ছবি : সংগৃহীত

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে দুনিয়াব্যাপী মানুষ উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরও বেশি। কারণ এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে  বাস করে ১১১৬ জন মানুষ। যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না। এই ব্যাপক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি তাই সর্বাগ্রে বিবেচ্য। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, তা ক্রমান্বয়ে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। মুখে চলছে বাগাড়ম্বরতা।

কখনো কখনো বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে বলা হচ্ছে, ‘খাদ্যের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে, কৃষককে বাঁচাতে হবে, উৎপাদন বাড়াতে হবে, তা না হলে বাংলাকে বাঁচানো যাবে না।’ এই বক্তব্যের সাথে বোধহয় কারোর কোনো মতভেদ নেই। বরং এইটাই আপামর জনসাধারণের ঐকান্তিক চাওয়া।

প্রশ্ন হলো, এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা বা উৎপাদন বৃদ্ধি কতদিনের জন্য, কার জন্য? এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা কি সাময়িক সময়ের জন্য, নাকি এর সুদূরপ্রসারী কোনো লক্ষ্য আছে? এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করাটাও আমাদের দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়বে কিনা?

প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, বাংলাকে বাঁচানো, কৃষি বা কৃষককে বাঁচানোর উদ্যোগ-আয়োজনগুলো কোথায়? প্রস্তাবিত বাজেট কি কৃষি বা কৃষকের স্বার্থ রক্ষার কথা বলছে? নাকি একদল মুনাফালোভী ব্যবসায়ীর উদ্দেশ্য চরিতার্থে কাজ করছে?

পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, কৃষিকেন্দ্রিক আমাদের চিন্তা-ভাবনা, উদ্যোগ-আয়োজনসমূহ একেবারেই তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর মতো। তা কোনো গবেষণা বা কৃষি ও কৃষকের টিকে থাকা বা স্থায়িত্ব বিবেচনায় গৃহীত হচ্ছে না। জাতীয় বাজেট তা আরও সুস্পষ্ট করে তোলে। কৃষিতে এখনো ৪০.৬ শতাংশ মানুষের শ্রম নিযুক্ত সেইখানে বাজেটের আকার কত? 

কৃষিকেন্দ্রিক আমাদের চিন্তা-ভাবনা, উদ্যোগ-আয়োজনসমূহ একেবারেই তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর মতো। তা কোনো গবেষণা বা কৃষি ও কৃষকের টিকে থাকা বা স্থায়িত্ব বিবেচনায় গৃহীত হচ্ছে না।

কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমি ও পানি সম্পদ এই পাঁচটি মন্ত্রণালয় মিলে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ৫.৯০ শতাংশ। অথচ এই পাঁচটি খাতই বাংলাদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা তথা টিকে থাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এদের মধ্যে সঙ্গতি স্থাপনই প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের জনগণকে রক্ষা করবে। কিন্তু যে উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি এবং উৎসাহিত করছি তা কোনোভাবেই আমাদের কৃষিকে টিকিয়ে রাখার মৌলিক উপাদান মাটি, পানি ও পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না।

আমরা উৎপাদন বাড়ানোর নামে ক্রমাগত ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারে ধান চাষ করছি, ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। মৎস্য সম্পদের জোগান নিশ্চিত করার নামে মিষ্টি পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি করছি। যা একদিকে ভূগর্ভস্থ পানি নিচে নেমে যাওয়ায় খরা পরিস্থিতি তৈরি করছে, অন্যদিকে লবণের খরা দেখা দিচ্ছে। পানির প্রাপ্যতা কমছে, লবণাক্ততা বাড়ছে, ব্যবহার উপযোগী পানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ছে। মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। মরুভূমির মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে সেচের জন্য বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ রেয়াত রেখেছেন। কিন্তু তা থেকে কে লাভবান হবে? কৃষক না সেচযন্ত্রের মালিক? কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেচযন্ত্রের মালিকানা কৃষকের হাতে থাকে না। এর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা দুটোই প্রভাবশালীদের হাতে। ফলে কৃষক টাকা দিয়েও পানি পায় না, কৃষক প্ররোচিত হয় আত্মহত্যায়।

দ্বিতীয়ত আমরা দেখছি ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে আমরা ক্রমান্বয়ে মরুময় পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছি। তাহলে, ভূ-উপরিস্থ যেসব পানির আধার রয়েছে পুকুর, খাল, বিল, নদী তা রক্ষণাবেক্ষণের পরিকল্পনা কই, বাজেট কই?

বাজেট বরাদ্দের সময় এই বিষয়সমূহ চিন্তায় থাকছে না, চিন্তায় থাকছে না কৃষকের স্বার্থ। সেইখানে কৃষকের স্বার্থের চেয়ে কোম্পানি বা সম্পদের মালিকের স্বার্থ অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। কৃষক যাতে সাশ্রয়ী মূল্যে সার-কীটনাশক পায় তার জন্য ভর্তুকি রাখা হয়েছে। যার পুরোটাই রাসায়নিক সার ও কীটনাশক আমদানিতে ব্যবহৃত হবে। ফলে সার-কীটনাশকে রাখা ভর্তুকির পুরোটাই চলে যাবে কোম্পানি বা ব্যবসায়ীর পকেটে।

অথচ কয়েক বছরে কেঁচো সার আমাদের কৃষিতে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে চলেছে। এছাড়া প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষকের নিজস্ব প্রযুক্তিতে উৎপাদিত আরও বিভিন্ন ধরনের সার, বালাইনাশক রয়েছে। তার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কোনো প্রণোদনা নেই, নেই গবেষণা।

কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য বিশেষ করে ধান, আলু, পেঁয়াজ ওঠার সাথে সাথে বিক্রি করতে বাধ্য হন। কারণ তার উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। ফলনের মাত্র ১২-২২ শতাংশ সংরক্ষণ করার সামর্থ্য আমাদের আছে। সুতরাং রাখার জায়গার অভাবে ফসল মাড়াইয়ের সাথে সাথে তা বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই সুযোগে মিল মালিক কৃষকের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে ধান কিনে নেয় এবং লাভও চলে যায় তার পকেটে। 

এক গবেষণায় দেখা গেছে, কুষ্টিয়া, নওগাঁ, বগুড়া ও দিনাজপুর অঞ্চলের ৫০টির মতো বড় চালকল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মূলত এরাই বাজারের নিয়ন্তা। ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদেরই ঋণ দিয়ে থাকে।

এর বিপরীতে কৃষকের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়িয়ে জেলা বিবেচনায় ধান, পেঁয়াজ, আলুর মতো অর্থকরী ফসল সুরক্ষায় ইউনিয়ন পর্যায়ে কোল্ড স্টোরেজ, কৃষিগোলা স্থাপন বা ক্ষুদ্র, মাঝারি চাতাল মালিক, কোল্ডস্টোরেজের মালিক বা মিল মালিকদের প্রণোদনা দিয়ে সেইখানে কৃষকের ফসল সুরক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু সেইখানে নজর নেই, নেই বাজেট প্রক্ষেপণ।

বাজেট বরাদ্দের সময় এই বিষয়সমূহ চিন্তায় থাকছে না, চিন্তায় থাকছে না কৃষকের স্বার্থ। সেইখানে কৃষকের স্বার্থের চেয়ে কোম্পানি বা সম্পদের মালিকের স্বার্থ অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে।

ফলে হাতেগোনা ওই ৫০টির মতো প্রতিষ্ঠানের লুটপাটে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না, কৃষক বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত মূল্য থেকে। সেইখানে লাভজনক মূল্য তো অনেক দূরে। তাহলে কীভাবে সম্ভব বাংলার কৃষি এবং কৃষককে নিজের পায়ে দাঁড় করানো?

এখনো নদী-খাল, বিলসহ জলাশয়গুলোর দখল-দূষণ অব্যাহত রয়েছে। তার সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণের নাম নেই। প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হচ্ছে আমাদের কৃষি। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে উপকূলবর্তী ২০ জেলার ৬২টি উপজেলার ৪১৯টি ইউনিয়ন। প্রায় ৯৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

বলা হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে প্রায় ২১৭ কোটি ২৯ লাখ টাকার মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৮ হাজার ২০৯ হেক্টর ফসলি জমির ফসল।

সম্প্রতি ভারতের মেঘালয়, চেরাপুঞ্জের বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়েছে সিলেট-সুনামগঞ্জ এলাকা। পানি বের হতে পারছে না। কৃষক এই বছর বন্যার আগে ফসল ঘরে তুললেও ঘরের ভেতর পানি ঢুকে কৃষকের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, জুলাইয়ের শুরুতে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বন্যা হতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষক যে বারবার ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে তা থেকে রক্ষায় বাজেটে কী রাখা হলো?

কী রাখা হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের করাল থাবা থেকে বারংবার রক্ষাকারী প্রাকৃতিক দুর্গ সুন্দরবনের জন্য। সুন্দরবন বারবার বুক দিয়ে আমাদের জানমাল এবং কৃষিকে আগলে রাখছে। সম্প্রতি সেইখানে অগিকাণ্ড এবং ঘূর্ণিঝড় রিমালে যে ক্ষতি হয়েছে তা পোষাতে এবং তার সুরক্ষায় পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাজেটে কি বরাদ্দ রাখা হলো?

এই সবকিছুর মধ্যে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, তাহলো বাজেট তাহলে কার জন্যে, কীসের জন্যে? এখানে আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্থানীয় বীজ, কৃষকের জ্ঞান, ফসলের ন্যায্য মূল্য, ফসল সংরক্ষণ, বৈরি আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়ানোর বিষয়গুলো কোথায়?

তা নিশ্চিতকরণে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে না পারলে বাজেট নামক টাকা পয়সার হিসাব-নিকেশ করে কোনো লাভ হবে কি? কারণ বাজেটের সাথে যুক্ত থাকে দৃষ্টিভঙ্গি, যুক্ত থাকে স্থায়ী হওয়া তথা প্রজন্মের ভবিষ্যৎ।   

অমিত রঞ্জন দে ।। সংস্কৃতিকর্মী ও সাধারণ সম্পাদক, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ