ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে রপ্তানি আয়ের তথ্যের অসামঞ্জস্যতার কারণে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর আকার কমানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।

ধারণা করা হচ্ছে, রপ্তানি আয়ের তথ্য সংশোধন করা হলে বাংলাদেশের জিডিপি-এর আকার প্রায় দুই শতাংশ কমে যেতে পারে। বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রপ্তানি আয়ের তথ্য সংশোধন করার বিষয়টি বিভিন্নভাবে অর্থনীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব ফেলবে।

বর্তমানে রপ্তানি আয়ের তথ্যের যে অসামঞ্জস্যতা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া যাচ্ছে তা সাধারণ তথ্যগত পার্থক্যের চেয়েও অনেকটাই বেশি।

নিচে ইপিবি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত রপ্তানি আয়ের তথ্যগত অসামঞ্জস্যতা ছকের মাধ্যমে দেখানো হলো।

অর্থবছর

রপ্তানি আয় (পণ্য)
ইপিবি

(মিলিয়ন ডলার)

রপ্তানি আয় (পণ্য)
বাংলাদেশ ব্যাংক

(মিলিয়ন ডলার)

রপ্তানি আয়ের পার্থক্য

(মিলিয়ন ডলার)

২০২২-২৩

৫৫,৫৫৮.৭৭

৪৩৫৭২

১১৯৮৬.৭৭

২০২১-২২

৫২,০৮২.৬৬

৪৩৬০২

৮৪৮০.৬৬

২০২০-২১

৩৮,৭৫৮.৩১

৩৩৯৬৯

৪৭৮৯.৩১

২০১৯-২০

৩৩৬৭৪.০৯

২৯৯৬৬

৩৭০৮.০৯

২০১৮-১৯

৪০৫৩৫.০৪

৩৩৩৭৪

৭১৬১.০৪

২০১৭-১৮

৩৬৬৬৮.১৭

৩২৫৩৭

৪১৩১.১৭

২০১৬-১৭

৩৪৮৪৬.৮৪

৩০২৮৯

৪৫৫৭.৮৪

২০১৫-১৬

৩৪২৫৭.১৮

৩০২৫৫.৯

৪০০১.২৮

২০১৪-১৫

৩১২০৮.৯৪

২৯১৫৭.৩

২০৫১.৬৪

সূত্র : রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংক

উপরের ছকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী জুলাই ২০২৩ থেকে এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত দশ মাসে ৩৬৬৩৭.৪০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য জাহাজিকরণ করা হয়েছে যেখানে ইপিবি-এর তথ্য অনুযায়ী একইসময়ে ৪৭৪৭১.৭৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য জাহাজিকরণ করা হয়েছে।

অর্থাৎ দুই প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত একই বিষয়ের তথ্যের ভিন্নতা হয়েছে ১০৮৩৪.৩৭ মিলিয়ন ডলারের। এই ভিন্ন তথ্যের মূল প্রভাব পড়ে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের (Balance of Payments) চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবের ওপর।

দুই প্রতিষ্ঠানের প্রদত্ত একই বিষয়ের তথ্যের ভিন্নতা হয়েছে ১০৮৩৪.৩৭ মিলিয়ন ডলারের। এই ভিন্ন তথ্যের মূল প্রভাব পড়ে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের চলতি হিসাব ও আর্থিক হিসাবের ওপর।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সরবরাহকৃত রপ্তানি আয়ের তথ্যের অসামঞ্জস্যতার কারণ হতে পারে ভুল পণ্যের তথ্য রপ্তানি খাতে ঢুকে যেতে পারা বা দুইবার গণনা বা একই পণ্য বারবার গণনাতে চলে আসা।

আবার কোনো রপ্তানি পণ্যের উৎপাদনে যে কাঁচামাল ব্যবহার করা হয় সেগুলো আমদানি করে আনা হলে আমদানি মূল্য হিসাব থেকে বাদ দেওয়া না হলে প্রকৃত রপ্তানির হিসাবে গরমিল দেখা যায়।

এই হিসাবের গরমিলের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। ২০১৩-১৪ অর্থবছরের ইপিবি-এর প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায় রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৩০১০৬.৬২ মিলিয়ন ডলার যেখানে একই সময়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত এই আয়ের পরিমাণ ছিল ২৭৪৫৪.৩০ মিলিয়ন ডলার।

২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের তুলনায় ইপিবি-এর প্রকাশিত তথ্যে রপ্তানি আয় বেশি দেখানো হয়েছে যথাক্রমে ২৭৩২.৩২, ২০৫১.৬৪, ৪০০১.২৪, ৪৫৫৭.৮৪, ৪১৩১.৪৭, ৭১৬১.০৪, ৩৭০৮.০৯, ৪৭৮৯.৩১, ৮৪৮০.৬৬, ১১৯৮৬.৭৭ মিলিয়ন ডলার ।

রপ্তানি আয়ের সঠিক তথ্য একটি দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন দেশের অর্থনীতির আকার হিসাব করা হয় অর্থাৎ যখন দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)-এর পরিমাপ করা হয় সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে রপ্তানি আয় যা দেশের অর্থনীতিতে যোগ হয় এবং অর্থনীতির আকার বড় করতে সহায়তা করে।

দেশের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট সময়ে সাধারণত এক অর্থবছরে যে পরিমাণ দ্রব্য ও সেবা উৎপাদিত হয় তার বাজারমূল্যকে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বলা হয়। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের এই অসামঞ্জস্যতা বিবেচনায় নিয়ে যদি জিডিপি হিসাব করা হয় তাহলে জিডিপি-এর আকার কমে যেতে পারে।

আর স্বাভাবিকভাবেই জিডিপি-এর আকারের সঙ্গে যেহেতু মাথাপিছু আয়ের সম্পর্ক রয়েছে সেহেতু জিডিপি-এর আকার কমলে মাথাপিছু আয়ও কমে যাবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিভিন্ন খাতের অবদান দেখলে দেখা যাবে যে, রপ্তানি খাতের অবদান খুব বেশি নয়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মূল্য সংযোজন। রপ্তানি খাতের মূল্য সংযোজনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম।

আমাদের দেশের রপ্তানি আয়ের বড় অংশ জুড়ে আছে তৈরি পোশাক শিল্প। আর আমরা যে পোশাক রপ্তানি করি তা উৎপাদনে যে কাঁচামাল ব্যবহৃত হয় তার বড় অংশই আনা হয় আমদানি করে। ফলস্বরূপ মূল্য সংযোজনের পরিমাণ কমে যায়।

যদি জিডিপি-এর হিসাবে পরিবর্তন আসে তবে জিডিপি গণনার যেসব খাত আছে যেমন–কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত সেইসব জিডিপি-তে অবদানের পরিমাণেরও পরিবর্তন আসবে।

অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস হচ্ছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। এই রপ্তানি ও প্রবাসী আয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবেও পরিচিত। দেশে জিডিপি-এর প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বড় ভূমিকা রাখে।

রপ্তানি আয়কে জিডিপি গণনার সঙ্গে সমন্বয় করলে প্রকৃত জিডিপি-এর পরিমাণ কমবে এবং একইসঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও কমে আসবে। বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য ঋণাত্মক হবে এবং আর্থিক হিসাবের ভারসাম্য হবে ধনাত্মক। ফলস্বরূপ টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেবে।

একটি সঠিক এবং ভালো নীতি প্রণয়নের জন্য প্রয়োজন সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য। ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নীতি নির্ধারণ করলে সেই নীতির কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। কোনো কার্যকারিতাও থাকে না। সুতরাং সঠিক, সুনির্দিষ্ট ও যুগোপযোগী নীতি গ্রহণের জন্য সঠিক তথ্য ও উপাত্তের বিকল্প কিছু নেই।

২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে শুরু করে এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবি প্রদত্ত রপ্তানি আয়ের মোট পার্থক্য ৬৪৪৩৪.৪৯ মিলিয়ন ডলার। রপ্তানির পরিসংখ্যান দেশের লেনদেনের ভারসাম্যকে যেমন প্রভাবিত করে তেমনি বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকেও প্রভাবিত করে।

সুতরাং এই রপ্তানি আয়ের প্রকৃত তথ্যটি পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা জানি যে এইসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই একটি দেশের রপ্তানির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করা হয়। অধিকন্তু এইসব নীতি সরাসরি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত। আবার, বিভ্রান্তিকর রপ্তানি পরিসংখ্যান বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণেও বাধা দিতে পারে এবং শুল্ক সঠিকভাবে গণনা করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।

সর্বোপরি ভুল পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ অর্থনৈতিক গবেষণায় ভুল ফলাফল প্রদান করতে পারে। এর ফলে পুনরায় অর্থনৈতিক গবেষণার ফলাফলের ওপর গৃহীত নীতিগত সিদ্ধান্ত ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

একটি সঠিক এবং ভালো নীতি প্রণয়নের জন্য প্রয়োজন সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য। ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নীতি নির্ধারণ করলে সেই নীতির কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। কোনো কার্যকারিতাও থাকে না। সুতরাং সঠিক, সুনির্দিষ্ট ও যুগোপযোগী নীতি গ্রহণের জন্য সঠিক তথ্য ও উপাত্তের বিকল্প কিছু নেই।

এই ধরনের তথ্যের অসামঞ্জস্যতা সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। অধিকন্তু এসব ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব অর্থনৈতিক তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ করে তার নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বস্ততা নিয়েও জনমনে দ্বিধার সৃষ্টি হয়।

রপ্তানি আয়ের প্রকৃত তথ্য পাওয়ার জন্য বিভিন্ন সংস্থার যেমন–জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ইপিবি, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ বিভাগ প্রভৃতির মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। এতে করে বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্তি পাওয়ার পাশাপাশি দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর সঠিক তথ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

এই তথ্য বিভ্রান্তির বিষয়টি অনেক বছর ধরেই চলে আসছিল। তবে আশার বিষয় হচ্ছে দেরিতে হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক তথ্য উদঘাটনে উদ্যোগী হয়েছে। বিষয়টি অবশ্যই দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। কারণ এটি দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক অবস্থাকে বুঝতে সহায়তা করবে। 

সোমা ভট্টাচার্য ।। সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়