ছবি : সংগৃহীত

২০২৪ সালের ৮-১০ জুলাই পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফর, বাংলাদেশ ও চীনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত। এই সফরের ফলে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২১টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়।

বিভিন্ন ঘোষণার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং-এর বাংলাদেশকে ১ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করা এই সফর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে মজবুত ও ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছে।

কয়েক বছর ধরে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সফরের সময় ২১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর উভয় দেশের সহযোগিতাকে আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।

এই চুক্তিগুলো বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়সহ বিস্তৃত ক্ষেত্রগুলো কভার করে। ২১টি চুক্তির মধ্যে দুটি ছিল বিদ্যমান স্মারকলিপির নবায়ন এবং সাতটি ছিল পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঘোষণা।

এই চুক্তির পরিধি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ব্যাপক প্রকৃতিকে হাইলাইট করে, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত উভয় স্বার্থকে সম্বোধন করে।

অর্থনৈতিক সহায়তা: প্রিমিয়ার লি কিয়াং-এর ১ বিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এই আর্থিক সহায়তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চাঙা করবে, উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তহবিল সরবরাহ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

যাই হোক, এটি বর্ধিত দুর্নীতির সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বেগও উত্থাপন করে, একটি চ্যালেঞ্জ যা বাংলাদেশ বছরের পর বছর মোকাবিলা করছে। দুর্নীতি উদ্বেগ যথেষ্ট আর্থিক সহায়তার স্রোত প্রায়ই দুর্নীতির ঝুঁকি নিয়ে আসে। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির ইতিহাস, বিশেষ করে বড় আকারের প্রকল্প পরিচালনায়, সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।

তহবিল কার্যকরভাবে এবং স্বচ্ছভাবে ব্যবহার করা নিশ্চিত করতে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে কঠোর মনিটরিং, অডিটিং এবং দায়বদ্ধতার ব্যবস্থা যাতে অপব্যবহার রোধ করা যায় এবং সুবিধাগুলো উদ্দিষ্ট প্রাপকদের কাছে পৌঁছানো যায়।

প্রয়োজন-ভিত্তিক মেগা প্রকল্প ১ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি মূল বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে প্রকল্প নির্বাচন। জাতীয় উন্নয়ন অগ্রাধিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চালানোর সম্ভাবনা রয়েছে এমন প্রয়োজন-ভিত্তিক মেগা প্রকল্পগুলো তহবিল বরাদ্দ করা অপরিহার্য। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো যেগুলো বিনিয়োগে যথেষ্ট আয় দেয় না সেগুলো এড়ানো উচিত।

বিনিয়োগের জন্য অগ্রাধিকার ক্ষেত্র

অবকাঠামো উন্নয়ন: বাংলাদেশের অবকাঠামো, বিশেষ করে পরিবহন ও জ্বালানিতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রয়োজন। রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আধুনিকীকরণ, সড়ক যোগাযোগ সম্প্রসারণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নতিতে বিনিয়োগ অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।

স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা: দীর্ঘমেয়াদি টেকসই উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্ষেত্রগুলো বিনিয়োগ জীবনের মান উন্নত করতে পারে, মানব পুঁজি বাড়াতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।

...একটি চ্যালেঞ্জ যা বাংলাদেশ বছরের পর বছর মোকাবিলা করছে। দুর্নীতি উদ্বেগ যথেষ্ট আর্থিক সহায়তার স্রোত প্রায়ই দুর্নীতির ঝুঁকি নিয়ে আসে। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির ইতিহাস, বিশেষ করে বড় আকারের প্রকল্প পরিচালনায়, সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।

প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন: প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের প্রচার অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকে চালিত করতে পারে এবং বৃদ্ধির জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। ডিজিটাল অবকাঠামো, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং টেকনোলজি পার্কে বিনিয়োগ বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলোয়াড় হিসেবে অবস্থান করতে পারে।

স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা

১ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সর্বাগ্রে। তহবিল বরাদ্দ ও ব্যবহার পর্যবেক্ষণের জন্য সরকারকে অবশ্যই শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে স্বাধীন তদারকি সংস্থা স্থাপন, নিয়মিত অডিট পরিচালনা এবং প্রকল্পের বিবরণ সর্বজনীন প্রকাশ নিশ্চিত করা। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।

স্বাধীন তদারকি: তহবিলের ব্যবহার নিরীক্ষণের জন্য একটি স্বাধীন তদারকি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। এই সংস্থার যেকোনো অনিয়ম তদন্ত করার এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কর্তৃত্ব থাকা উচিত।

নিয়মিত অডিট: সহায়তা দ্বারা অর্থায়নকৃত প্রকল্পগুলোর নিয়মিত অডিট পরিচালনা করা অপরিহার্য। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য এই অডিটগুলো স্বচ্ছ এবং সর্বজনীনভাবে অ্যাক্সেসযোগ্য হওয়া উচিত।

পাবলিক ডিসক্লোজার: তহবিল বরাদ্দ, অগ্রগতি প্রতিবেদন এবং ফলাফলসহ প্রকল্পের বিশদ বিবরণ সর্বজনীনভাবে অ্যাক্সেসযোগ্য করা স্বচ্ছতা বাড়াতে পারে। এটি নাগরিকদের সরকারকে দায়বদ্ধ রাখার অনুমতি দেয় এবং তহবিল কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয় তা নিশ্চিত করে।

২১টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তির তাৎপর্য

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে ২১টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক আস্থার গভীরতাকে নির্দেশ করে। এই চুক্তিগুলো বিস্তৃত ক্ষেত্রগুলো কভার করে, যা সম্পর্কের ব্যাপক প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে। মূল চুক্তি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ: বেশকিছু চুক্তির লক্ষ্য দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো। এর মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য বাধা কমানোর উদ্যোগ, যৌথ উদ্যোগের প্রচার এবং চীনে বাংলাদেশি পণ্যের বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়ানো।

অবকাঠামো উন্নয়ন: অবকাঠামো উন্নয়ন সম্পর্কিত চুক্তিগুলো কানেক্টিভিটি বাড়ানো, বন্দর আধুনিকীকরণ এবং পরিবহন নেটওয়ার্ক উন্নত করার ওপর ফোকাস করে। এই প্রকল্পগুলো বাণিজ্য এবং বিনিয়োগকে সহজতর করবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চালাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

তহবিলের ব্যবহার নিরীক্ষণের জন্য একটি স্বাধীন তদারকি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে। এই সংস্থার যেকোনো অনিয়ম তদন্ত করার এবং সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কর্তৃত্ব থাকা উচিত।

প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন: বেশকিছু সমঝোতা স্মারক প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং উদ্ভাবনের ওপর ফোকাস করে। এই চুক্তিগুলো তথ্য প্রযুক্তি, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি এবং উন্নত উৎপাদনের মতো ক্ষেত্রগুলোয় সহযোগিতাকে উন্নীত করা।

সাংস্কৃতিক বিনিময়: সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তির লক্ষ্য জনগণের মধ্যে বন্ধন জোরদার করা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার প্রচার করা। এই উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ছাত্র বিনিময় প্রোগ্রাম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং যৌথ গবেষণা প্রকল্প।

কৌশলগত প্রভাব: এই সফরের উল্লেখযোগ্য কৌশলগত প্রভাবও রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি, বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর মতো উদ্যোগের মাধ্যমে এই অঞ্চলের জন্য কৌশলগত প্রভাব রয়েছে।

চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বড় শক্তির সাথে তার লেনদেনে সুবিধা প্রদান করতে পারে। ভারসাম্য সম্পর্ক চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার সময়, বাংলাদেশকে তার পররাষ্ট্রনীতিতেও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখতে হবে।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সাথে সুসম্পর্ক নিশ্চিত করা, বিশেষ করে ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখার জন্য এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুবিধা সর্বাধিক করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনৈতিক সহায়তা লাভজনক হলেও বাংলাদেশের ঋণের স্থায়িত্ব পরিচালনা করা অপরিহার্য। ধার করা তহবিলগুলো দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা হয় এবং অর্থনৈতিক রিটার্ন জেনারেট করা হয় তা নিশ্চিত করা ঋণের ফাঁদের ঝুঁকি কমাতে পারে।

১ বিলিয়ন ডলারের  সহায়তার সুফল সর্বাধিক করতে এবং ঝুঁকি কমাতে, বাংলাদেশকে অবশ্যই একটি বহুমুখী পন্থা অবলম্বন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত অবস্থানকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করার সম্ভাবনা রয়েছে।

২১টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তির সাথে ১ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সহায়তা উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট সুযোগ উপস্থাপন করে। যাই হোক, এই উদ্যোগগুলোর সাফল্য তহবিলের কার্যকর এবং স্বচ্ছ ব্যবহার, প্রয়োজন-ভিত্তিক প্রকল্প নির্বাচন এবং শক্তিশালী জবাবদিহিতা ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণের ওপর নির্ভর করে।

টেকসই উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং কৌশলগত প্রকল্প নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে ভিশন ২০৪১ অর্জন করা সম্ভব।   

অধ্যাপক ড. সুজিত কুমার দত্ত ।। সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
datta.ir@cu.ac.bd