ছবি : সংগৃহীত

ব্যাংকিং খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঋণ বিতরণ ও আমানত সংগ্রহের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে খেলাপি ঋণের সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকিং খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ শুধু ব্যাংকিং খাত নয়, বরং সামষ্টিক অর্থনীতির জন্যও বিপৎসংকেত।

বাংলাদেশের মুদ্রা ও ঋণ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, এগারো বছরে ব্যাংক ব্যবস্থার অধীনে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ও আমানতের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যা নিচের লেখচিত্রের মাধ্যমে দেখানো হলো—

উৎস : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২৪ [অভ্যন্তরীণ ঋণের উপাত্ত, ফেব্রুয়ারি ২০২৪ এবং আমানতের উপাত্ত, ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত (হিসাব কোটি টাকায়)]।

অভ্যন্তরীণ ঋণের খাতকে তিনভাগে ভাগ করা যায়—সরকারি খাত, রাষ্ট্রায়ত্ত খাত ও বেসরকারি খাত। মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বেসরকারি খাতের ঋণ যার পরিমাণ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১৫,৭৬,৯৩৬.৪০ কোটি টাকা। এই সময়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ছিল ২০,০৪,১০৮.৭০ কোটি টাকা।

অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের ৭৮.৬৯ শতাংশ বেসরকারি খাতের ঋণ এবং বাকি ১৮.৯৪ শতাংশ সরকারি খাতের ঋণ।

অন্যদিকে আমানতের দিকে তাকালে দেখা যায়, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমানতের পরিমাণ বাড়লেও তা বৃদ্ধির পরিমাণ ঋণ বৃদ্ধির পরিমাণের তুলনায় কম।

ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোনো ঋণ বা তার কিস্তি যখন নির্দিষ্ট সময় পর ফেরত পাওয়া যায় না তখন তাকে খেলাপি ঋণ বলে। এক দশকের খেলাপি ঋণের দিকে তাকালে এর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাই লক্ষ্য করা যায়।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিল ৬,৪৯,৪৪০ কোটি টাকা। একই সময়ে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ছিল ৬,৩৭,৯০৬ কোটি টাকা। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে আবার ঋণের পরিমাণও বেড়েছে।

তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ব্যাংকে আমানতের পরিমাণের চেয়ে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ বেশি হতে শুরু করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আমানতের পরিমাণ সাড়ে সতেরো লাখের কাছাকাছি হলেও অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ২০ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এই ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের বড় ভূমিকা থাকতে পারে।

ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোনো ঋণ বা তার কিস্তি যখন নির্দিষ্ট সময় পর ফেরত পাওয়া যায় না তখন তাকে খেলাপি ঋণ বলে। এক দশকের খেলাপি ঋণের দিকে তাকালে এর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাই লক্ষ্য করা যায়।

১১ বছরে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের সঙ্গে খেলাপি ঋণের অনুপাত নিম্নে দেখানো হলো—

বছর ২০১৫ ২০১৬ ২০১৭ ২০১৮ ২০১৯ ২০২০ ২০২১ ২০২২ ২০২৩, জুন
মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের সাথে খেলাপি ঋণের অনুপাত

৮.৮

৯.২

৯.৩

১০.৩ ৯.৩

৭.৭

৭.৯

৮.২

১০.১

উৎস : বাংলাদেশ ব্যাংক

২০১৩ সালে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের সঙ্গে খেলাপি ঋণের অনুপাত ছিল ৮.৯ শতাংশ। তবে এই হিসাবটির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়।

দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতে যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে তার ১০.১০ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। খেলাপি ঋণ কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তেমন কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।

২০২৩ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতে যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে তার ১০.১০ শতাংশই বর্তমানে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।

খেলাপি ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিতে বহুমুখী বিরূপ প্রভাব পড়ে যার মধ্যে তারল্য সংকট, নতুন ঋণ প্রদানের সক্ষমতা কমে যাওয়া, বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়া, কর্মসংস্থান হ্রাস পাওয়া, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে।

ফলস্বরূপ সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী মুদ্রা ও ঋণ নীতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

এই সংস্কারের মধ্যে কিছু আইনগত সংস্কারও অন্তর্ভুক্ত আছে, যেমন খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো, যারা ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি ঋণ গ্রহণ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ থেকে শুরু করে তাদের দায়দায়িত্বের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন ধরনের সংস্কার আনা হয়েছে। কিন্তু কোনোকিছুই কার্যকর হবে না যদি সংস্কারমূলক পদক্ষেপগুলোয় কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা না যায়। একই সাথে সামষ্টিক অর্থনীতিপ্রসূত সমস্যাগুলো দ্রুততার সঙ্গে সমাধানের প্রচেষ্টা নিতে হবে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী সামষ্টিক অর্থনীতির বর্তমান সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে যে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা হয়েছে, তা হলো—ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হারে সৃষ্ট অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ানো, উচ্চ জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং অর্থনীতির উৎপাদনশীল খাতগুলোয় ঋণের জোগান যেন নিশ্চিত থাকে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা।

জুলাই-ডিসেম্বর ২০২৩ সময়কালে সংকোচনশীল মুদ্রানীতির জন্য যেমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, একইভাবে জানুয়ারি-জুন ২০২৪ সময়কালেও সংকোচনশীল মুদ্রা ও ঋণনীতির জন্যও বেশকিছু নীতিগত পদক্ষেপ চলমান আছে।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা রক্ষার চেষ্টা, খেলাপি ঋণ হ্রাস করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা, অধিকতর উৎপাদনমুখী খাতগুলোয় ঋণের জোগান অব্যাহত রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রভৃতি।

ব্যাংকিং খাত পুরো অর্থনীতির প্রাণশক্তি। সুতরাং অর্থনীতিকে সচল রাখতে তথা ক্রমাগতভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্রমবর্ধনশীল ধারাকে অব্যাহত রাখতে এবং উৎপাদনশীল খাতগুলোয় ঋণের প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হলে গৃহীত সব সংস্কারমূলক কার্যক্রমকে যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবে পরিণত করতে হবে।

সোমা ভট্টাচার্য ।। সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়