২০২৪ সালের বর্ষার শুরুতে বৃষ্টির তেমন তীব্রতা না থাকলেও এখন কিছুটা বেড়েছে। একে প্রবল বৃষ্টিপাত বলা যায় না। কিন্তু সামান্য বৃষ্টিতেই ১২ জুলাই ২০২৪ রাজধানী ডুবেছে। ডুবেছে রাজশাহী, কক্সবাজারও।

ভয়ংকরভাবে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, জনপদ এবং কোনো কোনো স্থানে সেই পানি এখনো নামেনি। এখন বৃষ্টি মানেই ছবিটা হলো— পানিতে ডোবা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও স্থান। 

রাজধানীবাসী এখন আতঙ্কে থাকেন বর্ষাকালে। কিছুক্ষণ টানা বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় সব সড়ক। এবার কোথাও কোথাও একতলা বাড়িঘরেও পানি প্রবেশ করেছে। অভিজাত এলাকাগুলোও রেহাই পায়নি।

গণমাধ্যম বলছে, চার বছরে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে কমপক্ষে ৭৩০ কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু ১২ জুলাইয়ের চিত্র বলে দিলো যে এর সুফল মানুষ পায়নি। সেদিন সকাল সাড়ে ৬টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা ঢাকায় বৃষ্টি হয়েছে ৬০ মিলিমিটার। এতেই নাকাল হয়েছে নগরবাসী।

ছুটির দিন হওয়ায় তবুও রক্ষা যে দুর্ভোগ অফিসগামী ও পড়ুয়াদের ভোগায়নি। শুধু ঢাকা নয়। জলাবদ্ধতার সমস্যা এখন প্রায় সব শহরে। তবে ঢাকাতে এই সমস্যা একেবারে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ‘বৃষ্টিতে জলমগ্ন ঢাকা’—এ কথাটি একেবারে প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়েছে।

শুধু ঢাকা নয়। জলাবদ্ধতার সমস্যা এখন প্রায় সব শহরে। তবে ঢাকাতে এই সমস্যা একেবারে অসহনীয় হয়ে উঠেছে।

প্রতিবছর একই চিত্র। কিন্তু পরিবর্তনের উদ্যোগ নেই কোথাও। একটু ভারি বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় বিভিন্ন এলাকা। তখন আমরা ছোটাছুটি দেখি দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কর্তা-ব্যক্তিদের। তারা টেলিভিশনে এসে একগাদা প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাওয়া হয়ে যান আরেকটি বছরে এমন অবস্থা তৈরি হওয়া পর্যন্ত। বর্ষা বিদায় নিলে সেই তৎপরতাও বিদায় নেয় দৃশ্যপট থেকে।

নগর পরিকল্পনাবিদসহ পরিবেশবাদীরা তাদের শঙ্কার কথা প্রায়ই বলেন যে, এ শহরটি এক সময় অচল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু শাসকের কানে সে কথা প্রবেশ করাবে কে? একটু ভারি বৃষ্টি হলেই শহর জুড়ে পানি থইথই করে। কারণ, অপরিকল্পিত নগরায়ণ।

আগে শহরের এ প্রান্তের জমা পানি অপেক্ষাকৃত ঢালু জলাভূমিতে গিয়ে পড়ত। এখন সেইসব জলাজমি আর নেই। সব বাড়িঘরে ভরে যাচ্ছে। সরকারি বেসরকারি আবাসন প্রকল্পে আকাশই দেখা যায় না, তো বৃষ্টির পানি যাবে কোথায়? 

আসলে আমরা সবাই মিলেই বিপদ ডেকে আনছি। ১২ জুলাই ২০২৪ দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলছিলেন যে, পানি সরিয়ে নিতে তাদের পাম্পগুলো কাজ করছে না পলিথিন আর অন্যান্য বর্জ্যের কারণে। প্রশ্ন হলো, সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারি সব কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে বাজারে, হাটে, ঘাটে, মুদির দোকানে এত পলিথিন প্রকাশ্যে বিক্রি হয় কেমন করে? এছাড়া বর্জ্য অপসারণের দায়িত্বও তো সিটি কর্পোরেশনেরই। 

বৃষ্টির দিনে পানিনিষ্কাশনের হতশ্রী চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে যায় সবার সামনে। আজীবনই জলাবদ্ধতার সমস্যা এই নগরীতে ছিল। কিন্তু এত দ্রুত এবং ব্যাপক পানি জমে যাওয়া নগরবাসী সাম্প্রতিককালেই দেখছে। কী করে দিন দিন এমন ভয়ানক আকার নিচ্ছে জলাবদ্ধতা, সেই ইতিহাস খোঁজার চেয়ে সমস্যার সমাধানে দৃষ্টি দেওয়াই শ্রেয়।

২০২৪ সালে আরও বৃষ্টি হবে এবং ১২ জুলাই ২০২৪ এর চেয়েও বেশি হবে—আবহাওয়াবিদদের এমন পূর্বাভাসে শঙ্কা আরও বাড়ছে। রাজধানীতে এমন বেশকিছু জায়গা আছে, যেখানে প্রায় সারা বছরই কমবেশি পানি জমে থাকে। আর বর্ষাকালে তো কথাই নেই।

পানি থইথই এলাকাগুলো মূল সড়ক থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জমে থাকা নোংরা পানি মাড়িয়ে যাতায়াত করতে হয় নাগরিকদের। পানি ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরেও।

একটু ভারি বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় বিভিন্ন এলাকা। তখন আমরা ছোটাছুটি দেখি দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও কর্তা-ব্যক্তিদের। তারা টেলিভিশনে এসে একগাদা প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাওয়া হয়ে যান আরেকটি বছরে এমন অবস্থা তৈরি হওয়া পর্যন্ত।

নিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নে কোটি কোটি টাকা নানা সরকারের আমলে ব্যয় হয়েছে। কিন্তু তারপরও আমাদের শহরগুলোর নিষ্কাশন এমন বেহাল কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন শহরের বাসিন্দারা। পানি নিষ্কাশনের কাজ হয়েছে এবং বহুবারই হয়েছে। কিন্তু পুরোটাই হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে, সমন্বয়হীনভাবে।

এলাকাভিত্তিক বিচ্ছিন্নভাবে কাজ হয়েছে, বিভিন্ন সংস্থা তাদের মতো করে করেছে। সমন্বিত পরিকল্পনা না থাকায় সেসব কিছুই মানুষের কাজে এলো না। শহরের নিষ্কাশন-সমস্যার কোনো সমাধান তো হলোই না; বরং মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়ল।

জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ জলাশয় ভরাট করে করা উন্নয়ন। এই উন্নয়ন সমষ্টিগত এবং সরকারি পর্যায়ে। পানি নামার পথ নেই এখন। রাজধানীর চারদিকে একসময় কত খাল ছিল। ছিল বেশকিছু বড় জলাশয়ও। আগে যখন সেভাবে এই শহরে নালা-নর্দমা তৈরি হয়নি, তখন প্রাকৃতিকভাবেই বর্ষার জল এই সব জলাশয়, নদী-খাল ও নিচু এলাকায় গিয়ে পড়ত। তাতে শহরে তেমন পানি জমত না।

এখন একের পর এক জলাশয় ভরাট করে তৈরি হচ্ছে বাড়িঘর আর স্থাপনা। ফলে শহরের নিজস্ব প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। কিছু খাল উদ্ধার করতেই হবে, সংস্কার করতেই হবে এবং আশেপাশে আবাসন প্রকল্প বন্ধ করতেই হবে। এগুলো অবশ্য কর্তব্য সরকারের জন্য।

ভাবতে হবে যে, স্থাপনার পর স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে, ফলে পানি শোষণ করার জন্য পর্যাপ্ত মাটিও নেই এই শহরে। তবে শুধু সিটি কর্পোরেশন এবং সরকারকে দোষ দিয়ে হবে না। নাগরিকদেরও নিজেদের দিকে চাইতে হবে।

যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলার যে অভ্যাস আমরা করেছি, যেভাবে পলিথিন ও প্লাস্টিক সামগ্রী ফেলছি রাস্তায়, তা পৃথিবীর খুব কম দেশের নাগরিকেরাই করে।

সমন্বিতভাবে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা আরও কতটা বেগবান করা যায় সে চিন্তার পাশাপাশি নগরবাসীকে সচেতন করার কাজটাও এগিয়ে নিতে হবে সরকারি সংস্থাগুলোকেই।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, ঢাকা জার্নাল