পিএসসি’র আবেদ আলী ও স্বাস্থ্য’র আব্দুল মালেক
সরকারি প্রতিষ্ঠানের ড্রাইভাররা কীভাবে এত টাকার মালিক হয়?
সেই ছোটবেলা হতে শুনেছি, 'ছাগল নাচে খুঁটির জোরে।' যত বয়স বাড়ছে কথাটা ততবেশি সত্য ও বাস্তবিক মনে হচ্ছে। সরকারি অফিস আদালতের পিয়ন, দারোয়ান, ড্রাইভার বা সেই পর্যায়ে কর্মরতদের নিজস্ব ক্ষমতা বলে তেমন কিছু না থাকলেও তারা প্রবল ক্ষমতাধর বা বিত্তশালী হয়ে ওঠেন তাদের নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা বা বসের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে।
কিছু কর্মকর্তা নিজেদের হীন স্বার্থ ব্যবহার করতে গিয়ে ধীরে ধীরে এসব দরিদ্র সাধারণ কর্মচারীদের প্রবল প্রতাপশালী ও অপ্রতিরোধ্য দানবে পরিণত করেন। এভাবে কালের পরিক্রমায় এরা তাদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তাদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন এবং এক পর্যায়ে বসরা এদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন।
বিজ্ঞাপন
শুনতে খারাপ লাগলেও বাস্তবতা হলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মকর্তাদের একাংশ নিজেদের আড়ালে রেখে তাদের গাড়িচালক, পিয়ন, দারোয়ানের মাধ্যমে ঘুষের অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন বাংলাদেশের অফিস আদালতে। বাংলাদেশে দুর্নীতির চর্চা হয় বলেই প্রতিবছর বিশ্বের শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম বিবেচিত হয় দেশটি।
আরও পড়ুন
এই অবস্থায় দুর্নীতি যে আমাদের দেশের প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবতা তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কানাডার উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগের আগে কয়েক বছর সরকারি চাকরি করার সুযোগ হয়েছিল আমার। সরকারি এক দফতরে প্রকৌশলী হিসেবে কিছুকাল কাজ করেছি আমি। এই লেখার প্রয়োজনে আমার প্রায় দুই যুগ আগের একটি ছোট্ট অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।
অফিসের গাড়ি নিয়ে দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনে বেরিয়েছিলাম একদিন। পথিমধ্যে আমার ড্রাইভার এক মিষ্টির দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাকে বললেন, 'স্যার, দয়া করে এক মিনিট অপেক্ষা করুন, আমি এখুনি ফিরে আসছি।' অতঃপর তিনি মিষ্টির দোকানে প্রবেশ করলেন।
তবে এক মিনিট নয়, মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এলেন গাড়িতে। ফিরেই আমাকে অনুরোধ জানালেন মিষ্টির দোকানে যেতে। ভাবলাম, তার হয়তো মিষ্টি খেতে মন চাইছে; তাই গেলাম। আমি নিজেও অবশ্য মিষ্টি পাগল মানুষ। বয়স তখনো তিরিশের নিচে; কাজেই ডায়াবেটিসের ভয়ও ছিল না মনে।
দোকানে ঢুকেই দেখলাম ওই দোকানের লোকজন কয়েক পদের দামি মিষ্টি আমার সামনে পরিবেশন করে আমাকে আপ্যায়ন করতে শুরু করলেন; ঠিক যেন বিয়েবাড়ির ভিআইপি মেহমান। অপ্রত্যাশিত আদর-আপ্যায়ন দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ।
দোকান ছেড়ে আসার সময় কোন মিষ্টি আমার পছন্দ তাও জানতে চাইলেন ওয়েটার। তারা আমাকে কিছু মিষ্টি গিফট করতে চান। তা দেখে আমি কেবল অবাকই হইনি, বিরক্তও হলাম। যেটুকু মিষ্টি খেয়েছি তার দাম জোর করেও দেওয়া সম্ভব হয়নি সেইদিন। তবে, বাড়তি কোনো মিষ্টি আমি নেইনি।
পরে গাড়িতে চড়ে ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইলাম আমাকে এভাবে আপ্যায়নের হেতু কী? উত্তরে তিনি বললেন, 'স্যার, ওই বিল্ডিংয়ের প্ল্যানটা এখনো পাস হয়নি। আপনি তো অথোরাইজেশন কমিটির সদস্য। মালিকের অনুরোধ, একটু যদি দেখেন...'
আরও পড়ুন
যারা বিষয়টি জানেন না, অথোরাইজেশন কমিটি নামে সরকারের বেঁধে দেওয়া কমিটির মাধ্যমে নগর এলাকায় ভবনের নকশা অনুমোদিত হয়। সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলাম আমি তখন। বুঝলেন তো এবার! ভবনের নকশা অনুমোদনে আমার সুনজর পেতেই এই বিশেষ আদর-আপ্যায়ন। সেদিন আমি অফিসে ফিরেই সার্বিক বিষয়টা (মিষ্টির ঘটনা) অথোরাইজেশন কমিটির সভাপতি মহোদয়কে জানিয়ে রেখেছিলাম। সেই থেকে ওই রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় কোনোদিন ওই দোকানের দিকে আর ফিরেও তাকাইনি।
এতো পুরোনো ঘটনা এখানে বর্ণনা করার কারণ হলো, সরকারি অফিস আদালতের কর্মকর্তারা কীভাবে ড্রাইভার বা পিয়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন তার একটা ছোট্ট দৃষ্টান্ত তুলে ধরা। সেদিন আমি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বাসায় ফিরলে ভবনের মালিক হয়তো তাদের কাজটি (অবৈধ অনুমোদন) করে দেওয়ার জন্য আমাকে টাকাপয়সাও সাধতেন এবং সে অপকর্মটি সম্পন্ন হতো আমার সে গাড়িচালকের মধ্যস্থতা বা প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। সেই কাজে আমি আর্থিক সুবিধা নিলে আমার ড্রাইভারও নিশ্চয়ই অনুরূপ সুবিধা গ্রহণের সুযোগ পেতেন, আমি যা সাবধানে এড়িয়ে গেছি।
লেখার মূল লক্ষ্য পিএসসি'র চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়ির ড্রাইভার, এই সময়ের টক অব দ্য কান্ট্রি, সৈয়দ আবেদ আলী কী করে কালের আবর্তে এত অর্থবিত্তশালী হয়ে উঠলেন তা নিয়ে নিজের কিছু চিন্তা পাঠকের বিবেচনার্থে তুলে ধরা।
গণমাধ্যমে জানলাম, ছোটবেলায় অভাবের তাড়নায় আবেদ আলী মাত্র আট বছর বয়সেই কুলির কাজ শুরু করেছিলেন। এমন হতদরিদ্র পরিবারের একজন মানুষ আজ এতটাই বিত্তশালী হয়েছেন যে তিনি সম্প্রতি উপজেলা চেয়ারম্যান পদেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। তাও আওয়ামী লীগের।
আজকাল নির্বাচনে দাঁড়াতে যে কী বিশাল আর্থিক সামর্থ্য থাকতে হয় তার নতুন ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। গ্রামে বিলাসবহুল বাড়ি, খামার-বাগান, মসজিদ-মার্কেট কী করেননি আবেদ আলী! একইসাথে, তার ছেলে সিয়ামও নিজের কব্জায় নিয়েছে ছাত্রলীগের গুরুত্বপূর্ণ পদ। আবেদ আলী এতটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন যে পিএসসি'র উচ্চ পর্যায়ের লোকজনও তাকে যথেষ্ট সমীহ করে চলতেন বলে গণমাধ্যমে জানলাম।
পিএসসি থেকে বিসিএসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে কাড়িকাড়ি অবৈধ অর্থ উপার্জনের কথা আবেদ আলী অকপটে স্বীকার করেছেন। সাথে এও দাবি করেন, অবৈধ আয়ের সবটুকুই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছেন তিনি। বুঝতে কষ্ট হয় না, দুঃসময়ে বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষের সহানুভূতি কুড়াতেই তার এ মিথ্যাচার।
আরও পড়ুন
কেননা, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো দুর্দান্ত অপকর্ম করে অর্জিত বিপুল অবৈধ আয়ের কিছুটাও নিজে ভোগ না করে বা উপরওয়ালাদের না দিয়ে, সবটুকুই তিনি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে ফেলেছেন এমন বক্তব্য সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো মানুষের বিশ্বাস করার কথা নয়। বাস্তবতা হলো, আবেদ আলী নিজে এই অর্থ ভোগ করে বিলাসী জীবনযাপন করেছেন এবং একইসাথে, তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা বা সহযোগীদের সাথেও সে অর্থ ভাগাভাগি করেছেন। অন্যথায়, গোপনীয়তা বা সুরক্ষার অনেকগুলো কঠিন ধাপ পেরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্নপত্র ফাঁস কোনোদিনও একজন ড্রাইভারের একার পক্ষে সম্ভব হতো না।
মাছের পচন ধরে মাথা থেকে। অফিস-আদালতে দুর্নীতির বিষয়টাও তেমনই। কোনো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষকর্তা নিজ কর্মকাণ্ডে সততার চর্চা করলে তার অধীনস্থরা দুর্নীতিতে জড়ানোর আগে শতবার চিন্তা করেন। নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই বললাম।
কর্মক্ষেত্রে দেখেছি, অফিস প্রধান দুর্নীতিবাজ, এমন খবর অধস্তনদের মধ্যে চাউর হতেই সারা অফিসে দুর্নীতির বিষবাষ্প ক্যান্সারের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তির চালচলন বা গতিবিধি যথাযথভাবে আমলে নিয়েই অধীনস্থরা তাদের নিজ নিজ কর্মপদ্ধতি স্থির করে থাকেন।
দুর্বল আর্থ-সামাজিক অবস্থা থেকে উন্নতির চরম শিখরে ওঠা দোষের কিছু নয়, বরং প্রশংসনীয়, যদি তা কঠোর পরিশ্রম ও মেধার জোরে হয়ে থাকে; প্রশ্নফাঁসের মতো অতি নিকৃষ্ট ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী ঘৃণ্য অপকর্মের মাধ্যমে নয়। এককালের একজন সামান্য কুলি থেকে আবেদ আলীর আজকের এ অভাবনীয় উন্নতি তার পরিশ্রম বা মেধার জোরে নয়, অপকর্মে এবং অবৈধ অর্থ উপার্জনে। এ কারণেই আবেদ আলীর উত্থান দেশের সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক মেনে নিতে পারছেন না।
'ছাগল নাচে খুঁটির জোরে,' প্রবাদটা কিন্তু আবেদ আলীর ক্ষেত্রেও খাটে শতভাগ। খুঁটির জোর ছাড়াই একজন দরিদ্র গাড়িচালক দুঃসাহসী অপকর্মে জড়িয়ে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেলেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ ঘটনায় সম্মুখ সারিতে আবেদ আলী বা কিছু মাঝারি গোছের কর্মচারীর নাম উঠে এলেও মাস্টারমাইন্ড কিন্তু আরও অনেক উপরের পর্যায়ের বা হাইপ্রোফাইল প্রভাবশালীরা।
ঊর্ধ্বতন মহলের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রশ্রয় না পেলে সেদিনের হতদরিদ্র আবেদ আলী আজকের এ অবিশ্বাস্য আবেদ আলীতে পরিণত হতে পারতেন না। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালিত হলে আবেদ আলী যার বা যাদের গাড়ি চালাতেন প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় তার বা তাদের কারও কারও সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে এলেও অবাক হবে না দেশবাসী।
এ ঘটনায় পিএসসি'র এক বা একাধিক সদস্যের সংশ্লিষ্টতাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এটি একটি অর্গানাইজড ক্রাইম বা সসংঘবদ্ধ অপরাধ। সময় এবং সুযোগ এসেছে জাতির স্বার্থে শীর্ষ অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার।
প্রশ্নফাঁস ঘটনার তদন্তে ইতিমধ্যে কয়েকটি কমিটি কাজ শুরু করেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। তবে, কমিটির কাজ শেষ হওয়ার আগেই পিএসসি দাবি করেছে বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। এটি অনেকটা 'ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না' ধাঁচের অবস্থা।
আরও পড়ুন
তারা বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি বলে দাবি করলেও ঠিক কোন কোন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছুও কিন্তু বলেননি। অর্থাৎ, তাদের বক্তব্য সত্য হয়ে থাকলে কোনো প্রশ্নপত্রই আসলে ফাঁস হয়নি। ওদিকে, প্রশ্নপত্র ফাঁসে সরাসরি যদি আবেদ আলীসহ গ্রেফতারকৃতদের বেশ কয়েকজন ইতিমধ্যেই বিসিএস পরীক্ষাসহ অন্য অনেক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করে কাড়িকাড়ি অর্থ উপার্জন করেছেন বলে স্বীকার করেছেন।
তাই, তদন্ত শেষের আগেই বিশেষ মহলকে বাঁচাতে পিএসসি এমন আগাম বক্তব্য দিয়েছে কিনা তাও গভীরভাবে খতিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে। নিঃসন্দেহে, চাকরির প্রশ্নফাঁস একটি অতি গর্হিত অপরাধ। এটি প্রকারান্তরে দেশের মেধাবী ও সৎ চাকরি প্রার্থীদের মুখে সরাসরি চপেটাঘাত।
তাছাড়া এ প্রক্রিয়ায় অর্থের জোরে অযোগ্য প্রার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি লাভ করে দেশের চাকরি ক্ষেত্রে ভয়াবহ নৈরাজ্য সৃষ্টি ও সার্বিক কর্মপরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করতে পারে।
কিছুকাল আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ড্রাইভার মালেক-এর বিপুল অর্থবিত্তের কাহিনি সারাদেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল। মালেকের স্মৃতি যখন মানুষের মনে কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে ঠিক সে সময় পিএসসির গাড়িচালক আবেদ আলীর ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা দেশবাসী জেনেছে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায়।
এককালের নিরীহ, হতদরিদ্র মালেক বা আবেদ আলীরা অপ্রতিরোধ্য ও ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে। শীর্ষকর্তাদের একাংশ এদের ব্যবহার করেন নিজেদের সীমাহীন লোভলালসা চরিতার্থ করতে।
এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কেবল আবেদ আলী বা নিচের পর্যায়ের কয়েকজনকে বিচারের আওতায় আনাই যথেষ্ট নয়। এদের পাশাপাশি বড় মাপের রুই কাতলাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে, যাদের আবেদ আলীরা খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আজকের অতি প্রভাবশালী পিএসসির আবেদ আলী বা স্বাস্থ্যের মালেক হয়েছেন। খুঁটি খুব শক্ত না হলে ছাগল এতটা নাচানাচি করতে পারে কি?
এম এল গনি ।। কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি)