ছবি : সংগৃহীত

‘ও আমার খালাতো ভাই, গল্প লেখে। পড়েছেন ওর গল্প? আমার বাড়ি পাবনা ওর বাড়ি বরিশাল’

মাকিদ হায়দার কারও সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময়ে এমন করে সংলাপ রচনা করতেন। কেন বলতেন ও আমার খালাতো ভাই, পেছনে দারুণ ঘটনা আছে।

শৈশবে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে সিদ্ধান্ত নিই, লেখক হবো। আমার নাম ছিল মনিরুল ইসলাম। কিন্তু লেখক হিসেবে এই নামটি আমার পছন্দ ছিল না, একটু আধুনিক নাম খুঁজছিলাম। সেই সময়ের পত্রপত্রিকায় অনেক লেখকের ভিড়ে জিয়া হায়দার—দুটি শব্দের নাম আমার পছন্দ হয়ে যায় এবং মনি হায়দার নামে নবম শ্রেণিতে নাম রেজিস্ট্রেশন করি।

তখন তো দূর মফস্বলে বসে আমি জানতাম না, জিয়া হায়দাররা ছয় ভাই। পাবনার এই হায়দার নামের ছয় ভাই লেখালেখির মতো সৃজনশীল শিল্পের সঙ্গে যুক্ত।

আশির দশকে ঢাকায় এসে লেখালেখির সঙ্গে সর্বক্ষণ জড়িয়ে যাওয়ার পর জানলাম—জিয়া হায়দার, মাকিদ হায়দার, রশীদ হায়দার, জাহিদ হায়দার, আবিদ হায়দার ও আরিফ হায়দার—ছয় ভাই। ছয় হায়দারের সঙ্গে আমিও যুক্ত হয়ে গেলাম। জিয়া হায়দারকে আমার নামের ঘটনা শুনিয়েছিলাম নব্বই দশকের মাঝামাঝি বাংলা একাডেমির প্রেসের ম্যানেজার বিশিষ্ট কবি ওবায়দুল ইসলামের রুমে বসে।

তিনিসহ যারা উপস্থিত ছিলেন, সবাই অবাক হয়েছিলেন। জিয়া হায়দার একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তিনি স্মিত হাসছিলেন। আমার নামের গল্প শুনিয়েছিলাম মাকিদ হায়দার, রশীদ হায়দার ও জাহিদ হায়দারকে। গল্প শোনার পর থেকেই মাকিদ ভাই মজার ছলে, প্রশ্রয়ের স্নেহে বলতেন, মনি আমার খালাতো ভাই।

আবার কোথাও দেখা হলে মাকিদ ভাই বলতেন, শোন এইবার পাবনায় এক লোক বলল, আপনাদের সব ভাইদের চিনি, দেখা হয়, কিন্তু মনি হায়দারের সঙ্গে দেখাও হয় না, পত্রিকায় গল্প পড়ি, পাবনাও আসে না কেন?

মাকিদ হায়দার; ছবি : সংগৃহীত

ও শহরে থাকতে পছন্দ করে, তবে একবার নিয়ে আসবো, তখন দেখা করিয়ে দেবো—বলেই মাকিদ ভাই গোঁফের নিচের দুই সারি দাঁত প্রকাশ করে হাসিতে ফেটে পড়তেন। আমিও মাকিদ ভাইয়ের সঙ্গে হাসিতে যুক্ত হতাম। মাকিদ ভাইয়ের সঙ্গে অজস্র ছোট, বড় লেখকদের সঙ্গে ছিল নিবিড় সম্পর্ক ছিল। করোনাকালে প্রত্যেক মানুষ যখন একজন থেকে বিচ্ছিন্ন, সেই বিচ্ছিন্নকালে তিনি প্রায়ই ফোন দিয়ে খবর নিতেন, কেমন আছিস?

তিনি আমাকে ‘তুই’ বলতেন। তার ‘তুই’ বলার মধ্যে বুক ভরা আশ্রয়, অনুরাগ, প্রেম আর স্নেহের অভয়ারণ্য ছিল। আমি জানি, তিনি আমার মতো আরও অনেক কনিষ্ঠ লেখকদের ‘তুই’ বলতেন। বলতেন, আয়, পাশে বস। তুই বলার মতো সাহস ও স্নেহ খুব কম মানুষই অর্জন করতে পারে।

তিনি খুব অনায়াসে হৃদয়ের আবেগে এই অসম্ভব অধিকার অর্জন করেছিলেন। শারীরিকভাবে ছিলেন বলিষ্ঠ, একই সঙ্গে বলিষ্ঠ শরীর কাঠামোর মধ্যে নিবিড় স্নেহ ও প্রশ্রয়ের বিশাল একটা মন ধারণ করতেন। ফলে, তিনি সব ভণ্ডামিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিখাদ অনাবিল আনন্দে সবার সঙ্গে মিশতেন।

তবে কি তার মধ্যে দুঃখ ছিল না? ছিল। তার সমসাময়িক প্রায় সবাই, কিংবা বয়সে ছোট—অনেকেই বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়ে গেছেন, কিন্তু সত্তর দশকের কবি মাকিদ হায়দার পাননি, তখনো। কোনো আড্ডায় প্রসঙ্গটি উঠলে তিনি নির্বাক হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতেন। তার এই নির্বাক মুখ ও বেদনামথিত দৃষ্টি আমার মনে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল।

অক্ষম আমি, কী করতে পারি? জিটিভিতে কবি আদিত্য নজরুলের প্রযোজনায় ‘শিল্পবাড়ি’ অনুষ্ঠান করে প্রতিবাদ করেছিলাম। সাধারণত এই অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। কিন্তু মাকিদ হায়দারের বেদনার সারথি হয়ে বাংলা একাডেমির পুরস্কার পাওয়ার আগেই তাকে অনুষ্ঠানে এনেছিলাম। অনুষ্ঠান প্রচারের পর ফোনে বলেছিলেন, তুই আমাকে সত্যিকারের পুরস্কারটা দিয়ে দিলি!

বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি জানিয়েছিলেন, তোদের চেষ্টা সফল হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কোনো একটা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কোনো পুরস্কার পাইয়ে দেওয়া যায় কি না, জানি না। কিন্তু প্রতিবাদের রূপরেখা তো তৈরি করা যায়। আমরাও সেই চেষ্টা করেছি মাত্র। বিরল সুখ ও আনন্দ পেয়েছি। কবি মাকিদ হায়দার কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন করেছেন শেষ পর্যন্ত।

মাকিদ হায়দার; ছবি : সংগৃহীত

২০১৯ সালে পাবনার কথাশিল্পী মোখলেস মুকুলের ‘মৃন্ময় বৃক্ষ’ উপন্যাসের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে গিয়েছিলাম আমরা। সাথে ছিলেন বিশিষ্ট কথাশিল্পী ঝর্না রহমান, ফরিদুর রহমান, কবি ফরিদ ছিফাতউল্লাহ এবং আরও অনেক লেখকের সঙ্গে আমি। ঢাকা থেকে উত্তরা পার হয়ে যাওয়ার সময়ে মাকিদ ভাইকে উত্তরার বাসা থেকে তুলেছিলাম মাইক্রোবাসে।

সারাটা পথে অজস্র গল্প আর হৈ হুল্লোড়ে গাড়ি ছিল নরক গুলজার। পাবনা শহরে মোখলেস মুকুলের অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে গাড়ি থামে মাকিদ ভাইদের বাড়ির সামনে। আমরা হইচই করে নেমে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করি। তখন দুপুর।

দোতলা সুন্দর একটা বাড়ি। পেছনে স্বচ্ছ টলটলে জলের বিশাল একটা পুকুর। আমরা ছাদে উঠে গেলাম। ডাব পাড়া হলো। একেকজন ডাব খাই আর ডজনে ডজনে ছবি তুলি। একজন মাকিদ হায়দার অজস্র মাকিদ হায়দার হয়ে আমাদের মধ্যে হাসিতে গল্পে আড্ডায় আর কবিতায় ছড়িয়ে পড়লেন।

কবিতার আজন্ম পথিক ছিলেন মাকিদ হায়দার এবং তার ভাইয়েরা। ব্যতিক্রম শুধু রশীদ হায়দার। তিনি লিখতেন গল্প-উপন্যাস। বাংলাদেশে তো বটেই, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে বিরল এক পরিবারের ছয় ভাই লেখার সঙ্গে যুক্ত। দাউদ হায়দার তো বাংলাদেশ নয় বিশ্বে খ্যাত। কবিতার যাত্রায় তিনি অদম্য, অতৃপ্ত এবং আপসহীন পরিব্রাজক।

মাকিদ হায়দারের অসংখ্য কবিতা আবৃত্তি শিল্পীরা আবৃত্তি করেন। কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা, তুলনা প্রতি তুলনার মধ্যে তিনি বাংলাদেশের আদিঅন্ত খুঁজে ফিরেছেন। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম যোদ্ধা মাকিদ হায়দার কবিতায় সৃজন করেছেন নির্মল বাংলাদেশের জলস্রোতের ঠিকানা। 

‘যত্নে থাকুক জনক আমার’ কবিতায় তিনি বাংলাদেশের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন গ্রামীণ লৌকিকতার গান...

‘যত্নে থাকুক সূর্যোদয়,
আমাদের রাজপথ, দুপুরের ভেজা রোদ,
শ্রাবণের মেঘ, বসন্তের দিন,
যত্নে থাকুক।

যত্নে থাকুক আমাদের প্রেম ভালোবাসা,
যাবতীয় কথা, ঝিলিমিলি আশা
গৃহস্থের সুখ, গৃহিণীর মায়া
ভোরের কুসুম, দুরন্ত রেলের গাড়ি, শীতে ভেজা
দোহারপাড়া, গোয়ালঘর, পথের মানুষ।
নদী ও নদের চেনাজানা।’

মাকিদ হায়দারের কাব্যগ্রন্থ অনেক নয় কিন্তু যে কয়টি কাব্যগ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন, প্রত্যেকদিন প্রতিটি কবিতা কালের দেয়ালে মর্মরিত আনন্দ, প্রেম, বিরহ, নন্দনতত্ত্ব, সৌন্দর্যবোধ নারীর প্রেম ও প্রজ্ঞা চয়ন করেছেন নিজস্ব সৃজন কীর্তিতে।

দশটি কাব্যের সন্ধান পাওয়া যায় তার। উল্লেখ্য—

  • রোদে ভিজে বাড়ি ফেরা
  • আপন আঁধারে একদিন
  • রবীন্দ্রনাথ: নদীগুলা
  • বাংলাদেশের প্রেমের কবিতা
  • যে আমাকে দুঃখ দিলো সে যেনো আজ সুখে থাকে
  • কফিনের লোকটা
  • ও প্রার্থ ও প্রতিম
  • প্রিয় রোকানালী
  • মমুর সাথে সারা দুপুর

মাকিদ হায়দার কবিতার পাশাপাশি গল্পও লিখেছেন। বিখ্যাত একটি গল্প ‘চেয়ার’। ‘মানুষ যখন ক্ষমতা প্রাপ্ত হইয়া চেয়ারে একবার বসে, সেই চেয়ারখানাকে মনে করে নিজের আজীবনের চেয়ার। কিন্তু সেই চেয়ার দখলের লড়াইয়ে যখন সহকর্মী নামে, তখন যে ফাইটটা হয়...’—কবি ও গল্পকার মাকিদ হায়দার ‘চেয়ার’ গল্পে সুস্পষ্ট বক্তব্যে নিরেট সত্য তুলে ধরেছেন।

মাকিদ হায়দার; ছবি : সংগৃহীত

তার সৃষ্টি ‘রোকনালী’ বাংলা সাহিত্য নতুন একটা ধারণার জন্ম দিয়েছে। কবিতার কাঠামোয় গল্পের মতো করে চরিত্র তৈরি করা যায়, এই দৃষ্টান্ত তিনি রাখলেন।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি ‘রোকনালী’ রহস্য ফাঁস করেছেন—

আমার ডাক নাম রোকন। আবার পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষের লোক ছিল শান্তিবাহিনীর লোকেরা, তাদের প্রায় সবাই জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। জামায়াত সদস্যদের একটি সাংগঠনিক স্তর হলো রোকন। রোকনালী হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী—যারা ধর্ষণ, হত্যা, ধ্বংসে মেতে উঠেছিল তাদের বিরুদ্ধে লেখা একটি প্রতীকী নাম। এজন্যই নামটি এমন।

মাকিদ হায়দার ও রোকনালী একটি সূত্রে অবিনাশী চেতনায় দুটি অস্ত্র; একটি স্বাধীনতা, অন্যটি রোকনালী! তার সাহিত্য, কবিতা স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমাদের মাঝে।

মনি হায়দার ।। কথাসাহিত্যিক