ছবি : সংগৃহীত

কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের দাবি সঠিক নয়। তারা বলছে, সরকারি চাকরিতে কোটায় অন্তর্ভুক্ত প্রার্থীরা মেধার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে এবং এর ফলে মেধা ক্যাটাগরির প্রার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বিষয়টি আদৌ সত্য নয়।

৩৩, ৩৫ এবং ৩৬তম এই তিনটি বিসিএস পরীক্ষায় গড়ে প্রায় ৭২ শতাংশ প্রার্থীকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে গড়ে মাত্র ২৮ শতাংশ প্রার্থী কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছে। বিগত পাঁচটি বিসিএস পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা কোটার প্রার্থীদের সংখ্যা ৫ শতাংশের নিচে ছিল।

সর্বশেষ সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শূন্য পদগুলোয় মেধা তালিকা থেকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আন্দোলনকারীদের দাবির মধ্যে দেশের কোটা ব্যবস্থাপনার প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। তারা কিছু সস্তা চিন্তার ও লোক দেখানো বিষয় উপস্থাপন করছে।

তারা এমনভাবে উপস্থাপন করছে‌ যেন কেবলমাত্র কোটার অন্তর্ভুক্ত প্রার্থীদেরকেই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে অথবা সিংহভাগ নিয়োগ কোটা থেকেই দেওয়া হচ্ছে। ‌বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টো।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই (কোটা চালু অবস্থায়) সরকারি চাকরিতে সবচেয়ে কম প্রার্থীদের কোটা থেকে নিয়োগ দেওয়া হয় (২৮ শতাংশ)।

বর্তমানে ভারতে সরকারি চাকরিতে ৬০ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে ও  ৪০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে, পাকিস্তানে ৯২. ৫ শতাংশ কোটা ও মাত্র ৭.৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে, নেপালে ৪৫ শতাংশ কোটা ও ৫৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে, শ্রীলঙ্কায় ৫০শতাংশ কোটা ও ৫০ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়।

এছাড়া শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে ভর্তির ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ জেলা কোটা বিদ্যমান রয়েছে। ‌কোটায় অন্তর্ভুক্ত আর মেধাবী এ দুটো বিষয় যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে তাতে মনে হয় কোটার মাধ্যমে চাকরি প্রার্থীরা মেধাবী নয়।

তারা অবশ্যই মেধাবী কারণ একই লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা পাশ করে সংবিধানের আলোকে প্রণীত সরকারি নীতি অনুযায়ী অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

আধুনিক গণতান্ত্রিক উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, উন্নয়নশীল বিশ্বের প্রায় সব দেশই দীর্ঘ সময় ধরে উপনিবেশ ছিল।

এই দীর্ঘ সময়ে তারা শোষণ আর নিপীড়নের কবলে ছিল। ফলে স্বাধীনতা লাভের পরও এসকল দেশে উপযুক্ত জাতি গঠন প্রক্রিয়া, উন্নয়ন, সুযোগের সমতা ও সুষম বণ্টন এবং জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জিত হয়নি।

‌এ কারণে রাষ্ট্রের সব অঞ্চল, সম্প্রদায় ও শ্রেণি পেশার মানুষ যাতে সরকারি চাকরিতে ন্যায্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ পায় সে বিষয়টি লক্ষ্য রেখে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণীত  হয়। এটিই প্রকৃত অর্থে কোটা ব্যবস্থা। ‌

একই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আমাদের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কিত সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে।

আরও বলা হয়েছে, মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এই অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে।

সংবিধানের এই বিধানের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের সব জনগোষ্ঠী যাতে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিসহ সব ক্ষেত্রে সমভাবে সুযোগ পায়। রাষ্ট্র ও সমাজে যাতে কোনো বৈষম্য না থাকে সেজন্যই এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

অথচ কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা বলছে, কোটা ব্যবস্থার কারণেই নাকি তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। কোটা সংক্রান্ত সংবিধানের এই বিধানের অর্থ হচ্ছে কেবলমাত্র সমাজের বিত্তশালী মানুষ কিংবা শহর ও নগরের নানা সুবিধা প্রাপ্ত মানুষ অথবা নির্দিষ্ট এক শ্রেণির মানুষ সরকারি চাকরিসহ নানা সুবিধা পাবে আর অন্যান্য সুবিধা বঞ্চিত মানুষ বঞ্চিতই থেকে যাবে—এটি হতে পারে না।‌

কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের দাবি ও বক্তব্য আমাদের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বিরোধী। সাংবিধানিক রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির আওতায় প্রণীত কোনো সরকারি নীতি কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রণীত হতে পারে না।

এই ধরনের দাবি অসাংবিধানিক, অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক। সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রের সব অংশের মানুষের স্বার্থ ও কল্যাণের কথা চিন্তা করে একটি সামষ্টিক প্রেক্ষাপটে এই নীতি প্রণয়ন করতে হয়।

এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রে শিক্ষার্থী ছাড়াও আরও অনেক স্টেকহোল্ডার বা অংশীজন রয়েছে। আবার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দেশের সকল শিক্ষার্থীকে প্রতিনিধিত্ব করে না। তাই কেবলমাত্র আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী কোটা সংস্কার কিংবা কোটা বাতিল করলে এটি হবে সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও অবৈধ।

কয়েক বছর কোটা না থাকার ফলে সরকারি চাকরিতে মেয়েদের অন্তর্ভুক্তি হতাশাজনকভাবে কমেছে। পুলিশের চাকরিতে কোটা না থাকায় মাত্র চারজন নারী অফিসার সুযোগ পেয়েছে।

ফরেন সার্ভিসে মাত্র দুইজন নারী প্রার্থী সুযোগ পেয়েছে। ২৩টি জেলায় একজনও পুলিশের চাকরি পায়নি। ৫০টি জেলায় নারীরা চাকরির ক্ষেত্রে কোনো সুযোগ পায়নি।

যখন কোটা পদ্ধতি ছিল নারী চাকরিপ্রার্থী কম বেশি ২৬ শতাংশের বেশি চাকরি পেয়েছিল। কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার ফলে এই চাকরি প্রাপ্তি কোনো কোনো বছরে ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে।

অথচ সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীর অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার নির্দেশনা রাষ্ট্রের ওপর রয়েছে।

কোটাবিরোধীদের দাবি, সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটা রেখে অন্যান্য কোটা বাতিল করতে হবে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯ এর আলোকে এই দাবি অসাংবিধানিক।

ইতিমধ্যে যারা কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের কেউই পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় এমনকি প্রিলিমিনারি পরীক্ষায়ও তারা যোগ দেয়নি। তাহলে তাদের এই আন্দোলনের উদ্দেশ্যটা কী?

একটা বিষয় উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালে সামরিক ও স্বৈরশাসক জিয়ার সময় তদানীন্তন পাবলিক সার্ভিস কমিশন কোটা ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। ‌জিয়া কোটা বাতিল না করে বরং গোটা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। 

তারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবি জানাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী জানিয়েছেন, বিগত পাঁচটি বিসিএস পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা কোটার আওতায় আবেদনকারীর সংখ্যা মাত্র ৫ শতাংশ এর নিচে।

দেশের মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বিবেচনায় এই সংখ্যা এর চেয়ে অধিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। ফলে সরকারি নীতি অনুযায়ী বাকি ২৫ শতাংশ পদ‌ মেধার ভিত্তিতেই পূরণ করতে হবে।

যারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে এদেশ স্বাধীন করেছেন, তাদের প্রতি রাষ্ট্রের একটি দায়বদ্ধতা রয়েছে। পৃথিবীর যেসব দেশে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা মুক্তি সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছিল অর্থাৎ যেসব দেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেসব দেশে যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিল তাদের সন্তান-সন্ততি ও বংশধরেরা চাকরিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে একটা অগ্রাধিকার পায়।

যারা কোটাবিরোধী আন্দোলনের নামে রাস্তায় নেমেছে, তাদের জানা উচিত যারা তাদের প্ররোচনা দিচ্ছে, তারা এ দেশের শত্রু। ‌ তারা কোমলমতি ছেলেমেয়েদের আবেগকে পুঁজি করে রাষ্ট্রকে অস্থির করতে চাচ্ছে। সেই অশুভ শক্তি দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করতে চাচ্ছে।

এটি দুঃখজনক, কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন শ্লোগান ও বক্তব্যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা ও অবজ্ঞা প্রকাশিত হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টকে তারা চ্যালেঞ্জ করে ঘোষণা দিয়েছে, তারা সুপ্রিম কোর্টের আদেশ মানে না। তারা সংবিধানকে অবজ্ঞা করছে। প্রধান বিচারপতির নির্দেশনাও তারা তোয়াক্কা করছে না। এই ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ‌

ড. সেলিম মাহমুদ ।। তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ