ছবি : সংগৃহীত

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর (২১-২২ জুন ২০২৪) বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত একটি ঘটনা। নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনের পর এটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় সফর।

পাশাপাশি, আগামী জুলাই মাসে শেখ হাসিনা চীন সফরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, যেখানে চীন তিস্তা প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই প্রসঙ্গগুলো মিলিয়ে এই সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে, শেখ হাসিনার ভারত সফর দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।

দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়, যার মধ্যে ছিল ভারতীয় ভিসা সহজীকরণ, তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন এবং বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর। সফরে সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে যা দুই দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করবে। এগুলো হলো—

বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সমুদ্র অর্থনীতি ও সমুদ্র সহযোগিতা: এই সমঝোতা স্মারকটি সমুদ্র অর্থনীতি ও সমুদ্র সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে দুই দেশের সমুদ্র অর্থনৈতিক কার্যক্রমের উন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

ডিজিটাল পার্টনারশিপের দুটি পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি: এই সমঝোতা স্মারকগুলো ডিজিটাল ইকোসিস্টেম ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দুই দেশের মধ্যে পার্টনারশিপ বৃদ্ধির লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে।

টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ভারত-বাংলাদেশ সবুজ অংশীদারত্বের অভিন্ন ভিশন: এই সমঝোতা স্মারকটি পরিবেশ সুরক্ষা ও সবুজ প্রযুক্তির উন্নয়নে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি বহন করছে।

দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলোয় বিনিয়োগ ও সহযোগিতা বাড়ানো উচিত। বিশেষত, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত।

রেল সংযোগের ক্ষেত্রে একটি সমঝোতা স্মারক: দুই দেশের মধ্যে রেল সংযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই স্মারকটি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এটি যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে সুবিধা বৃদ্ধি করবে।

যৌথ ক্ষুদ্র উপগ্রহ প্রকল্পে সহযোগিতা: এই সমঝোতা স্মারকটি ভারতের জাতীয় মহাকাশ প্রচার ও অনুমোদন কেন্দ্র (ইন-স্পেস) এবং বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছে।

সামরিক শিক্ষাসংক্রান্ত সহযোগিতা: ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজ (ডিএসসিসি), ওয়েলিংটন ও ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ (ডিএসসিএসসি) মিরপুরের মধ্যে কৌশলগত ও অপারেশনাল স্টাডিজের ক্ষেত্রে সামরিক শিক্ষাসংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য এই সমঝোতা স্মারকটি স্বাক্ষরিত হয়েছে।

নবায়নকৃত সমঝোতা স্মারক: মৎস্য সহযোগিতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং স্বাস্থ্য ও ওষুধের সহযোগিতার ক্ষেত্রবিষয়ক সমঝোতা স্মারক নবায়ন করা হয়েছে।

এই সফরে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকগুলো দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামরিক ও পরিবেশগত ক্ষেত্রে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করবে। তবে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রত্যাশা অনুযায়ী অগ্রগতি হয়নি।

ভারতীয় ভিসা সহজীকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল। যদিও মেডিকেল ই-ভিসা চালু করা হয়েছে, কিন্তু সাধারণ ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশের বহু নাগরিক চিকিৎসা, শিক্ষা ও ব্যবসার জন্য ভারতে যাতায়াত করেন। এই প্রক্রিয়াটি সহজ করা হলে দুই দেশের মধ্যে মানুষের চলাচল ও বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পেত।

তিস্তা নদীর পানি বণ্টন একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ইস্যু। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বহুদিন ধরে চলা এই সমস্যা সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু অমীমাংসিত রয়ে গেল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যদিও অনেক প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এখনো অগ্রগতি দরকার।

ভারতের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের সমস্যা এখনো সমাধান হয়নি, যা দুই দেশের মধ্যে একটি বড় সমস্যা। যদিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উচ্চ পর্যায়ের টেকনিক্যাল টিম পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছেন, তবে এই ইস্যুতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য আরও সময় প্রয়োজন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও উন্নত করার জন্য কিছু সুপারিশ করা যেতে পারে—

ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ: দুই দেশের মধ্যে ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। এটি শুধু সাধারণ নাগরিকদের জন্যই নয়, বাণিজ্যিক ও চিকিৎসা সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ।

তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি: তিস্তাসহ সব অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের সমস্যা সমাধানে একটি কার্যকর ও টেকসই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া উচিত। এটি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও মজবুত করবে।

বাণিজ্যিক সহযোগিতা বৃদ্ধি: দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলোয় বিনিয়োগ ও সহযোগিতা বাড়ানো উচিত। বিশেষত, অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো উচিত।

পরিবেশ সুরক্ষা ও সবুজ অংশীদারত্ব: পরিবেশ সুরক্ষা ও পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও বাড়ানো উচিত।

সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা: সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করে দুই দেশের নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নতি আনা উচিত।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যদিও অনেক প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে, তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এখনো অগ্রগতি দরকার। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে এই সফর একটি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে এবং ভবিষ্যতে আরও সহযোগিতা ও সমঝোতার আশা জাগিয়েছে।

সাতটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। তবে, ভিসা প্রক্রিয়া সহজীকরণ, তিস্তা নদীর পানি বণ্টন, বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা কমানো, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন (NRC)সহ নিরাপত্তাজনিত সমস্যাগুলো সমাধানে আরও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। ভবিষ্যতে এই বিষয়গুলোতে আরও মনোযোগ দেওয়া হলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও মজবুত হবে।

অধ্যাপক ড. সুজিত কুমার দত্ত ।। সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
datta.ir@cu.ac.bd