ছবি : সংগৃহীত

"মহব্বত নগর গ্রামে প্রবেশ করে আলুথালু বেশের উদভ্রান্ত এক মানুষ। দেখাতে শুরু করে নিজের ক্ষমতা। এক পর্যায়ে সর্বগ্রাসী হয় তার বিস্তার..."

লালসালুর মজিদ চরিত্রের বিষয়ে কথাগুলো বলেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। মজিদের মতো লোকেরা যুগে যুগে নানা সময়ে আমাদের সমাজে ছিল, থাকবে। এদের একেবারে উপড়ে ফেলা কোনোভাবেই সম্ভব না। তবে ইদানীং কালের নানা ঘটনায় মজিদরূপী মানুষের উপস্থিতি এবং বিস্তার বড় বেশি চোখে পড়ছে।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মজিদ শুধু মহব্বত নগর গ্রামে সর্বগ্রাসী বিস্তার ঘটিয়েছিল। ইদানীং কালের যে মজিদদের কথা বলছি তাদের বিস্তার গোটা দেশজুড়ে। ক্ষেত্র বিশেষে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যাচ্ছেন তারা।

সরকারি চাকরির প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন ১৭ জন। এদের মধ্যে সৈয়দ আবেদ আলীকে নিয়ে আলোচনা বিস্তর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভরে গেছে তাকে নিয়ে বিভিন্ন ট্রলে। সামাজিক মাধ্যমে তার ছেলে তাকে নিয়ে বিভিন্ন পোস্ট দিয়েছিল সেইসব নিয়েই ট্রল হচ্ছে।

আবেদ আলী পিএসসির গাড়ি চালক। গাড়ি চালক, সেটা ট্রলের বিষয় নয়। ট্রলের বিষয় হলো, তার সততা ও ধার্মিকতার ভুয়া লেবাস নেওয়াকে কেন্দ্র করে, বিভিন্ন সময়ের নামাজ পড়ার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্ট করা নিয়ে।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, তিনি এলাকার বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করতেন দুই হাতে। এত যে টাকা বিলি করতেন, এইসব তো তার নিজের আয়ের টাকা নয়, সবই অবৈধভাবে আয় করেছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে সেইসব আয়ের টাকা।

কারণ এই আবেদ আলী প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকায় বানিয়েছেন, বানিয়েছেন পাহাড়সম সম্পদ। বনেছেন তিন তারকা হোটেলের মালিক। সেই তিনিই গ্রেফতারের পর বলেছেন, প্রশ্নফাঁসের টাকা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেছি! ভেবে দেখুন শঠতা, নির্লজ্জতা আর ভণ্ডামির কোন মাত্রায় গেলে একজন মানুষ এমনটা বলতে পারেন!

গণমাধ্যমের খবর বলছে, তিনি এলাকার বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করতেন দুই হাতে। এত যে টাকা বিলি করতেন, এইসব তো তার নিজের আয়ের টাকা নয়, সবই অবৈধভাবে আয় করেছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে সেইসব আয়ের টাকা।

এলাকার মানুষের কাছে তার পরিচয় ছিল বিশাল দানবীর হিসেবে। সাধে কি আর বলছিলাম, এই যুগের মজিদরা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মজিদকে ছাড়িয়ে গেছেন বহুগুণে!

অবৈধ পথের আয় দিয়ে শুধু দানবীরই বনে যাননি, হতে চেয়েছিলেন জনপ্রতিনিধি। তাও আওয়ামী লীগের। মাদারীপুরের ডাসারের উপজেলা চেয়ারম্যান হতে চেয়ে তার লাগানো পোস্টারের ছবি এখন ঘুরছে সামাজিক মাধ্যমে। নিজের ছেলেকে আবেদ আলী বানিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা।

অর্থাৎ দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল টাকা বানিয়ে, সেই টাকা আবার বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে সামাজিক মর্যাদা প্রতিপত্তি এবং স্বীকৃতি সবই কিনে নিয়েছিলেন তিনি। বাকি ছিল শুধু জনপ্রতিনিধি হওয়া। এটা যদি হতে পারতেন তিনি, তাহলে হয়তো স্থায়ীভাবে একজন মর্যাদাবান মানুষ বনে যেতেন।

শরীরে একবার জনপ্রতিনিধির তকমা লেগে গেলে আর কী লাগে। জীবনে তখন যদি কোনোভাবে তার দুর্নীতির অন্ধকার অধ্যায় বের হয়ে আসতোও তাকে খুব ভালোভাবেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে উড়িয়ে দেওয়া হতো, তা নিশ্চয় আবেদ আলী খুব ভালো করেই জানেন।

এই সময়ের আরেক আলোচিত চরিত্র এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা ছাগলকাণ্ডের মতিউর রহমান। তিনিও নাকি বন্ধুদের সবসময় সৎপথে চলার, ধর্মকর্ম করার পরামর্শ দিতেন। নিজের গ্রামের এবং আশপাশের মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করতেন দুই হাতে। মূলত অবৈধ অর্থই দান করতেন।

এলাকার মানুষের কাছে খুবই সৎ পরোপকারী এবং ধর্মপরায়ণ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। তার নানা কুকীর্তির কথা এলাকার মানুষ বিশ্বাস করতে চান না কিছুতেই। কারণ তারা মতিউরের কাছে কোনো না কোনোভাবে উপকারভোগী ছিলেন।

ধার্মিক হওয়া, ধর্মের বিধি বিধান মেনে চলা প্রত্যেক ধর্মের মানুষের নৈতিক দায়িত্ব এবং তাই কাম্য। কিন্তু সৈয়দ আবেদ আলী, বেনজীর আহমেদ কিংবা মতিউর রহমানের মতো লোকেরা ধর্মকে তাদের অপকর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন সবসময়।

একই কথা খাটে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, কিংবা পুলিশের সাবেক ডিআইজি মিজানুর রহমানের ক্ষেত্রেও। মিজানুর দুর্নীতির মামলায় এখন জেল খাটছেন। আর বেনজীর কোথায় আছেন তা স্পষ্ট করে কেউই বলতে পারছেন না। এই দুইজনও ধার্মিকের লেবাস পরেছেন, করে গেছেন দুর্নীতি নানা অপকর্ম।

ধার্মিক হওয়া, ধর্মের বিধি বিধান মেনে চলা প্রত্যেক ধর্মের মানুষের নৈতিক দায়িত্ব এবং তাই কাম্য। কিন্তু সৈয়দ আবেদ আলী, বেনজীর আহমেদ কিংবা মতিউর রহমানের মতো লোকেরা ধর্মকে তাদের অপকর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন সবসময়। সাধু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন, এটা সমাজে মারাত্মক ভুল বার্তাই শুধু দেয় না, সমাজকে একেবারে কলুষিত করে ফেলে।

২০১৮ সালের দিকে মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছিল দেশজুড়ে। তখন কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে ঢাকায় প্রবেশের সময় যাত্রাবাড়ি এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন একজন ধর্মীয় শিক্ষক। শহিদুল্লাহ নামের সেই হাফেজকে যাত্রাবাড়ির একটি পেট্রোল পাম্পের নামাজের স্থানে ইয়াবার হাত বদলের সময় হাতেনাতে গ্রেফতার করেছিল গোয়েন্দা পুলিশ।

পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছিলেন, ধর্মীয় লেবাসের কারণে পথে কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে তল্লাশি করতো না। আর এই সুযোগ নিয়ে প্রায়ই মাদকের চালান নিয়ে ঢাকায় আসতেন। তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন করার পর সামাজিক মাধ্যমে একশ্রেণির মানুষ নেতিবাচক মন্তব্যে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।

যদি এখনকার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করি, তাহলে কি বলা যায় না, ধর্মীয় পরিচয় কিংবা ধর্মের লেবাস ব্যবহার করে অপরাধ করার চেষ্টা নতুন নয়। আর তা নিয়ে কথা বলা, আলোচনা করা, লেখা কিংবা প্রতিবেদন করা মানেই ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা নয়। বরং যিনি ধর্মকে ব্যবহার করছেন নিজের অপকর্মের ঢাল হিসেবে তার মুখোশ উন্মোচন করে দিতে হবে। মুখোশ খুলে দিতে হবে সব অপরাধীদের।

প্রত্যেক মানুষের কাছে তার নিজের ধর্ম খুবই সংবেদনশীল। সব ধর্মের প্রতি সবার সর্বোচ্চ সম্মান। আর সব অপরাধীর প্রতি সর্বোচ্চ ঘৃণা। এই হোক সবার নীতি। নীতিবাক্যের গালভরা বুলি নয়, আমাদের সমাজ এবং দেশ সত্যিকারের সৎ নীতিবান মানুষে ভরে উঠুক, এইটাই চাওয়া।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। গণমাধ্যমকর্মী