করে। বর্তমানে তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামে চলমান রয়েছে।

সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন সংক্রান্ত বিষয়ে চীন সফর পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে জনৈক সাংবাদিকের করা এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা কোটা পাবে না তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?’ মন্তব্যটিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

সংক্ষুব্ধ হয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া স্বরূপ তারা বহুল আলোচিত-সমালোচিত স্লোগান ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার সরকার’ (মতান্তরে তুমি নই আমি নই) দিয়ে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ প্রকম্পিত করে তোলে। এই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখানোর বিষয়টি পুরো আন্দোলনের পূর্বাপর ও চলমান গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। রাজাকার শব্দটির প্রসঙ্গ এনেছিল মূলত ঐ সম্মেলনের প্রশ্নকারী সাংবাদিক।

বিশিষ্টজনের অনেকের মতে, কিছু সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা সরকারি চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় চাকরি প্রার্থী হিসেবে রাজাকারের নাতি ও মুক্তিযোদ্ধার নাতি নিয়ে পার্থক্যকরণের জটিল প্রশ্নের জেরে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যে রাজাকার প্রসঙ্গটি চলে আসে। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রসমাজকে রাজাকার বলে অভিহিত করেছে এই মর্মে আন্দোলনকারীরা তার বক্তব্যের বিরোধিতা ও প্রত্যাহার দাবি করে।

যেকোনো গণআন্দোলন গণসম্পৃক্ততা পায় মূলত তার স্লোগানে জনগণের দাবি-প্রতিফলিত সুর, ভাষাগত যৌক্তিকতা, ব্যঞ্জনা, সহজ উচ্চারণ, আকর্ষণীয়তা ও বিষয়ভিত্তিক প্রাসঙ্গিকতার ওপর ভর করে। রাজাকার শব্দের ব্যবহার এর আগে ২০১৩ শাহবাগে গণজাগরণের আন্দোলনে ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’ স্লোগানেও করা হয়। স্লোগানের ভাষা হবে নিষ্কলঙ্ক, নিখাদ, নির্ভেজাল, নিপাট কলঙ্কমুক্ত। কিন্তু রাজাকার শব্দের বর্তমান ঢালাও ব্যবহার অত্যন্ত নিন্দনীয় ও বিপদজনক যা সামাজিক সংকটাপন্ন অবস্থার বিপদসীমাকে অতিক্রম করে গেছে, যার ভয়াবহ পরিণতি লক্ষণীয়।

স্লোগানের ঐতিহাসিক ও ভাষাগত সতর্কতার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে স্লোগানের বিশ্বব্যাপী ব্যবহার ও ভাষাগত প্রয়োগ বিশ্লেষণ জরুরি। ষোড়শ শতকের দিকে বহু স্লোগানের দেখা মেলে যা মানুষের রাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক দাবিগুলোর উপযুক্ত চিত্রায়নের কারিগর। এর মাঝে আছে ইট দ্য রিচ (ধনীদের ভক্ষণ করো) নামক স্লোগান। এটি শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণিসংগ্রাম ও সম্পদ পুনর্বণ্টন সংক্রান্ত ১৭৯৩ সালের পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল স্লোগান ছিল। ১৯৬০ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের স্লোগান ছিল মেক লাভ, নট ওয়ার (ভালোবাসো, যুদ্ধ নয়)।

ঊনবিংশ শতকের সুদূরপ্রসারী স্লোগান ভিত্তিক আন্দোলনের প্রথম সারিতে আছে ব্যক্তিস্বাধীনতার পুণ্যভূমি খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকান ড্রিম-এর মতো স্লোগান যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই স্লোগানের পাবলিক কানেক্টিভিটিকে লালন করে জাতিগত ঐক্য সমুন্নত রাখতে। সতের'শ সালের দিকে পেট্রিক হেনরির আমেরিকান বিপ্লবের সময় বলা স্লোগান গিভ মি লিবার্টি অর গিভ মে ডেথ (আমায় স্বাধীনতা দাও, নয়তো মৃত্যু দাও) এর জনক।

১৯১২ থেকে ২০২০ নাগাদ মনকাড়া কাব্যিক স্লোগান ভিত্তিক বেশকটি বিশ্ব কাঁপানো আন্দোলন ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯১২ সালের লরেন্স টেক্সটাইল স্ট্রাইকে শিল্পকারখানার নারী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন লীগের কর্মীরা আন্দোলন করে ন্যায্য পারিশ্রমিক, শ্রমিকদের আত্মমর্যাদা ও নাগরিক অধিকারের দাবিতে করা আন্দোলনের স্লোগান ছিল ব্রেড অ্যান্ড রোজেস (রুটি ও গোলাপ) অর্থাৎ কাজের ন্যায্য মজুরি, নাগরিক সুবিধার সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সম্মানের লড়াই।

এরপর কমিউনিজম বিরোধী মনোভাব প্রকট হওয়ার সময়টায় ১৯৫০ সালের শেষ দিকটায় অ্যান্টি কমিউনিজম আন্দোলন তীব্র হয় যার স্লোগান ছিল বেটার ডেড র‍্যাদার রেড বা ‘সাম্যবাদের চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়’। উল্টো দিকে সাম্যবাদীদের বেটার রেড র‍্যাদার ডেড অর্থাৎ ‘মৃত্যুর চেয়ে সাম্যবাদ শ্রেয়’ স্লোগানটি অবশ্য বারটান্ড রাসেল সমর্থনপুষ্ট ছিল।

তিনি বলেন, সাম্যবাদের বিকল্প না থাকলে মানব অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার চেয়ে সাম্যবাদ উত্তম। ১৯৬০ এর দিক আমেরিকান আফ্রিকান কৃষ্ণবর্ণের জনগণ গোটা আমেরিকাকে সোচ্চার করতে উদ্যত বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে। গায়ের রং জনিত কুৎসা, অত্যাচার ও বৈষম্য বিরোধী এই আন্দোলনের স্লোগান ছিল ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল বা ‘কৃষ্ণবর্ণ সুন্দর’।

কিন্তু বিশ্বের অন্যতম এ পরাশক্তি বর্ণবাদের যে বিষবাষ্পে জর্জরিত তা ২০১৩ সালে ঘটে যাওয়া বেঞ্জামিন মার্টিন নামের কৃষ্ণাঙ্গ যুবক ও ২০২০ সালের জর্জ ফ্লয়েডের পুলিশি সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনায় আরও একবার সামনে আসে। প্রথমটি ফ্লোরিডা বনাম জিমারম্যান মামলায় মার্টিনকে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগে অভিযুক্ত জর্জ জিমারম্যান নামক নেইবর ক্রাইম ওয়াচ সদস্য বেকসুর খালাশপ্রাপ্ত হবার ঘটনা আর দ্বিতীয়টি জর্জ ফ্লয়েড নামক ৪৬ বছর বয়সী নিরস্ত্র প্রবীণকে বিনা কারণে প্রকাশ্যে দায়িত্বরত পুলিশ কর্তৃক শ্বাসরোধে হত্যা।

দুটো ঘটনায় আমেরিকান জাতি সহিংসতা বিরোধী জোরালো গণজাগরণ দেখতে পায় যা ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার স্লোগানে সারা বিশ্বে ব্যাপক সাড়া পায়। ২০২০ সালের জর্জ ফ্লয়েড হত্যার আন্দোলনটি আমেরিকান ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণআন্দোলন যা আই কান্ট ব্রিদ নামেও পরিচিতি লাভ করে। স্লোগান দুটোয় একই প্রতিপাদ্যের প্রতিফলন দেখা যায় যা আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ জাতিগোষ্ঠীর বর্ণবাদী বঞ্চনার শিকার হওয়ার বিষয়টির সংক্ষিপ্ত, কার্যকরী শক্তিশালী ন্যারেটিভ সৃষ্টি করে।

কমিউনিস্ট লাল রং চেতনার আদর্শিক ‘কমরেড, লাল সালাম’ স্লোগানটি দক্ষিণ এশিয়াতে বহুল প্রচলিত। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষত ব্রিটিশ বিরোধী নানা আন্দোলনে স্বদেশী রাজনীতির ভিত্তিপ্রস্তর সংস্থাপন তথা রাজনৈতিক পরিকল্পনার সফল পটভূমি তৈরিতে স্লোগানের অত্যন্ত কার্যকরী প্রভাব লক্ষণীয়। ১৯২৯ সালের ইনকিলাব জিন্দাবাদ বা ‘বিপ্লব অমর হোক’ স্লোগান ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের গণজোয়ার তৈরিতে অন্যতম ভূমিকা রাখে। এসব ন্যায়ভিত্তিক আন্দোলনে স্লোগানের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাবের ব্যাপ্তি নিয়ে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।

১৯৮৯ সালে চীনের তিয়েনমেন স্কয়ারে ছাত্রনির্যাতন বিরোধী গণআন্দোলনের স্লোগান ছিল বয়কট ক্লাস, নট স্টাডি (ক্লাস বয়কট করো, পড়াশোনা বয়কট নয়), গিভ মি ডেমোক্রাসি অর গিভ মি ডেথ (আমাকে গণতন্ত্র দাও নয়তো মৃত্যু দাও), পেট্রিয়টিজম ইজ নট ক্রাইম (দেশপ্রেম অন্যায় নয়)।

২০১৯ সালের গ্রিটা থানবার্গ গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইক বা বিশ্ব পরিবেশ আন্দোলনের কর্ণধার হিসেবে যখন হাউ ডেয়ার ইউ! (এত বড় সাহস!) উক্তিটি উচ্চারণ করে তখন তা সাদরেই গৃহীত হয় এর যৌক্তিক বাক্য বিন্যাসের কারণে। এমনকি জগৎ কুখ্যাত নাৎসি বাহিনীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্লোগান ব্লাট এন্ড বডেন (নাৎসি আদর্শের জাত বা উৎকৃষ্ট রক্ত এর মানুষ ও তাদের জন্যে ভূমি) যার মানে নাৎসি রক্ত ও মাটি প্রতিষ্ঠা, এই বাক্যটির মাঝেও গালিসূচক অর্থের প্রয়োগ ঘটেনি। অর্থাৎ স্লোগানের যৌক্তিক শব্দবিন্যাস যেকোনো আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠিত ও বিশ্ব পরিচিতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব রাখে।

বাংলাদেশের জন্ম নেওয়ার সংগ্রামে স্লোগানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সবচেয়ে প্রবলতর। বাংলাদেশ স্বাধীন করার ইতিহাস সর্বজনস্বীকৃত ও লালিত জয় বাংলা নামক এই একটি স্লোগানের সুদূরপ্রসারী ব্যবহারে নিহিত। ‘জয় বাংলা’ শব্দ গুচ্ছের আবিষ্কারক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২২ সালে তার লেখা পূর্ণ অনির্বাণ কবিতায় তিনিই সর্বপ্রথম এটি ব্যবহার করেন। তবে জয় বাংলা স্লোগানের পরিচিতি ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি পায় ১৯৫২ এর ভাষা সংগ্রামের হাত ধরে।

১৯৬৯ সালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তাদের ১১ দফা দাবিতে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে রেসকোর্স ময়দান পরিষদ কর্তৃক শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করার মুহূর্তে জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়। শেখ মুজিব সেদিন থেকে জয় বাংলা স্লোগানটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেন ও রাজনৈতিক বক্তব্যের ব্যবহার করেন। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণাটি জয় বাংলা স্লোগানে শেষ হয় যার দরুন স্লোগানটি গণমানুষের স্লোগানে পরিণত হয়।

১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত নানান মাত্রায় অভিনব আঙ্গিকে শব্দের ঝলমলে অনুরণনের উল্লেখযোগ্য সাড়া জাগানিয়া স্লোগান শুনি যা অনেকটা শিল্পীর আঁচড়ে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভাষার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি পুরো আলাদা রাষ্ট্র বিনির্মাণের নকশা আঁকতে রংতুলির ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ও জাতীয় মুক্তি একরকম স্লোগান নির্ভর বলে চলে।

১৯৫২ সালে একই রাষ্ট্রে এক ভাষা নীতির বিরোধিতা, বাংলা ভাষার মর্যাদা ব্যবহারের বৈধতা ও বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে মূলত রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়। এ স্লোগান আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান আমলে সর্বপ্রথম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বীজ রোপণ করে হয়।

অন্যান্য স্লোগানের মাঝে ছিল ১৪৪ ধারা মানবো না; রোমান হরফে বাংলা লেখা চলবে না; চলো চলো অ্যাসেম্বলি চলো এর মতো স্লোগান যা মুহূর্তের মধ্যে পুরো ছাত্রসমাজকে জড়ো করে ফেলতো। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ও স্বাধীন দেশের মর্যাদা প্রাপ্তির পেছনে এই উত্তপ্ত জ্বালাময়ী স্লোগানের সমুচ্চারিত ও সর্বস্তরের অংশগ্রহণ মূল ভূমিকা পালন করে।

কিছু স্লোগান যেমন, তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ; বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো; পিন্ডি না ঢাকা? ঢাকা, ঢাকা; পাঞ্জাব না ঢাকা? ঢাকা, ঢাকা; জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো; জাগো বাঙালি জাগো ইত্যাদি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে বেগবান করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।

এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ছাত্রদের শক্তি দুর্দমনীয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসমাজ দেশের পুরো ছাত্রসমাজের প্রতিনিধি। তাদের দ্বারা আহ্বায়িত, পরিচালিত ও সমন্বিত আন্দোলনে এই বিষয়গুলোর সঠিক প্রতিফলন আরও বেশি প্রত্যাশিত কারণ তারা জ্ঞান, যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মানবিকবোধ দীক্ষায় অনন্য।

তাদের আন্দোলনের ভাষা সংবেদনশীলতা থাকবে সবচেয়ে বেশি, অন্য যেকোনো ছাত্র আন্দোলন বা নাগরিক আন্দোলন থেকে স্পষ্টত ও গাঠনিকভাবে আলাদা ও স্বতন্ত্র। কিন্তু রাজাকার বলে পরিচয় দেওয়াটাও মুর্খামি। ‘তুমি কে’ আর ‘আমি কে’ দুটোই একেকটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য, পূর্ণ প্রশ্ন। এর উত্তরে ব্যবহার করার শব্দটি সেই প্রশ্নে জানতে চাওয়া পরিচয়কে ফুটিয়ে তোলে। বাক্যের বিন্যাসটি ত্রুটিপূর্ণ যা যেকোনো নাগরিকদের বিচলিত করবে।

পুরো স্লোগানের প্রথম দুই পঙ্‌ক্তি স্পষ্টত প্রশ্নোত্তর আদলে বলায় ও দ্বিতীয় লাইনটিতে নিষিদ্ধ শব্দের উচ্চারণ থাকায় পরের দুই লাইনের দিক কারও মনোযোগ টানতে স্লোগানটি ব্যর্থ হয়েছে। ফলে পুরো স্লোগানের রিপ্রেজেন্টেশন বিতর্কের জন্ম দেয়। বিবৃতির পর পর ছাত্রসমাজের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ও সমস্বরে বারংবার ব্যবহার স্লোগানটির সচেতন প্রয়োগকে নিশ্চিত করে। এর ফলে স্লোগানের জাস্টিফিকেশন দেওয়াটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই স্লোগানের ভাষা পরিবর্তিত করে রাজাকার শব্দটি সম্পূর্ণ উহ্য রাখাই সমীচীন হতো।

উপরের আলোচনায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গণআন্দোলনের স্লোগান টার্মিনোলজি সংক্রান্ত বিশ্লেষণে যে স্লোগানগুলো নেওয়া হয়েছে এগুলোর কোনোটাই গালিসূচক, অবমাননামূলক, জাতীয় সত্ত্বার সাথে সাংঘর্ষিক, জাতিগত ও রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ বিতর্কিত শব্দের ব্যবহার নেই। বরং মূল দাবির বিষয়বস্তুকে সংক্ষেপে চুম্বকীয় আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতি হিসেবে অস্তিত্বের লড়াই, জাতীয় মুক্তি, সার্বভৌমত্বের সাথে রাজাকার শব্দটি জাতিগত, নীতিগত, আইনগতভাবেও সরাসরি সাংঘর্ষিক। রাজাকার শব্দটি ১৯৭১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আল বদর, আলশামস নামক দেশীয় দোসর কর্তৃক পাকিস্তানি আর্মির বাঙালি-নিধন নৃশংসতায় সহযোগিতা ও পাকবাহিনীর পদলেহনকারীদের গর্হিত অপরাধগুলো প্রতিনিধিত্ব করে।

ছাত্র আন্দোলনে এই শব্দের ব্যবহার থেকে বিরত থাকা এজন্য জরুরি যে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গোষ্ঠীর পরিচয়ে পরিচিতি দেওয়াটা অনুচিত, তা সে যেই আবেগে, যেই দৃষ্টিকোণ থেকে বা যেই প্রেক্ষাপটেই বলা হোক, স্লোগানের ভাষা বিতর্কিত হলে তা সেই স্লোগানের আন্দোলনকেও বিতর্কিত করে ফেলে। নেহায়েত আবেগ বশবর্তী সিদ্ধান্তে প্রতিক্রিয়া জানান দেওয়াটা অদূরদর্শিতা। মেটাফরিক, রিয়াক্টিভ, রেট্রিবিউটিভ বা এক্সিডেন্টাল বা স্লিপ অব দ্য টাং যে কারণই দেখানো হোক, রাজাকার শব্দের ব্যবহার তাই কোনো ক্রমেই জাস্টিফাই করা যায় না।  

যেহেতু আন্দোলনটি সংস্কারমূলক এতে শব্দের পরিশীলন, মার্জিত পরিবেশন ও সংস্কারের বিষয়টিও বিবেচ্য। যারা কোনো বিষয়ে আন্দোলন করেন তাদের কাছে স্লোগান একটি পবিত্র অভিব্যক্তি। তাই প্রতিক্রিয়া জ্ঞাপনের ভাষাটাও হতে হবে যৌক্তিক ও সচেতন। উচ্চ মহলের রাজাকার নিয়ে করা মন্তব্যের জবাব কী স্লোগানের সঠিক গাঁথুনি দিয়ে দেওয়া যেত না?

নিজের গায়ে রাজাকার শব্দের কালিমা লেপনের মতো লজ্জাজনক কাজ বোধ করি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও করবে না। সেখানে ছাত্র সমাজ এরকম ভুল কীভাবে করে? একটি শব্দের অবহেলামূলক ব্যবহার পুরো আন্দোলনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালো। কেউ গালি দিলেই উল্টো গালি দিতে হবে এই ধারণা আমাদের সাধারণ মানুষের মজ্জাগত।

এখানে অনেকের প্রশ্ন হলো, প্রধানমন্ত্রীর মতো সর্বোচ্চ জাতীয় নীতিনির্ধারক পদের থেকে এমন মন্তব্য মানায় কিনা। তাদের মতে, সম্মেলনে উপস্থিত দুইপক্ষ মিডিয়া ও স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উভয়ের বক্তব্যে রাজাকার প্রসঙ্গটি অনুপস্থিত থাকলে বা, যেকোনো এক পক্ষ শব্দটি এড়িয়ে গেলে হয়তো মুক্তিযোদ্ধাদের করা স্বাধীন দেশে রাজাকার শব্দের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার দেশবাসীকে শুনতে হতো না।

এখানে একটি বিষয় দ্রষ্টব্য যে, নির্দিষ্ট একটি প্রশ্নের জবাবে (যে প্রশ্নটিই টেকনিক্যালি রাজাকার শব্দ ব্যবহার করে করা হয়েছে) প্রধানমন্ত্রী উত্তরটি দিয়েছিলেন। প্রশ্নের বিষয়বস্তুতেই রাজাকার শব্দটি রাখা হয়। প্রশ্নটি ছিল যে, সরকারি চাকরির মৌখিক পরীক্ষায় যদি দুজন সমান মার্কস প্রাপ্ত প্রার্থীর একজন মুক্তিযোদ্ধার নাতি ও আরেকজন রাজাকারের নাতি হয়, তাহলে কাকে চাকরিটি দেওয়া হবে। মূল প্রশ্নকর্তাই মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার শব্দ সম্বলিত প্রশ্নটি করে।

জবাবে উত্তরদাতা ঐ কন্টেক্সটে প্রশ্নকর্তাকে উত্তর দেন। সহজ করে ভাবলে, ধরা যাক, প্রশ্নটি ছিল ‘রাজাকারের সন্তান পাবে না মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পাবে?’ আর উত্তরে বলা হলো ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান পাবে না তো কি রাজাকারের সন্তান পাবে? দেশবাসীর কাছে প্রশ্ন’। উত্তরদাতাও আরেকটি প্রশ্ন দিয়েই কিন্তু উত্তরটি সমাপ্ত করলেন।

এখানে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যায় যে, মূলত প্রশ্নটিই বিতর্কিত। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করা মুক্তিযোদ্ধারা কোনো সুবিধা পাবে কি পাবে না বা কতটুক পাবে সে প্রশ্নে রাজাকার শব্দটি কী করে আসে? যেহেতু কোটা আন্দোলন নাগরিক সংশ্লিষ্ট বিষয় ও সংস্কারমূলক (বাতিল নয়) আন্দোলন সেটি সাধারণ নাগরিকদের অধিকার নিয়ে জড়িত বিষয়, সাধারণ নাগরিকদের মাঝে যারা মুক্তিযোদ্ধা আছেন তারাও দেশের নাগরিক।

মুক্তিযোদ্ধারা যেহেতু দেশ স্বাধীন করেছেন তারা সুবিধা পেতেই পারেন সেটি নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্ত, যেহেতু সংবিধান সরকারকে অনগ্রসর জাতির জন্য বিশেষ সুবিধা রেখে বিধান তৈরি করার ক্ষমতা দেয়। আন্দোলনের বিষয় হলো, সে সুবিধা কত শতাংশ হওয়া যৌক্তিক? এখানে রাজাকার শব্দ কী করে আসে?

রাজাকার শব্দটাই তো নিষিদ্ধ। একটি নিষিদ্ধ দণ্ডিত শাস্তিপ্রাপ্ত গোষ্ঠী কী করে চাকরি পাওয়ার বিষয়ের মুখ্য বস্তু হয়? যার নাগরিকত্ব বাতিল তার চাকরি, উপরন্তু সরকারি চাকরি পাওয়ার প্রশ্ন আসে কী করে? আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে যারা দণ্ডপ্রাপ্ত তারা নাগরিক আন্দোলনের বিষয়বস্তু হয় কীভাবে? প্রশ্ন করার জন্যে কেন রাজাকার শব্দটিই মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে জড়ানো হলো?

কোটা আন্দোলনের মূল প্রতিপাদ্য একটি দুটি নয়, কয়েকটি—

ক) সরকারি চাকরি

খ) কোটা সুবিধা

গ) মুক্তিযোদ্ধা কোটা

ঘ) অন্যান্য কোটা [নারী, পোষ্য, রেলওয়ে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী]

ঙ) অনগ্রসর জাতির সংজ্ঞা

চ) চাকরিতে সমতা ইত্যাদি।

আন্দোলনের বিষয়বস্তুর কোথাও রাজাকার নিয়ে কথা আসেনি। সুতরাং, মুক্তিযোদ্ধা নাগরিক ও সাধারণ নাগরিকদের সন্তানের বা নাতিপুতিদের চাকরি সম্পর্কিত কোটা সুবিধার প্রশ্নে রাজাকার শব্দটি প্রাসঙ্গিক হয় কীভাবে? কী করে চাকরি সংক্রান্ত কোটার বিষয়ে রাজাকার শব্দ আসে যেখানে রাজাকাররা নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতই না? কেন আন্দোলনের গতিবিধি, যৌক্তিকতা বা অন্য প্রতিপাদ্য নিয়ে কথা না বলে রাজাকার শব্দটিকেই বেছে নিতে হলো প্রশ্নকর্তার?

নাগরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রশ্নটি সুচিন্তিতভাবে ছাত্রদের খ্যাপানোর উদ্দেশ্যে করা ধৃষ্টতা। তারা বলছেন, সম্মেলনে উপস্থিত কতিপয় মিডিয়া মূল প্রেক্ষাপটকে আড়াল করে মূল প্রশ্নটিকে হাইলাইট না করে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরে ফোকাস করলো যা ভুল বোঝাবুঝির উদ্রেক করে। মিডিয়া ব্যাপারটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করলেও রাজাকার শব্দটির প্রসঙ্গ উক্ত প্রশ্নকর্তা এবং উত্তরদাতার মাঝে সীমিত থাকলে হয়ত চলমান সহিংসতার পরিস্থিতিই তৈরি হতো না।

ছাত্ররা অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে মূল দাবি আদায়ে না থেকে একটি শব্দের ঘোরপ্যাঁচে পড়ে দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখালো। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরা যেটিকে বলছে ‘ন্যারেটিভ স্ট্রাগল’। যেহেতু তারা আদালতের আদেশ যথেষ্ট স্বস্তিকর মনে করেনি ও যেহেতু তাদের সরাসরি দাবি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে, তবে একটি ন্যারেটিভগত বিতর্কে জড়ানো কেন? এতে লাভ বা ক্ষতি কার হলো?

নির্বাহী বিভাগ ও ছাত্রসমাজ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে গেল। ছাত্ররা এর যৌক্তিক বিশ্লেষণ করে সঠিক বাক্যে স্লোগান সাজিয়ে এর প্রতিবাদ করলে মূল আন্দোলনের ওপর অপবাদ আসতো না। ফলশ্রুতিতে আন্দোলনকে রাজাকার শব্দযুক্ত স্লোগান ব্যবহার করে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার সুযোগ করে দিলো।

যৌক্তিক দাবি শব্দগত বিতর্কে জড়ায় ছাত্রদের এমন বিবৃতি দেওয়া অনুচিত। ছাত্রআন্দোলনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আঘাতকারী জাতিগতভাবে নিষিদ্ধ শব্দ উচ্চারণ সেই আন্দোলনকে অপবিত্র করে। গণআন্দোলন মানে নিজেদের দাবি পুরো জাতির কাছে তুলে ধরা হচ্ছে যা মিডিয়াসহ সারা দেশ দেখছে। তাই এই আন্দোলনে যেকোনো শব্দের ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রদর্শন বাঞ্ছনীয়।

কোন শব্দ কেন ব্যবহার করছি, আন্দোলনের দাবির সাথে তা প্রাসঙ্গিক কিনা, সে শব্দের আক্ষরিক অর্থ, ব্যাখ্যা, এর অতীত ইতিহাস এসব বিবেচনা করতে হয়। রাজাকার শব্দটি আমাদের জন্যে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। রাজাকার শব্দের ইতিহাস অত্যন্ত নির্মম ও ঘৃণিত। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে দেশের বাসিন্দা হয়ে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী অত্যাচারী পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীদের সাধারণ মানুষের ওপর করা অত্যাচারের পথ সুগম করে দেওয়া, হত্যা, খুন, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, সম্পদ ধ্বংসসহ গণহত্যা বাস্তবায়নের মাস্টারপ্ল্যান সাজানোর মতো কাজ রাজাকার বাহিনী সুনিপুণভাবে করে। সেসব রাজাকারদের ন্যক্কারজনক ভূমিকা রাজাকার শব্দটিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শব্দ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে।

পলাশীর পরাজয়ের মূল হোতা মীরজাফর নামটি যেমন অবিভক্ত বাংলার ইতিহাসে চির ঘৃণিত ও বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক শব্দে পরিণত হয়, তেমনি রাজাকার শব্দটি বাংলাদেশিদের জন্য গালিসূচক বা তার চেয়েও ঘৃণিত শব্দ। তাই রাজাকার শব্দে স্লোগান মুখর হওয়াটা মেধাবীদের জন্যে অত্যন্ত বেমানান ও নিন্দনীয়। স্লোগানে রাজাকার শব্দের ব্যবহার একটি যৌক্তিক ছাত্র আন্দোলনকে রাজনৈতিক খাতে প্রবাহিত করে দিলো যা মূল দাবি আদায়ের পথকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।

সফল আন্দোলন চালাতে হলে আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা ও এর প্রতিনিধিদের শব্দের রাজনৈতিক প্রয়োগ, কৌশলগত দিক, মর্মার্থ নিয়ে আরও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। সেই সাথে সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে শান্তিপূর্ণ সক্রিয়তায় আন্দোলনকে যেকোনো বিতর্কের বাইরে রাখতে জোর তৎপরতা ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। সমালোচনার মুখে স্লোগানের ধরনে পরিবর্তন আনাটাও আন্দোলনে লক্ষণীয়, পরিবর্তিত স্লোগানটিতে ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ বলা হয়।

স্লোগানের আইনি প্রয়োগ ও আইন করে নিষিদ্ধকরণের ক্ষমতা যেকোনো দেশের সরকারের রয়েছে। সম্প্রতি জার্মানের বার্লিনে প্রোপ্যালেস্টাইন জনপ্রিয় স্লোগান ‘From the River to the Sea, Palestine will be free' ইসরায়েল বিরোধী বলে সেটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ও জাতিগত উসকানিমূলক অভিহিত করে একে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে আখ্যা দিয়ে জেল জরিমানার শাস্তির বিধান রেখে আইন পাস করা হয়েছে।

একইভাবে ফ্রান্স ইসরায়েল বিরোধী স্লোগানকে নিষিদ্ধ করে। আমেরিকান মন্ত্রিসভায় একই প্রস্তাব করা হলেও তা পাস হয়নি ও স্লোগান নিষিদ্ধকরণকে ফ্রিডম অব স্পিচ বা মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকারের পরিপন্থী বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের আইনে স্লোগানের সাংবিধানিক ব্যবহার নিয়ে সরাসরি কোনো উল্লেখ নেই। জয় বাংলা স্লোগানের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে পালন করতে ২০২০ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ‘জয় বাংলা’কে জাতীয় স্লোগানের স্বীকৃতি দেন।

২০২২ সালে বর্তমান সরকার জয় বাংলা স্লোগানকে আনুষ্ঠানিক রূপে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা করে ও প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিবসে সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক ও ছাত্রদের এটি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে এই স্লোগানের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা স্থাপন করে। কিন্তু কোনো স্লোগানের আইনগত বাধা নিয়ে বা অসাংবিধানিকতা নিয়ে সরাসরি কোন বিধানের উল্লেখ আমাদের সংবিধান বা অন্য রাষ্ট্রীয় আইনে নেই। বাংলাদেশে সরাসরি স্লোগান নিষিদ্ধকরণ আইনি বিধান না থাকায় এর প্রয়োগে চলমান অস্থিতিশীল সামাজিক অবস্থা সামলানো যায়নি।

এমতাবস্থায় জরুরি বৈঠক ডেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজাকার শব্দ ব্যবহৃত স্লোগানটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বিধান প্রণয়নপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যেত। সময় সাপেক্ষতার বিচারে আদেশ জারির মাধ্যমে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া যেত। কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রদের নিরাপত্তার জন্যে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। নিষিদ্ধ শব্দ প্রয়োগ অবশ্যই নিন্দনীয় কিন্তু যেকোনো বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও আইনসঙ্গত উপায় অবলম্বনের বিকল্প নেই।

ছাত্রদের উচ্চারিত রাজাকার শব্দ যেমন অস্বস্তিকর, মন্ত্রীর ‘মাঠে জবাব দেবে’ মূলক মন্তব্যও অমূলক। ছাত্ররা দেশ চালানোর বোধ সম্পন্ন নয়, তাদের মাথা গরম করা অবুঝ কর্মকাণ্ড করাটা বোঝা যায় কিন্তু দেশ চালানোর দায়িত্বে থাকা সরকার ছাত্র সুলভ রাগ ক্ষোভ দেখানোটা মানায় না। দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের থেকে দেশের জনগণ আরও দায়িত্বশীল বক্তব্য আশা করেন। ছাত্রদের বিরুদ্ধে ছাত্র সংগঠনকে উসকে না দিয়ে সরকার পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার পদক্ষেপ নিতে পারতেন।

কারণ দর্শানোর সুযোগ প্রদান না করে অতর্কিতে ছাত্রদের ওপর হামলা বরং দৃষ্টিকটু ও একইরকম আবেগিক শিশুসুলভ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বিষয়। ছাত্রদের অপরিপক্বতার চেয়ে কর্তৃপক্ষের নির্লিপ্ততা আরও বেশি মারাত্মক। একটি অন্যায় হয়ে থাকলে সেটিকে শুধরে না দিয়ে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় বাধা না দেওয়াটা সুস্থ রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে হানিকর।

একটি অন্যায় কাজকে আমলে নিতে আরও কয়েকটি অন্যায় করাটা যুক্তিযুক্ত নয়। বাংলাদেশ সংবিধান সরকারকে ২৯(৩)(ক) অনুচ্ছেদ অনুসারে সরকারি চাকরিতে কোটার বিধান করার এখতিয়ার দেয়। তেমনি নাগরিকদের আইনের চোখে সমতা (অনুচ্ছেদ ২৭), আইনের সমান আশ্রয় লাভ (অনুচ্ছেদ ৩১), জীবনের নিরাপত্তার অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩২), চলাফেরার অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩৬), শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩৭), সংগঠন করার স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ৩৮) গঠনমূলক মত প্রকাশের অধিকার (অনুচ্ছেদ ৩৯)-কে আইনত বলবৎযোগ্য সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্থান দিয়েছে।

১৫ ও ১৬ জুলাইয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের ওপর আক্রমণাত্মক হামলার ঘটনা তাদের এসব নাগরিক অধিকার ভঙ্গ করে। মিডিয়ার বিভিন্ন সংবাদে ছাত্রদের ওপর মর্মান্তিক নির্যাতনের সংবাদ প্রদর্শিত হয়েছে। সেসব ছাত্র ও ছাত্রীদের বাবা মা তার সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তামুক্ত থাকতে পারছেন না।

সংবিধানের ৭ক(২) অনুচ্ছেদে জনমনে সংবিধানের প্রতি থাকা আস্থা, বিশ্বাস ও প্রত্যয় নষ্ট করা, নাকচ করার চেষ্টা করা বা করার ষড়যন্ত্র করাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলা হয়েছে। রাজাকার শব্দ রাষ্ট্রদ্রোহিতা কিনা এ বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা নেই। ছাত্রদের ওপর এই হামলা সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাকে বিনষ্ট করছে।

সুতরাং আইনগত আলোচনায় উভয় পক্ষের ক্রোধ বশবর্তী অসচেতনতামূলক সিদ্ধান্তের প্রমাণ মেলে যা সুচিন্তিত নয়। ন্যায়সঙ্গতভাবে, আইনানুগ প্রক্রিয়া না মেনে বা বিচার বহির্ভূত উপায়ে বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দ্বারা নাগরিকদের পরিচালনা করা হলে সেটি জাতির সার্বিক নিরাপত্তাকে ব্যাহত করে, ছাত্র নিরাপত্তাকে ভূলুণ্ঠিত করে ও আইনি কাঠামোকে দুর্বল করে দিয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তোলে।

রাজাকার বলার চর্চা শুধু ছাত্র আন্দোলন নয়, কোনো জাতীয় পর্যায়ের পদ বা মহলেই কাম্য নয়। রাজাকার শব্দটি একতরফাভাবে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী লাঞ্ছিত করতে যেন ব্যবহার করা না হয় সেটির নজর রাখতে হবে। এজন্যে রাজাকার শব্দটির প্রয়োগ নিয়ে কোনো স্বচ্ছ বিধান যেহেতু নেই তাই এটি ছাত্রসহ সব ক্ষেত্রে এর বিবিধ, যত্রতত্র ও বাছবিচারহীন প্রয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে। বড়দের দেখে ছোটোরাও শেখে। তাই উচ্চ মহলেও এই শব্দের প্রয়োগ নিয়ে সংবেদনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। ছাত্রদের দাবি মানার বা না মানার যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।

রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, বুদ্ধিজীবী ও সচেতন নাগরিক মহল থেকে কারণে অকারণে রাজাকার আখ্যা দিয়ে বিবৃতি দেওয়া রোধ করতে হবে। মতের অমিল হলেই কাউকে রাজাকার আখ্যা দেওয়ার অসুস্থ চর্চা বন্ধ করতে হবে। হিংসাত্মক রাজনীতি না করে আদর্শগত স্বচ্ছতার দৃঢ়-সুস্থ রাজনীতি করতে হবে। সাংবাদিকদের অযৌক্তিক, অপ্রাসঙ্গিক ও দুরভিসন্ধিমূলক প্রশ্ন করার থেকে বিরত থাকতে হবে। আন্দোলনরত ছাত্রদের শাব্দিক ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। রূপক অর্থেও রাজাকার শব্দের ব্যবহার বর্জন করতে হবে ও স্বাধীনতার সপক্ষের স্লোগানকে অনুসরণ করতে হবে।

দেশের এই ক্রান্তিকালে ছাত্র ও সরকার উভয়কে এক অন্যের মুখোমুখি অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। ছাত্র সমাজ ও সরকার একে অন্যের পরিপূরক না হলে দেশ সামাজিক বিশৃঙ্খলার চরমে পৌঁছবে। তাই উভয় পক্ষকে ব্যক্তি, দল বা সংগঠনের ঊর্ধ্বে থেকে দেশ ও দশের স্বার্থে সংলাপের পথ সুগম করে বাস্তবিক ন্যায়ভিত্তিক যৌক্তিক সমাধানের পথ খোঁজার প্রয়াস চালাতে হবে। ছাত্রদের ওপর আক্রমণকারীদের দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি প্রদান করতে হবে। নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন নিরাপদ জাতি এই মর্মে প্রশাসনসহ সবাইকে কাজ করে যেতে হবে।

১৯৭১ সালে বর্বরতা, বৈষম্য, বিরোধী অপতৎপরতা, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধের লড়াইয়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। এ লড়াই আজও লড়ে যেতে হবে। ঘৃণা, দ্বেষ ও রক্তপাতের ফল কখনো কল্যাণকর নয়। ঘৃণার চাষাবাদে ঘৃণাই আবাদ হয়। চাই আলোচনার দ্বারা সমঝোতা, চাই পরমত সহিষ্ণুতা। শান্তিপূর্ণ উপায়ে যৌক্তিক সমাধান।

ইভনাত ভূঁইয়া ।। শিক্ষক, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়