ছবি : সংগৃহীত

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে দুর্ধর্ষ জঙ্গি হামলা হয়। হোলি আর্টিজান ঘটনার পর পুলিশ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করে। এইসব অভিযানে বহু সংখ্যক জঙ্গি ধরা পড়ে, কেউ কেউ অভিযানে নিহত হয় এবং কেউ কেউ আত্মাহুতি দেয়।

আত্মঘাতী টিমগুলো শনাক্ত করে তাদের নির্মূল করা হয়। ২০১৭ সালের পর বাংলাদেশে জঙ্গিরা আজ পর্যন্ত তেমন শক্তি সঞ্চার করে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু তারা শেষ হয়ে যায়নি। বিভিন্ন নামে নতুন করে জঙ্গিরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চায়।

জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নির্মূল করা কঠিন। শুধুমাত্র পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা অভিযান, গ্রেপ্তার, তদন্ত ও বিচারের জন্য আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের মাধ্যমেই জঙ্গিবাদ নির্মূল বা পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।

যেমন—

ধর্মান্ধতা:

এক শ্রেণির লোক আদতে ধর্মান্ধ। তারা ধর্ম নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি করে এবং কোরআন ও হাদিসের খণ্ডিত ও মনগড়া ব্যাখ্যা, জান্নাতে যাওয়ার ভুল ও অবাস্তব প্রচারণা বিশ্বাস করে জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়ে জিহাদি হয়। তাদের এমন মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা থেকে বের করে আনা একটি চ্যালেঞ্জ।

ব্রিডিং ক্ষেত্র:

বাংলাদেশ মুসলিম বেশি হওয়ায় বাংলাদেশকে জঙ্গি তৈরির ব্রিডিং ক্ষেত্র বিবেচনা করে এখানে জঙ্গিবাদের সম্প্রসারণের জন্য জঙ্গি সংগঠনের নেতারা লোক নিয়োগ করে কর্মসূচি দেয়। মুসলিম রাষ্ট্রে জঙ্গি বিস্তার রোধ করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ।

ডিজিটাল প্রোপাগান্ডা:

জঙ্গি সংগঠনে অসংখ্য আইটি এক্সপার্ট আছে। তারা ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের ব্যাপক প্রোপাগান্ডা ও প্রচার চালায়, মতামত ব্যক্ত করে, জিহাদে যোগ দিতে প্ররোচনা দেয়, জঙ্গি সংগঠনে সদস্য নিয়োগ করে, প্রশিক্ষণ দেয় এবং কর্ম তৎপরতা তুলে ধরে। কিন্তু পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিদের এমন তৎপরতা সহজে বন্ধ করতে পারে না।

জঙ্গিবাদের পক্ষে কৌশলে প্রচারণা :

এক শ্রেণির শিক্ষক, আলেম, মাওলানা ও বিদ্বান ব্যক্তিরা কৌশলগত অবস্থানে নিয়ে পরোক্ষভাবে জঙ্গিবাদের পক্ষে বক্তব্য রাখে। কেউ কেউ গোপনে জঙ্গিবাদের পক্ষে কাজ করে, মদদ দেয় ও তাদের আদর্শ প্রচার করে। এদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা অত্যন্ত কঠিন। 

জঙ্গিবাদ পুরোপুরি নির্মূল করা কঠিন। শুধুমাত্র পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারা অভিযান, গ্রেপ্তার, তদন্ত ও বিচারের জন্য আদালতে অভিযোগপত্র দাখিলের মাধ্যমেই জঙ্গিবাদ নির্মূল বা পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।

গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতা ও সমন্বয়হীনতা:  

গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা, জঙ্গিদের ব্যবহৃত বিভিন্ন অ্যাপস সম্বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সম্যক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ না থাকা, আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের কারণে জঙ্গিরা গোপনে তাদের কর্ম তৎপরতা চালাতে থাকে।

গোয়েন্দা সংস্থাসমূহের ব্যর্থতা ও সমন্বয়হীনতা একটা চ্যালেঞ্জ

ব্যক্তি নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্নতা:

জঙ্গিদের বেপরোয়া আচরণের কারণে কেউ কেউ নিজ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কৌশলগত অবস্থানে থাকে। তারা নিজ উদ্যোগে জঙ্গিদের আস্তানা খুঁজে বের করে অভিযান পরিচালনা করতে অনীহা প্রদর্শন করে। এই কারণে জঙ্গি অভিযান অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ে।

অপর্যাপ্ত সোর্স মানি:

জঙ্গি, চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, বেআইনি অস্ত্রধারী, চোর, ডাকাত তথা দুর্ধর্ষ অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে কিংবা তাদের অপরাধ ও অপরাধ সংঘটনের পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি সম্পর্কে গোপন তথ্য সংগ্রহ করার জন্য এজেন্ট বা সোর্স নিয়োগ করতে হয়।

অর্থের বিনিময়ে তারা পুলিশকে গোপন সংবাদ দেয়। কিন্তু সোর্সমানি খাতে সরকারের বরাদ্দ কম থাকায় ভালো ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক সোর্স নিয়োগ করা যায় না। যার কারণে জঙ্গিদের আস্তানা, গোপন কর্ম তৎপরতা ও পরিকল্পনা সম্বন্ধে সময়মতো সঠিক সংবাদ পাওয়া যায় না। এছাড়া দক্ষ, বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সোর্সেরও অভাব।

জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানকে বিতর্ক করা:  

জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানকে নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিতর্কিত ও বিভ্রান্তমূলক মন্তব্য জনমনে বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা:

পুলিশি তদন্তে ত্রুটি-বিচ্যুতি, বিচার কার্য অস্বাভাবিক বিলম্ব এবং গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের জামিনে বের হওয়ার কারণে জঙ্গিরা সুবিধা পেয়ে থাকে এবং নতুন করে নাশকতামূলক কাজ করতে সুযোগ পায়। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা জঙ্গি দমন প্রক্রিয়ায় একটি চ্যালেঞ্জ। 

জেলে মনিটরিং না থাকা:

জেলে জঙ্গিদের মনিটরিং-এর ভালো ব্যবস্থা থাকে না। জেলে থাকা অবস্থায় জঙ্গিরা গোপনে বাহিরের জঙ্গিদের সাথে যোগাযোগ করার সুযোগ পাওয়ার কারণে জঙ্গিরা জেলে অবস্থান করে অনেক সময় বাহিরে থাকা তাদের সহকর্মীদের দ্বারা জঙ্গি তৎপরতা চালায়।

সংশোধনের কোনো ব্যবস্থা না থাকা:

জেলে কিংবা জেলের বাহিরে জঙ্গিদের সংশোধনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় জঙ্গিরা তাদের ভুল আদর্শের প্রতি যে বিশ্বাস জন্মেছিল তা আরও শক্ত হয় এবং সে একজন পাকা জঙ্গিতে পরিণত হয়।

জঙ্গি ও জঙ্গি তৎপরতা সম্বন্ধে জনগণের সচেতনতার অভাব:

জঙ্গিবাদ একটি বড় ধরনের সামাজিক সমস্যা। এটা গোটা সমাজকে আক্রান্ত করে। কিন্তু জনগণ জঙ্গিবাদ সম্পর্কে সচেতন না। জনগণ সচেতন হলে জঙ্গিরা আস্তানা গড়ে তুলতে পারে না এবং তাদের কর্ম তৎপরতাও চালাতেও পারে না। তাদের সন্তানরাও জঙ্গি সংগঠনের সদস্য হতে পারে না। সচেতনতার অভাবে জনগণ জঙ্গিবাদ দমনে preventive and proactive কার্যক্রম গ্রহণ করছে না এবং তার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে না।

জঙ্গিবাদ দমনে করণীয়

কাউন্টার নেরেটিভ (counter narrative) :

জঙ্গিবাদ দমনে বিভিন্ন পদক্ষেপ ও উদ্যোগ নিতে হবে। জঙ্গিবাদের অপপ্রচারের বিপরীতে দেশের খ্যাত-অখ্যাত আলেম ওলামাদের সহায়তায় কোরআন ও হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা এবং জঙ্গিবাদের ভুল ও মনগড়া ব্যাখ্যার বিপরীতে সঠিক ব্যাখ্যা সম্বলিত কাউন্টার নেরেটিভ (counter narrative) তৈরি করে জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিতরণ করতে হবে এবং সভা, সমাবেশ ও সেমিনারের মাধ্যমে মানুষকে বুঝাতে হবে। এভাবে জনগণকে সচেতন করা গেলে তারা জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে এবং নিজের সন্তানকে নিরাপদে রাখবে।

জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানকে নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিতর্কিত ও বিভ্রান্তমূলক মন্তব্য জনমনে বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোবলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

পরিবারের দায়িত্ব:

পরিবারের কর্তা ও জ্যেষ্ঠ সদস্যদের তরুণ ও অল্প বয়সী সদস্যদের নিবিড় নজরে রাখতে হবে। তারা কোথায় যায়, কার সাথে মেশে, তাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা যায় কি না ইত্যাদি লক্ষ্য করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কেউ জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে গেলে তাকে পেশাদার কাউন্সিলর-এর মাধ্যমে কাউন্সিল করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে।

সরকারের দায়িত্ব:

সরকারকে জঙ্গিবাদ নির্মূলে সর্বাত্মক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দিয়ে প্রতিরোধের পাশাপাশি ব্যাপক অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে কাউন্টার নেরেটিভ তৈরি করে তা বিতরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক দেশগুলোর সহায়তা চাইতে হবে। স্কুল ও কলেজের সিলেবাসে জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা ও তা দমনে করণীয় বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা নেবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। সরকারকে জরিপ ও গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি, অবকাঠামো নির্মাণ, দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবল তৈরি, লজিস্টিক সাপোর্ট এবং মোটিভেশনাল ও প্রো-অ্যাকটিভ কার্যাবলী সচল ও গতিশীল রাখতে হবে এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রসেসে সব স্টেকহোল্ডারের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

একইসাথে যারা জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিয়েছে তাদের সংশোধন করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রতি প্রশাসনিক বিভাগে ডি-রেডিক্যালাইজড প্রোগ্রাম (De-radicalized program) চালু করে তা কার্যকর ও টেকসই (sustainable) করতে হবে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব:

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তুলবে। শিক্ষকগণ স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিবাদের কুফল ও ভয়াবহতা সম্পর্কিত বিষয়াবলী শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দেবেন।

সমাজের দায়িত্ব:

সুশীল সমাজ, এনজিও, বিভিন্ন  পেশাদার সংগঠন, মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার শিক্ষক, স্কুল,কলেজ ও ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, আলেম ওলামা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি তথা সব শ্রেণি ও মতের জনগোষ্ঠী জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে জঙ্গিবাদকে নির্মূল করার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ অব্যাহত রাখতে হবে।

এ কে এম শহীদুল হক ।। সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ