আয়নায় যখন নিজেদের মুখ দেখি, তখন ভেসে ওঠে ভিন্ন ছবি! সেই ছবি উজ্জ্বল নয়, নয় দৃষ্টিনন্দন। এই ছবি অনেকটা নির্লিপ্ত, অসম্পূর্ণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কলুষিত, কুৎসিত। আমরা সর্বদাই গণতন্ত্রের কথায় উচ্চকণ্ঠ হই, স্বাধীনতার প্রশ্নে হ্যাঁ বলি, কিন্তু সংবাদপত্র কিংবা বাস্তবে সম্প্রচার মাধ্যমকে মর্যাদা দেই না কখনই। আমরা গণ অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হই, কিন্তু গণ অধিকারের রক্ষাকবচ যে গণমাধ্যম তথা সংবাদমাধ্যম, তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে কুণ্ঠাবোধ করি।

সাংবাদিকদের যথার্থ মর্যাদা দেওয়ার পাঠ এখনো আমরা গ্রহণ করিনি; এমনকি করার ইচ্ছাও নেই। অগণতান্ত্রিক পর্যায় থেকে গণতন্ত্রের উত্তরণে অবাধ তথ্যপ্রবাহের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হই বরাবরই। নিজেদের সঙ্কীর্ণতাকে ঢেকে রাখতে ভালোবাসি বলেই যারা সত্য প্রকাশে উদ্যোগী, তাদের নাস্তানাবুদ করতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করি না, প্রকাশ্যে বদমাইশ, লম্পট বলে গালি দিতে ইতস্তত হই না।

আমরা সত্যানুসন্ধানরত সাংবাদিকদের ভালোবাসতে না-ই পারলাম, কিন্তু তাদের জীবনকে ক্ষত-বিক্ষত করার ক্ষেত্রে আমাদের জুড়ি নেই। এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। তা না হলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, গণতন্ত্র বলে আর কিছুই থাকবে না।

শুরুতেই প্রশ্ন আসে, আমাদের গণমাধ্যম কি স্বাধীন? আগে কখনো ছিল না, এখনো নেই। সাংবাদিকতার ইতিহাস সেই ইংরেজ আমল থেকে অদ্যাবধি সংবাদপত্র কখনই স্বাধীনতার সূর্য দেখেনি। বরাবরই আমরা সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমে হতাশার চিত্র লক্ষ্য করছি। সব সরকারই গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করতে চায়, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারও এর বাইরে নয়।

আমরা গণ অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হই, কিন্তু গণ অধিকারের রক্ষাকবচ যে গণমাধ্যম তথা সংবাদমাধ্যম, তার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে কুণ্ঠাবোধ করি।

নীতিমালার নামে মানুষের বাকস্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ যেমন নিন্দনীয়, ঠিক তেমনি স্বাধীনতার নামে সম্প্রচার মাধ্যম এবং পত্রপত্রিকাগুলোর সেটা অপব্যবহার করে সমাজে টেনশন এবং গোলযোগ সৃষ্টিও কাম্য নয়। সম্প্রচার মাধ্যম তথা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ গণতন্ত্র হরণেরই নামান্তর। তা করা মোটেও সুখকর নয়।

বিশ্বে কোনো দেশে কোনো সময় তা সুফল বয়ে আনেনি। নীতিমালার বিরুদ্ধে আমি নই। সবকিছুর জন্য নীতিমালা দরকার। সমস্যাটা হলো অপব্যবহারের। আর আমাদের দেশে এ সমস্যাটা প্রকট। আমরা সময় সুযোগ পেলেই যে কোনো কিছুর অপব্যবহার করি।

নীতিমালা বাকস্বাধীনতার সৌন্দর্য রক্ষায় প্রণীত হবে, সেই নীতিমালা যদি ‘নিয়ন্ত্রণের’ রূপ নিয়ে সেই আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতাকেই টুঁটি চেপে ধরে, সেটা ঠেকাব কী করে? জনগণের পক্ষে সরকার ও বিরোধীদলের কার্যক্রম নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা উপস্থাপনের জন্য সম্প্রচার মাধ্যমই হচ্ছে গণতন্ত্রের বিকল্প। নীতিমালার নামে গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের যেকোনো প্রয়াসে বাংলাদেশের গণতন্ত্র সারাবিশ্বে নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে পারে।

এদেশে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রয়েছে। সাংবাদিকদের একই ধরনের অধ্যায় রয়েছে স্বাধীন গণমাধ্যম ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের সংগ্রামের। এদেশে দু’টি সংগ্রামের কোনোটিই পূর্ণ সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হতে পারেনি।

গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রত্যাশিত। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও আমাদের সংবাদগুলো সে স্বাধীনতা কখনোই পায়নি। বারবারই বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সুধী সমাজের কাছে। ক্ষমতাসীন সরকারের সময়ও তাই হচ্ছে। ‘সম্প্রচার নীতিমালা’ আইসসিটি আইনের অপপ্রয়োগ তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

প্রকৃতপক্ষে সব সরকারই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। জাতীয় পার্টি ও এরশাদ সরকার, বিএনপি সরকার সেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে যে শুরু করেছে আজও শেষ হয়নি। তবে পুরোপুরি কোনো সরকারই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তা হয় কেবল সাময়িক।

একটা বিষয় বরাবরই আমরা দেখে আসছি আধুনিক বিশ্বে মোটামুটি সব দেশেই সরকার এবং তার দোসর বাহিনী গণমাধ্যমের ওপর চড়াও হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক শক্তি বলে পরিচিত সরকারগুলো যখন ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায়, তখন গণমাধ্যমের দুর্দিন নেমে আসে। আর বলতে গেলে আমাদের দেশে সংবাদপত্র প্রকাশের পূর্বেই নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়।

জনগণের পক্ষে সরকার ও বিরোধীদলের কার্যক্রম নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা উপস্থাপনের জন্য সম্প্রচার মাধ্যমই হচ্ছে গণতন্ত্রের বিকল্প।

সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য প্রকাশক ও মুদ্রণকারীকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ঘোষণা দিতে হয়। নিয়মিত বা সাময়িক সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য আগে অনুমতি নিতে হয়। এটি সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশে কতখানি আনুকূল্য তৈরি করতে পারে তা সহজেই বোধগম্য।

সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষ নিজেও কখনো সাংবাদিক, কলামিস্ট, লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের উপর মনস্তাত্ত্বিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। মুক্তচিন্তা ও প্রকাশের ক্ষেত্রে ভিন্ন পরিবেশ তৈরি করতে পারে। সম্প্রতি সৃজনশীল লেখকদের দৈনিক সংবাদপত্রে মুক্ত হাতে কলাম লিখতে দেখা যাচ্ছে।

চিন্তা-জগতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পাশাপাশি কলাম লেখক হিসেবে তাদের ভূমিকা যদি মুখ্য হয়ে ওঠে, সংবাদপত্রের আদর্শ, দর্শন ও চিন্তা যদি তাদের ওপর অযাচিত প্রভাব বিস্তার করতে উদ্যোগ নেয়, তাহলে একদিকে সৃজনশীল সাহিত্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে, অন্যদিকে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিসর সীমিত হয়ে উঠবে।

একজন সাধারণ পাঠক সংবাদপত্রের মাধ্যমে সত্য ঘটনা জানতে চায়। সংবাদপত্রের দায়িত্ব সেই সত্য তুলে ধরা। বর্তমান সরকার এই সত্য প্রকাশে সবচেয়ে বড় বাধা। সংবাদপত্রের মূল কাজ হলো সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে কাজ করা। সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ মানে জনগণের কল্যাণ।

জনগণের কল্যাণকে সংবাদপত্রগুলোর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় সংবাদপত্রের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে লক্ষ্যে এদেশে পত্রিকাগুলো আসলে সংগ্রাম করে টিকে আছে। সবসময়ই যেটা লক্ষ্য করা যায় সরকারবিরোধী পত্রপত্রিকাগুলোকে সবচেয়ে বেশি সংগ্রাম করতে হয়।

১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর এদেশের গণমাধ্যম এক নতুন চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠতে শুরু করে। তখন থেকেই বহু নিয়ন্ত্রণমূলক আইন-কানুন বাতিল করা শুরু হয়। এ কথা সত্য যে, ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখলেও ব্যক্তি মালিকানায় নতুন চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ তৈরি করে দেয়।

বর্তমান সময়ে বেতার এবং টেলিভিশনের জন্য এ সুযোগ আরও বিস্তৃত। এসব গণমাধ্যম যেন মুক্ত সংবাদ চর্চা করতে পারে সে ব্যাপারে সরকার সচেষ্ট হবেন এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।

মীর আব্দুল আলীম ।। সাংবাদিক ও কলামিস্ট