ছবি : সংগৃহীত

ছোটবেলায় আমাদের পাঠ্যবইয়ে একটি কবিতা পড়ানো হতো ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ যেখানে বাদশা শাহজাদা তার শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন আর বাদশাহ তা দেখেন, শিক্ষককে ডাকেন এবং তার ছেলে যে নিজ হাতে পা না ধুয়ে শুধু পানি ঢেলেছেন এর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

এখন কেন জানি পাঠ্যপুস্তকে এসব পড়ানো হয় না। এর কারণ দুটি হতে পারে। এক. শিক্ষকদের মর্যাদা এদেশে এত বেশি যা আর নতুন করে জানানোর প্রয়োজন নেই। দুই. শিক্ষকদের স্থান এত নিচে নামানো হয়েছে যেখানে সম্মান বা মর্যাদা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

আজকে শিক্ষকরা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ন্যায্য প্রাপ্যতা পাওয়ার জন্য রাস্তায় নেমেছেন, কেউ একবার তাদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন মনে করেননি। শিক্ষকদের জন্য নতুন নীতিমালা প্রবর্তন করা হয়েছে, প্রত্যয় নামক স্কিম সংযোজন করা হয়েছে। অথচ কোনো শিক্ষক প্রতিনিধির মতামত নেওয়ার দরকার হয়নি, কোনো শিক্ষক প্রতিনিধির সাথে দেখা করার সময় হয়নি।

আজকে শিক্ষকরা যখন নিরেট বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে তখন অনেক বিষয় সামনে আসছে। অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি বা র‍্যাঙ্কিং নিয়ে, শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে, নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমি আজকে কিছু তিক্ত সত্য অবলম্বনে আপনাদের প্রশ্নের আলোকপাত করবো।

প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি বা র‍্যাঙ্কিং নিয়ে আলোচনা করা যাক। শুরুতেই আমাদের জানা প্রয়োজন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাঙ্কিং কোন বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল? আমরা যদি বহুল আলোচিত ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ এবং ‘কিউ এস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং’-এর কথা বলি।

‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ র‍্যাঙ্কিং নির্ভর করে পাঁচটি বিষয়ের ওপর (শিক্ষাদান, গবেষণার পরিবেশ, গবেষণার মান, প্রতিষ্ঠানের গবেষণার বাণিজ্যিক প্রভাব, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি)। অন্যদিকে, ‘কিউ এস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিং’ নির্ভর করে ছয়টি বিষয়ের ওপর (প্রতিষ্ঠানের রেপুটেশন, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করা শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রের সফলতা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের অনুপাত, কর্মরত শিক্ষকদের গবেষণা কর্ম ও তার সাইটেশান বা উদ্বৃতিসমূহ, আন্তর্জাতিক ফ্যাকাল্টির অনুপাত এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের অনুপাত)।

সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়, র‍্যাঙ্কিং নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের গবেষণার পরিবেশ, গবেষণা এবং তার প্রকাশনা, গবেষণার বাস্তবিক প্রয়োগ, প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ, দেশি-বিদেশি শিক্ষক, দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থী এবং কর্মক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের প্রভাবের ওপর।

প্রথমে গবেষণার বিষয়ে আসা যাক। আমাদের গবেষণার পরিবেশ কেমন? গবেষণার জন্য বরাদ্দ কেমন? আমাদের শিল্পকারখানাগুলো আমাদের গবেষণা কর্ম নিতে আগ্রহী কিনা? একটি কনসালটিং ফার্মের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ‘অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধীনে, শিক্ষা বাজেট অর্থবছর ২০১৯- এ জিডিপি এর ২ শতাংশ থেকে অর্থবছর ২০২৫ এর মধ্যে ৩.৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, যেখানে বরাদ্দ জিডিপির মাত্র জিডিপির ১.৬৯ শতাংশ। যা জিডিপির শতাংশ হিসাবে শিক্ষার ওপর গড় ব্যয় ৩৮টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন।’

আমাদের গবেষণার ভালো ফলাফল পেতে হলে গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন, যথাযথ ল্যাব প্রয়োজন, গবেষকদের উপযুক্ত বেতন ভাতা প্রয়োজন। আমরা কি এইসব নিশ্চিত করতে পেরেছি? আজকে বাংলাদেশের মেধাবী গবেষকরা দেশের বাইরে চলে যান, বাইরের কোনো গবেষক এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন না। এর কারণ কী?

পেট খালি রেখে নীতির বুলি আওড়ে বড়জোর চার-পাঁচ দিন থাকা যায়। মাসের পর মাস থাকা যায় না। তারপরও ড. জামাল নজরুল ইসলামের মতো মানুষজন নাড়ির টানে দেশে ফিরে আসেন। ফিরে আসেন তার ভালোবাসার, ভালোলাগার মাতৃভূমির কোলে। তাদের কি আমরা উপযুক্ত মূল্যায়ন করি? 

শিল্পকারখানায় আমাদের দেশের গবেষণার অবদান কেমন এই কথা ভাবতেই চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে বিজ্ঞানী মোবারক আহমদ খানের কথা। যিনি তার অসাধারণ আবিষ্কার পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প সোনালী ব্যাগ নিয়ে বসে থাকেন, কিন্তু কোনো শিল্প উদ্যোক্তার দেখা মেলে না। পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশে হলে এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে যেত এতদিনে।

মনে পড়ে যায়, কোনো বিজ্ঞানীর মনে কতটা আক্ষেপ থাকলে বলেন, ‘ধান নিয়ে গবেষণা না করে যদি আমি ধান নিয়ে কবিতা লিখতাম তাহলে এদেশে বুদ্ধিজীবীদের কাতারে গণ্য হতাম।’ উন্নত বিশ্বে এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও শিল্পকারখানাগুলো শিক্ষা-গবেষণা খাতে অনেক বিনিয়োগ করে। করোনা পরবর্তী সময়ে এই বিনিয়োগ বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।

গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স-এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের বড় বড় ২৫০০ কোম্পানির শিক্ষা গবেষণায় বিনিয়োগ ২০২২ সালেই ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে প্রায় ২২টির অধিক কোম্পানি আছে যারা শিক্ষা গবেষণায় অনেক বিনিয়োগ করে। আমি জানি না আমার দেশে এমন কয়টি কোম্পানি আছে! একটি দেশকে উন্নতির শিখরে নিতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। এটা আমাদের মন থেকে অনুভব করা উচিত।

যদি দেশি-বিদেশি শিক্ষক অথবা শিক্ষক শিক্ষার্থীর সঅনুপাত, বিদেশি শিক্ষার্থীর অপ্রতুলতা এসব বিষয়ে আসি, তাহলেও অসামঞ্জস্য চোখে পড়ার মতো। আসলে শিক্ষকতা মহান পেশা। এই কথা শুনেই আমরা বড় হই। তারা চাইলেই অন্য অনেক পেশার মানুষের মতো জীবনযাপন করতে পারেন না। এই পেশায় তরুণদের ধরে রাখতে চাইলে এই পেশার প্রতি তাদের আকর্ষণ জাগাতে হবে। আমরা কতটুকু পেরেছি তা করতে?

আমরা যদি বেতন ভাতা সুযোগ-সুবিধার কথা বলি তাহলে অবহেলিতদের মধ্যে অন্যতম এই পেশাজীবীরা। বিশ্বে তো বটেই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সর্বনিম্ন বেতন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। আর এই বেতন ভাতা যেখানে দেশীয় তরুণদের ধরে রাখাই কষ্টকর সেই জায়গায় কোনো বিদেশি শিক্ষক আসবেন এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে?

আমাদের অনেক কর্মকর্তা বাইরের দেশে যান পুকুর খনন দেখতে, খিচুড়ি রান্না শিখতে, তারা যদি দয়া করে উন্নত বিশ্বের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে চলে তা একটু দেখতেন!

ইউজিসির ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ৫৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৪৪, এই অনুপাত যত বেশি কম রাখা যায় তা র‍্যাঙ্কিং-এর জন্য মঙ্গল। আমরা কি তা নিশ্চিত করতে পেরেছি? আর বিদেশি শিক্ষার্থীর কথা যদি বলি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ শতাংশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ শতাংশ ব্যতীত অন্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শূন্যের কোটায়, অন্যদিকে বাইরের প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এর পরিমাণ ২০ শতাংশের ওপরে।

বিদেশি একজন শিক্ষার্থী কখন আসবেন যখন তাকে উপযুক্ত বৃত্তি, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে। আমরা কি আমাদের অধ্যাপককে ঐ পরিমাণ অনুদান দিতে পেরেছি? আমরা কি পেরেছি শিক্ষাখাতকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মান, মর্যাদা বা জীবনমান নিশ্চিত করতে? যেখানে আমাদের বিদ্যমান উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুনগত মান নিশ্চিত করতে আমরা ব্যর্থ, সেখানে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। যদি কোনো কিছুর মান কমাতে চাও, তাকে সকলের হাতের নাগালে দিয়ে দাও।

এই কাজটি সযত্নে করা হচ্ছে। পৃথিবীর বাইরের দেশগুলোয় সবাই উচ্চ শিক্ষিত নন, চীনে কারিগরি শিক্ষায় বেশি জোর দেওয়া হয়। এসবের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজন নেই। কিছু বিশেষায়িত কলেজ যথেষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে আরও বেশি গবেষণা ধর্মী করার জন্য সংখ্যা না বাড়িয়ে, বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর গুণাগুণ মানে বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। উচ্চশিক্ষিত বেকার উৎপাদনের চেয়ে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত কর্মী তৈরি কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?

যোগ্যতা আর নিয়োগের বিষয়ে যদি বলি, সাধারণত একটি নিয়োগে একটি শূন্য পদের বিপরীতে প্রায় ১৫-২০ জন আবেদন করেন, যেখানে প্রায় ৪-৫টি ব্যাচের ১ম, ২য় বা ৩য় স্থান অধিকারী শিক্ষার্থীরা আবেদন করেন। আবেদনের যোগ্যতা ৩.৫০/৪.০০ পূরণ করেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী প্রার্থীরা আবেদন করেন। সেই জায়গায় সনদপত্র যাচাই বাছাই শেষে প্রায় ৮-১০জন প্রার্থীকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচনের জন্য ডাকা হয়।

এই প্রার্থীদের সবাই অসম্ভব মেধাবী কিন্তু নেওয়া হবে একজন। সেই ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকারের নির্বাচন বোর্ডে সদস্যবৃন্দ প্রার্থীর সিজিপিএ-এর সাথে তার গবেষণা কর্ম, অভিজ্ঞতা, নিজেকে উপস্থাপন করার দক্ষতা সবকিছু মিলিয়ে সেরাদের সেরাকে বাছাই করার চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে অনেক সময় কোনো কোনো ব্যাচের ১ম বা ২য় বাদ পড়ে যেতে পারেন। আসলে এত অল্প সময়ে একজন প্রার্থীকে নির্বাচন করা বোর্ডে যারা থাকেন তাদের পক্ষেও অনেক কষ্টসাধ্য।

কোনো মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। মাঝেমধ্যে নির্বাচন প্যানেলে যারা থাকেন তারাও ভুল করেন। তাই বলে আমরা ঢালাওভাবে শিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তলতে পারি না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে একটি কথা বলবো, যোগ্যতা ব্যতীতকেও এই পেশার কোনো পদে আবেদন করতেই পারেন না।

সবশেষে, আমরা যেখানে যে অবস্থায় অবস্থান করি না কেন, বাস্তবতা উপলব্ধি করা উচিত। কাউকে ছোট করা, দোষারোপ করা বা হেয় করা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। হয়তো আমরা অনেকেই আমাদের কর্মক্ষেত্রে শতভাগ দিতে পারি না। হয়তো বা অনেকেরই অনেক অভিযোগ বা অনুযোগ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি।

তারপরও, এই যে এত শত বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করেও আমাদের শিক্ষকরা এগিয়ে যাচ্ছেন, বিশ্ব দরবারে গবেষণায় ও কর্মক্ষেত্রে দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন, এই বিষয়টা কি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য নয়? আর শিক্ষকদের জীবনমান বা ভবিষ্যতে যারা এই পেশায় আসতে চান তাদের জন্য আজকের শিক্ষক সমাজের রাস্তায় নেমে আসা কি খুব বেশি অযৌক্তিক? আশা করি আমাদের সুউচ্চ মহল বিষয়গুলো নিয়ে একটু ভাববেন। তাদের সদয় দৃষ্টিই পারে সবকিছুর সুষ্ঠু সমাধান দিতে।

মো. নোমান হোসাইন ।। প্রভাষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়