ছবি : সংগৃহীত

প্রসঙ্গ এক, বছর দুয়েক আগের কথা। আমি চীন ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের একটা কোম্পানিতে চাকরি করতাম। আবাসন, যাতায়াত সুবিধা ছাড়া স্যালারি আমার বর্তমান পেশার চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু শিক্ষকতার প্রতি অদম্য ভালোবাসা, আর উপমাবিহীন ভালোলাগা থেকেই এই পেশায় আসা।

এই পেশায় আগ্রহ তৈরি হয় আমার অনেক আগে। স্কুলজীবনে মাঝে মাঝেই গণিতের শিক্ষক ডেকে নিতেন আমাকে। বোর্ডে গাণিতিক সমস্যা সমাধান করে বুঝিয়ে দিতে হতো সহপাঠীদের।

মূলত তখন থেকেই এই পেশার প্রতি আলাদা টান সৃষ্টি হয়। চেষ্টা করি আমার সব কোর্স শেষে শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক নিতে। তাদের ইতিবাচক মূল্যায়ন আমাকে অনুপ্রাণিত করে, অপার্থিব মানসিক প্রশান্তির একটা সুবাতাস অনুভব করি, পুলকিত হই নতুন ভোরের প্রয়োজনে।

প্রসঙ্গ দুই, আমি তৃতীয় বর্ষ থেকে মনোযোগী হই গবেষণার কাজে। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক জার্নালে আমার গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়। সরকারি বিশেষ কিছু চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেইনি আমি।

ওই চাকরিগুলোর ফর্ম পর্যন্ত পূরণ করা থেকে বিরত ছিলাম। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসেন, বলতে দ্বিধা নেই; তারা অনেক সুযোগ পায়ে ঠেলেই আসেন।

দেশের প্রথম সারির মেধাবীরা আসেন আবেগ, ভালোবাসা আর এক বুক ভালোলাগা থেকে। এই মানুষগুলো চাইলেই অন্য যেকোনো চাকরিতে প্রবেশ করতে পারেন। এই সামর্থ্য তাদের ছিল, আছে এবং থাকবে।

আজ অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হচ্ছে আমার পছন্দের এই পেশা এখন ভালো নেই, সুস্থির নেই। একদল মানুষের অবিরাম চক্রান্তে জর্জরিত মহান এই পেশা। তারা চায় না জাতির মেরুদণ্ড সোজা থাকুক, তারা চায় না ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভালো থাকুক।

এই জন্য অতি সূক্ষ্ম পরিকল্পনার আলোকে মেধাবীদের এই পেশা থেকে সরানোর অপচেষ্টা চলছে। ‘যদি তুমি কারও ভালো থাকা নষ্ট করতে চাও, তবে তার সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নাও’। আর এই কাজটিই সযত্নে সফল করার মহাপরিকল্পনা চলছে।

আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রেই আমলাতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় একজন নবম গ্রেডের কর্মকর্তা, একজন প্রথম গ্রেডের অধ্যাপক থেকে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন।

একজন প্রথম গ্রেডের শিক্ষক কখনো আবদার করেননি তার নিজের জন্য দামি গাড়ি, বাড়ি, গাড়ির তেল খরচ, বাসার কাজের লোকের মাসিক বেতন ইত্যাদি, যা একজন আমলা পেয়ে থাকেন।

এমন কোনো ঘটনা কেউ প্রত্যক্ষ করেননি যেখানে শিক্ষকরা কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন, সন্তান, স্ত্রী, শ্বশুর-শাশুড়ির নামে-বেনামে প্লট কিনেছেন। অথবা দেশের বাইরে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি করে, ব্যাংক লুটপাট করে টাকা পাচার করেছেন।

শিক্ষকরা তার ন্যায্য পাওনার কথা বলছেন, যা শেষ জীবনে প্রদেয়। তা থেকেও বঞ্চিত করার অপচেষ্টা চলছে। দিনশেষে আমরা কেন জানি ভুলে যাচ্ছি, শিক্ষকরাও মানুষ, তাদেরও পরিবার আছে, ব্যক্তিগত জীবন আছে।

আমরা অনেক চাকরিতেই দেখতে পাই দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের লাইফস্টাইল প্রথম শ্রেণির শিক্ষকদের থেকে উন্নত, একমাত্র কালো টাকার জোরে। শিক্ষকরা দুর্নীতি করেন না, কালো টাকা সাদা করেন না, তারা তাদের অমানুষিক পরিশ্রমে জীবনযাপন করেন।

একটা দেশে যখন নিজের প্রাপ্যতা ফিরে পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের মানুষদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করা হয়, এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে?

যাই হোক, আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তা থেকে উত্তরণের একমাত্র ভরসার জায়গা আমাদের আস্থাভাজন, শ্রদ্ধেয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

আশা করি, তিনি অবশ্যই আমাদের আস্থার, ভরসার জায়গা থেকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের বিষয়টি দেখবেন এবং এর সুষ্ঠু সমাধানের ব্যাপারে আশাজাগানিয়া পদক্ষেপ নেবেন।

মো. নোমান হোসাইন ।। প্রভাষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট