ছবি : সংগৃহীত

কেনসিংটন ওভালের পাশের সমুদ্রে রোহিত শর্মা ডুব দিয়েছেন কি না বলতে পারি না। দিয়ে থাকলে তা সৌরভ গাঙ্গুলীর অনুমান মতো ব্যর্থতার জ্বালা জুড়াতে নিশ্চয়ই নয়। বরং সাফল্যের আনন্দে এতদিনের তৃষিত হৃদয়কে সুনীল সলিলের অবগাহনে শান্ত করতে।

দক্ষিণ আফ্রিকার মতো পলাতক তকমাটা প্রায় সেঁটে যাচ্ছিল ভারতের গায়ে। তা প্রায় মৌরসী পাট্টা গেড়ে বসে যাওয়ার আগ মুহূর্তে খসিয়ে ফেলতে পারলেন রোহিতরা।

হ্যাঁ, রোহিতরাই। এখানে বহুবচন। সবার মিলিত অবদানেই দারুণ এক জয় ছিনিয়ে নিতে পারলো টিম ইন্ডিয়া। রোহিত অনেকটাই নিজের ব্যাটে চড়িয়ে ভারতকে এনে তোলেন ফাইনালে। যেখানে তার ব্যাটের অবদান মাত্র ৯ রান। কিন্তু তার প্রত্যাশা মতোই জমিয়ে রাখা রানগুলো ফাইনালের ২২ গজে ছেড়ে দিলেন বিরাট কোহলি।

আগের ৭ ম্যাচে যে কোহলির মোট রান মাত্র ৭৫, সেই কোহলিই একপ্রান্ত থেকে রোহিত-ঋষভ-সূর্যকুমারের অকাল বিদায়ের মিছিলে দাঁড়িয়ে একাই করলেন ৭৬ রান। তার সঙ্গে রানের আরেক জোগানদার হলেন অক্ষর প্যাটেল। তাতেই ভারত পেয়ে যায় লড়াই করার মতো রানের পুঁজি।

কিন্তু এই দক্ষিণ আফ্রিকা একটু অন্যরকম। এরা এতদিন সেমিফাইনালে গিয়ে হৃদয় ভাঙার অজস্র গল্প লিখে শোক থেকে জমিয়েছে শক্তি। এই বিশ্বকাপেও হারের কিনারায় গিয়ে প্রায় সবগুলো ম্যাচ জিতে দাঁড়িয়েছে ফাইনালে। তাই চাপ কাকে বলে তারা জানতো। জানতো সেই চাপ জয়ের মন্ত্রও। তাই বলার উপায় ছিল না যে ভারত কেক-ওয়াক করে ট্রফি নিয়ে যাবে কেনসিংটন ওভাল থেকে। রান তাড়ায় লড়াকু মানসিকতা প্রোটিয়ারা তাই দেখিয়ে দিয়েছে ভালোমতোই।

ভারত তাদের তৃতীয় ফাইনালে করলো টি-২০ বিশ্বকাপ ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১৭৬ রান। শুরুটা খুব ভালো না হলেও মাঝ ওভারে গিয়ে ভারতীয় বোলারদের ওপর তাণ্ডব চালান মূলত হেনরিখ ক্লাসেন, সঙ্গে কুইন্টন ডি কক। তাদের মিলিত ধ্বংসযজ্ঞে ভারত-বধ প্রায় যখন সম্পন্ন, খেলার মধ্যে মোচড় দেখা দিলো।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের জয়; ছবি : সংগৃহীত

৩০ বলে ৩০ রান দরকার, হাতে ৬ উইকেট। কত বল আর কত উইকেট হাতে রেখে প্রোটিয়ারা তাদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ জিতবে, এর বাইরে আলোচনার বিষয়বস্তু আর কিছু হতে পারে না তখন। সেইখান থেকেই হেরে বসলো এইডেন মার্করামের দল।

ভারতের উইকেট কিপার ঋষভ পন্ত পায়ের পেশিতে চোট পেলেন। তার শুশ্রূষার জন্য ব্যয় হলো কয়েক মিনিট। এই বিষয়টাই ক্লাসেনের মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটিয়ে থাকতে পারে।

এই দক্ষিণ আফ্রিকা একটু অন্যরকম। এরা এতদিন সেমিফাইনালে গিয়ে হৃদয় ভাঙার অজস্র গল্প লিখে শোক থেকে জমিয়েছে শক্তি। এই বিশ্বকাপেও হারের কিনারায় গিয়ে প্রায় সবগুলো ম্যাচ জিতে দাঁড়িয়েছে ফাইনালে। তাই চাপ কাকে বলে তারা জানতো।

রোহিত শর্মা বল দিলেন হার্দিক পান্ডিয়াকে। ফুল লেন্থে করা পান্ডিয়ার প্রথম বলটিকেই শরীর থেকে একটু দূরে সরে ব্যাট চালিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ ক্লাসেন। তার ফেলে আসা ২৭ বলে ৫২ রানের ইনিংসটা তখন যেন কান্না ছাপিয়ে ভারতীয়দের সম্ভাবনার হাসি হয়ে ঝরছে।

এরপর শেষ স্পেলে ফিরে যশপ্রীত বুমরা ফেরান মার্কো ইয়ানসেনকে। তখনো আশা শেষ হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকার। আরেক প্রান্তে টিকে আছেন ডেভিড মিলার, সাদা বলে বোলারদের শিরদাঁড়ায় নিয়মিতই কাঁপন ধরান বলে যার পরিচিত ‘কিলার মিলার’। শেষ ওভারে দরকার ১৬ রান। চারটি বাউন্ডারি হলেই মামলা শেষ।

পান্ডিয়ার প্রথম বলটি ফুল টস, ওয়াইড। হাঁকালেন মিলার। লং অফ বাউন্ডারির বাইরেই তার ঠিকানা লেখা ছিল। কিন্তু অলৌকিকভাবে  ক্যাচ বানিয়ে ফেললেন সূর্যকুমার যাদব, যার ব্যাটে বরাবরই আস্থা খোঁজা ভারতকে টানা তিনটি সাদা বলের ফাইনালে কেবল হতাশাই উপহার দিয়েছেন।

ওয়াইড লং অফ থেকে দৌড়ে এসে শরীর ভাসিয়ে দেন হাওয়ায়, ভেসে থাকা অবস্থায় বল চালান করে দেন মাঠের মধ্যে। তারপর অদ্ভুতভাবে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে তালুবন্দি করেন ক্যাচ। এই ক্যাচটি কেমন তা শুনতে পারেন কপিল দেবের কাছে।

১৯৮৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালে ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচ নিয়েছিলেন কপিল অবিশ্বাস্যভাবে। ওই ক্যাচটিই ভারতকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেছে কি না সেই ঘোর আজও পৃথিবীর কাটেনি। সূর্যকুমারের এই ক্যাচটিও অনন্তকাল থেকে যাবে টি-২০ ক্রিকেটের বিশ্ব জয়ের উপাখ্যানে।

যারা এই ফাইনালকে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা দিলো স্নায়ুক্ষয়ী লড়াইয়ের আগুন জ্বেলে, তাদের চোকার্স বলাটা অন্যায্য হবে। তবে মিলারের বিদায়ের পর এটি নিশ্চিতই বলে দেওয়া গিয়েছিল, বাকি পাঁচ বল থেকে ১৬ রান তুলতে পারবে না দক্ষিণ আফ্রিকা। শেষ বলটিকে ডিপ মিডউইকেটে পাঠিয়ে নর্কিয়া একটি রান নেওয়ার পর সব শেষ।

প্রোটিয়ারা ডুবে গেছে পরাজয়ের বিষাদে। কিন্তু ভারতীয়দের চোখেও তো তখন জল আর জল। শ্রাবণধারা। রোহিত কাঁদছেন, হার্দিক কাঁদছেন। সিরাজের চোখে অশ্রু। বুমরার চোখ বাষ্পরুদ্ধ। রোহিত চুমু খাচ্ছেন হার্দিককে। আবেগে জড়িয়ে ধরেছেন স্ত্রীকে। শরীরের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে তার অশ্রুভেজা চোখ। বুমরা আলিঙ্গনে বেঁধেছেন স্ত্রী সঞ্জনাকে। হার্দিক একা তেরঙা জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘুরছেন মাঠময়। ব্রিজটাউন তখন সত্যিকারের আবেগপুর।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের জয়; ছবি : সংগৃহীত

আর আবেগের কথাটা গলায় তুলে এনে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিকে বিদায় বলে দিলেন বিরাট কোহলি। একই সঙ্গে বিদায় হলো ভারতীয় ক্রিকেটের আরেক মহীরুহের। তিনি রাহুল দ্রাবিড়। ভারতীয় ক্রিকেটের বিশ্বস্ত এই সেবকের ক্যারিয়ার শেষ হয়েছিল বড় এক অপূর্ণতা নিয়ে। কোনো বিশ্বকাপ ট্রফিতে হাত ছোঁয়াতে পারেননি।

ভারতীয়দের চোখেও তো তখন জল আর জল। শ্রাবণধারা। রোহিত কাঁদছেন, হার্দিক কাঁদছেন। সিরাজের চোখে অশ্রু। বুমরার চোখ বাষ্পরুদ্ধ। রোহিত চুমু খাচ্ছেন হার্দিককে।

এই ওয়েস্ট ইন্ডিজেই ২০০৭ সালে ভারত অধিনায়কের টুপি পরে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ট্রফি জিতবেন বলে। গ্রুপ পর্বেই হেরে বড্ড গ্লানিময় ছিল তার এবং ভারতের বিদায়। কোচ হয়ে আরও তিনটি বিশ্বকাপের ফাইনাল থেকে ফিরেছেন খালি হাতে। এবার বিদায় বেলায় সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজই তাকে ভরিয়ে দিলো প্রাপ্তির আলোয়।

১৭ বছর পর ব্রিজটাউনে যেন জোহানেসবার্গ ফিরিয়ে এনে জিতল ভারত। ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে প্রথম টি-২০ বিশ্বকাপের এমন স্নায়ুক্ষয়ী এক ফাইনালই জিতেছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত। এবার রোহিত শর্মার ভারত জিতলো ৭ রানে।

প্রতিপক্ষ, সেই দক্ষিণ আফ্রিকা, যে দেশ থেকে সংক্ষিপ্ততম ক্রিকেটের প্রথম সেরার মুকুট উঠেছিল তাদের মাথায়। আর সেই জয়ের সরণি ধরেই পরে টি-২০ ক্রিকেটের রাজধানী হয়ে উঠেছে ভারত।

দ্বিতীয় ট্রফিটা ভারতের হাতে তাই বেমানান লাগছে না। ভ্রমণ সূচি থেকে শুরু করে ভেন্যু নির্বাচন—সবকিছুতেই ভারতকে সুবিধা দিয়েছে আইসিসি, পুরো ক্রিকেট বিশ্বের এমন সমালোচনার তাপে পুড়তে হয়েছে ভারতকে।

তবে মাঠের সেরা ক্রিকেটে টি-২০ বিশ্বকাপের প্রথম অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েই সব সমালোচনার জবাব দিলো ভারত। আর ২৯ দিনের দীর্ঘ অভিযাত্রা শেষে দক্ষিণ আফ্রিকাও দেখালো তারাও যোগ্য ফাইনালিস্ট।

পবিত্র কুন্ডু ।। ক্রীড়া সাংবাদিক