Russell's Viper রাসেলস ভাইপার : আতঙ্ক, গুজব ও বাস্তবতা
ছাগলকাণ্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাসেলস ভাইপার তার অবস্থান শক্ত করে ধরে রেখেছে বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়ায়। সম্প্রতি বাংলাদেশে পদ্মাসহ বিভিন্ন নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলোয় রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপের উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে সোশ্যাল মিডিয়া এবং গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। ফেসবুকে বিষয়টি নিয়ে অনেকে নানাভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করছেন যে সাপটি কামড় দিলে অতিদ্রুত মানুষের মৃত্যু হয়।
ঈদের ছুটিতে গিয়েছিলাম পদ্মা তীরবর্তী অঞ্চল দোহারে। পদ্মা অববাহিকার বিভিন্ন চরাঞ্চল ও এলাকা জুড়ে রাসেলস ভাইপারের চরম আতঙ্কে রয়েছে মানুষ। সবার মুখে মুখে একই আলোচনা রাসেলস ভাইপার। প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক হওয়ার কারণে অনেকেই আমার কাছে বিষয়টি জানতে চেয়েছেন। সবাইকে আমি জিজ্ঞেস করেছি আপনারা সাপটিকে স্বচক্ষে দেখেছেন কি না। সকলেরই উত্তর তারা নিজে এর আক্রমণের শিকার হননি, তবে অনেকেই হয়েছে বা সাপটি দেখেছেন বলে তারা শুনেছেন।
বিজ্ঞাপন
বিভিন্ন এলাকায় লোকজন যেকোনো সাপ মেরে রাসেলস ভাইপার বলে বাহাবা কুড়ানোর জন্য পোস্ট করছেন ফেসবুকে। এরই মধ্যে ফরিদপুরের একজন রাজনীতিবিদ প্রতিটি রাসেলস ভাইপার সাপ মারার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। এই সাপটি নিয়ে যে যেভাবে পারছেন তথ্য এবং গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছেন। সাপ নিয়ে যারা গবেষণা করেন এমন ব্যক্তি ও সংগঠন ইতিমধ্যে বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন কিন্তু সেই পোস্টগুলো খুব বেশি শেয়ার বা ভাইরাল হচ্ছে না।
আরও পড়ুন
ফেসবুকে প্রচার করা বেশিরভাগ পোস্টে দেখা যায়, সাপের প্রায় একই ছবি বা ভিডিও। ২১ জুন সকাল থেকে কয়েকটি ফেসবুক আইডি ও পেজে প্রচারিত হয় যে, ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে রাসেল ভাইপারের আগমন ঘটেছে। এই পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ফেনী জেলার বিভিন্ন স্থানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
খবর নিয়ে জানা যায়, শরীয়তপুর জেলায় রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রবের একটি ভিডিও সোনাপুরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সোনাপুর গ্রামে রাসেলস ভাইপার সাপ দেখা যাওয়ার তথ্যটি সঠিক নয় বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন বুঝে বা না বুঝে কিছু ব্যক্তি অন্য জায়গার ঘটনা ফেনীর বলে চালিয়ে দিয়েছেন।
রাসেলস ভাইপার আতঙ্কের কারণে বিভিন্ন জায়গায় অনেকেই অন্যান্য বিষধর কিংবা নির্বিষ সাপের সাথে রাসেলস ভাইপারকে মিলিয়ে ফেলছেন। অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে যেকোনো সাপ মেরে তার ছবি তুলে বা ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করছেন। সাপ খাদ্যশৃংখলের অন্যতম একটি প্রাণী এভাবে সাপের পরিচয় না জেনে নির্বিচারে নির্বিষ এবং বিষধর সাপ মারার ফলে তা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
নির্বিষ সাপকে বিষধর সাপের সাথে মিলিয়ে ফেললে বা বিষধর সাপকে নির্বিষ সাপ ভেবে ভুল করলে মানুষ এবং সাপ, সকলেরই জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বাংলাদেশে বর্ষাকালে প্রায় প্রতি বছরই সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। ভাটি অঞ্চলের নিচু দেশ হওয়ার কারণে বর্ষায় বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয় এবং সাপের আবাসভূমিতে পানি ঢুকে যায়। সব ধরনের সাপই বর্ষাকালে বিভিন্ন উঁচু এলাকা এবং ঘরবাড়ির কাছাকাছি আশ্রয় নেয়। আর এই সময়ে লোকজন না দেখে, না বুঝে সাপের সংস্পর্শে আসে আর তখনই মানুষ আক্রান্ত হয়।
শুধুমাত্র রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া নয়, বাংলাদেশে প্রায় ৯৪ প্রজাতির সাপ আছে এবং এই সাপের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সাপ নির্বিষ। বাংলাদেশের প্রাপ্ত বিষধর সাপসমূহ মূলত এলাপিডি (Elapidae) পরিবারভুক্ত। এছাড়া কিছু ভাইপারিডি (Viperidae) এবং সামুদ্রিক হাইড্রোফিডি পরিবারভুক্ত সাপও দেখা যায়।
Russell's Viper : রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ
রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া বা উলুবোড়া (বৈজ্ঞানিক নাম: Daboia russelii) ভাইপারিডি পরিবারভুক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বিষধর সাপ এবং উপমহাদেশের প্রধান চারটি বিষধর সাপের একটি। প্যাট্রিক রাসেল ১৭৯৬ সালে তার ‘অ্যান অ্যাকাউন্ট অফ ইন্ডিয়ান সারপেন্টস, কালেক্টেড অন দ্য কোস্ট অফ করোমান্ডেল’ বইয়ে চন্দ্রবোড়া সম্পর্কে লিখেছিলেন ও তার নাম অনুসারে এটি রাসেল ভাইপার নামে পরিচিত হয়।
আরও পড়ুন
রাসেলস ভাইপার-এর দেহ মোটাসোটা, লেজ ছোট ও সরু। প্রাপ্তবয়স্ক সাপের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৪৭-৬৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। তবে পাহাড়ি এবং দ্বীপ অঞ্চলে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। এদের মাথা ত্রিকোণাকৃতি বা অনেকটা ইংরেজি বর্ণমালা ‘V’ এর মতো দেখতে, এদের মাথা ঘাড় থেকেও চওড়া হয়, এদের নাসারন্ধ্র ছোট এবং চোখের মণি খাড়া হয়।
এই সাপকে অন্যান্য সাপ থেকে আলাদা করে চেনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এদের ফ্যাকাসে কমলা বাদামি রঙের পিঠের উপর লালচে বাদামি রঙের ডিম্বাকৃতি বা চাকতির মতো কালো বর্ণের সীমানাযুক্ত বড় বড় বৃত্ত, যা মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত তিনটি সারিতে শেকলের মতো চলে গেছে। এই সাপের শরীরে চাকতির মতো কালো রঙের সীমানাযুক্ত বৃত্তগুলো কিছুটা চাঁদের মতো দেখতে হওয়ায় বাংলায় এই সাপকে চন্দ্রবোড়া বলা হয়।
রাসেলস ভাইপার সাপের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এরা অন্য সাপের মতো ডিম দেয় না। সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে থাকে। সদ্য প্রসূত বাচ্চা ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।
রাসেলস ভাইপার ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালে পাওয়া যায়। এটি পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জেলায়, বিশেষ করে নদীয়া, বর্ধমান, উত্তর চব্বিশ পরগনা ও বাঁকুড়া জেলার গ্রাম অঞ্চলে ভয়ের অন্যতম কারণ। আগে শুধুমাত্র বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে এই সাপ দেখা যেত। যে কারণে এটি বরেন্দ্র অঞ্চলের সাপ বলেই পরিচিত ছিল।
অনেকে ধারণা করেন, বর্ষা বা বন্যায় কিংবা গঙ্গা, পদ্মা নদীর পানিতে ভেসে ভারত থেকে এসব সাপ বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ইতিপূর্বে চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে একটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হলেও বর্তমান সময়ে দেশের ঠিক কতগুলো জেলায় এদের অস্তিত্ব রয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর পাবনা, শরীয়তপুর, মুন্সিগঞ্জ, মাদারীপুর, বাজিতপুর থেকে শুরু করে ঢাকার পার্শ্ববর্তী দোহার, নবাবগঞ্জ ও সাভারেও চন্দ্রবোড়ার দংশনের ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রায়শই নতুন জায়গা থেকে এদের আগমনের সংবাদ পাওয়া যায়।
Russell's Viper : রাসেলস ভাইপার-এর বৈশিষ্ট্য
রাসেলস ভাইপার সাপের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এরা অন্য সাপের মতো ডিম দেয় না। সরাসরি বাচ্চা প্রসব করে থাকে। সদ্য প্রসূত বাচ্চা ৮ থেকে ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। বাচ্চা প্রদানের ক্ষেত্রেও চন্দ্রবোড়া ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এই সাপটি বছরের যেকোনো সময় প্রজনন করে। তবে মে-আগস্ট মাসে প্রজনন সবচেয়ে বেশি ঘটে। একটি স্ত্রী সাপ গর্ভধারণ শেষে ২০-৪০টি বাচ্চা দেয়। তবে কোনো কোনো রাসেলস ভাইপার সাপের ৮০টি পর্যন্ত বাচ্চা দেওয়ার প্রমাণ আছে।
১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত প্রথিতযশা জীববিজ্ঞানী এবং সর্প বিশেষজ্ঞ ড. মো. আলী রেজা খানের ‘বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী’ বইয়ে দেশের বেশ কিছু স্থানে চন্দ্রবোড়া সাপের অস্তিত্বের কথা লেখা হয়েছে। সেইখানে তিনি লিখেছেন, উত্তরবঙ্গে দেশের অন্য এলাকা থেকে বেশি পাওয়া যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে বেশ কয়েকটা চন্দ্রবোড়া ধরা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। দক্ষিণবঙ্গের কুষ্টিয়া, যশোর এবং খুলনাতেও বেশ পাওয়া যায়। কেবল ঢাকা বিভাগের যমুনার পূর্বদিকে এদের সন্ধান তিনি পেয়েছিলেন বলে লিখেছেন।
একসময় সুন্দরবনের কিছু অংশ, মধুপুরের শালবন এবং দেশের অন্যান্য কিছু স্থানে এদের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দেশের প্রকৃতি থেকে চন্দ্রবোড়া আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে শুরু করে। দীর্ঘ বিরতির পর ২০০৯ সালে দেশের প্রকৃতিতে আবার এদের দেখা মেলে। চন্দ্রবোড়া ভারত ও বাংলাদেশে মহাবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় রয়েছে। আইইউসিএনের ২০১৫ সালের লাল তালিকা অনুযায়ী চন্দ্রবোড়া বাংলাদেশে সংকটাপন্ন প্রাণী।
আরও পড়ুন
এখন অনেকের মনে প্রশ্ন, হারিয়ে যাওয়া চন্দ্রবোড়া কী করে আবার সাড়ম্বরে ফিরে এলো প্রকৃতির কোলে? দেশের প্রকৃতি এখন যেখানে অনেকটাই বন্যপ্রাণী এবং সাপশূন্য। বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতিতে এদের অবদান সম্পর্কে সম্মুখ জ্ঞান না থাকায় যুগের পর যুগ মানুষ বন্যপ্রাণীদের নিছক উৎপীড়ন মনে করেছে। যেকোনো বন্যপ্রাণী দেখার সঙ্গে সঙ্গে শত শত মানুষ জড়ো হয়ে তাকে পিটিয়ে মেরেছে। এমন পরিবেশ পরিস্থিতিতে এক বিশেষ সাপের উত্থান কীভাবে হলো? অতীতের চন্দ্রবোড়া আসলে কখনোই হারিয়ে যায়নি। কমবেশি সবসময় ছিল। অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় আবার ওরা স্বাভাবিক সংখ্যায় ফিরে আসছে।
কৃষিজমিগুলোয় এখন সারা বছরই বিভিন্ন উন্নত জাতের ফসলের চাষাবাদ হয়। ফসলের ক্ষেতই প্রধানত ইঁদুরের খাবার সংগ্রহের জায়গা। অনেকে ধারণা করে থাকেন, ইরি ধান চাষ ও ইঁদুর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রবোড়া সাপের বৃদ্ধির একটি সম্পর্ক রয়েছে। খাদ্য এবং আবাসস্থলের সুবিধা এবং প্রকৃতি থেকে শিকারি প্রাণী কমে যাওয়ায় এদের বংশবৃদ্ধিকে সহজ করে দেয়।
...বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় কামড় দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায় সাপ। আক্রান্ত ব্যক্তি সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে না সাপটির প্রজাতি। সব সাপ ওত পেতে থাকে শিকার ধরার জন্য। তেড়ে এসে আক্রমণ করা সাপের বৈশিষ্ট্য নয়। ভাইপাররা আরও অলস।
খেঁকশিয়াল, বনবিড়াল, দাঁড়াশ, গোখরাসহ দিবাচর এবং নিশাচর কিছু শিকারি পাখি মেঠো ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতো। মানুষের নির্মমতায় প্রকৃতির থেকে ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছে ওরা। ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে ইঁদুরের সংখ্যা। পর্যাপ্ত খাদ্য থাকায় স্বাভাবিকভাবেই চন্দ্রবোড়ার প্রজনন ও বৃদ্ধি সহজ হয়েছে।
আগেই বলেছি, সাধারণ সাপের তুলনায় এরা বেশি বাচ্চা দিয়ে থাকে। আগে বাচ্চাগুলোর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতো প্রকৃতিতে থাকা বিভিন্ন শিকারি প্রাণী। বেজি, গুইসাপ, তিলা নাগ, ঈগল, কালকেউটে, শঙ্খিনী আর হুতুম প্যাঁচার প্রিয় খাদ্য ছিল চন্দ্রবোড়ার বাচ্চা। কিন্তু শিকারি প্রাণীদের জীবন আজ বড়ই বিপন্ন। এই কারণে হয়তো এখন চন্দ্রবোড়ার প্রায় প্রতিটি বাচ্চা অনেকটা নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠছে এবং দিন দিন বাড়ছে ওদের সংখ্যা। বর্তমানে দেশের প্রকৃতির খাদ্যশৃঙ্খল একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এই কারণেও চন্দ্রবোড়ার উত্থান ঘটতে পারে। কারণ খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়লে হঠাৎ যেকোনো প্রাণীর উত্থান হতে পারে।
পৃথিবীর সব সাপই মানুষ বা যেকোনো শত্রু দেখলে এড়িয়ে যাওয়ার বা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তার জন্য কেউ ভয়ের বা বিরক্তির কারণ না হলে কোনো সাপই আক্রমণ করবে না। অনেকেই অসতর্কতাবশত কাজ করতে গিয়ে লুকিয়ে থাকা সাপের আক্রমণের শিকার হতে পারেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় কামড় দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায় সাপ। আক্রান্ত ব্যক্তি সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে না সাপটির প্রজাতি। সব সাপ ওত পেতে থাকে শিকার ধরার জন্য। তেড়ে এসে আক্রমণ করা সাপের বৈশিষ্ট্য নয়। ভাইপাররা আরও অলস। শিকারের আশায় ঘাসের মধ্যে কুণ্ডলি পাকিয়ে লুকিয়ে অলসভাবে পড়ে থাকে। তারপরেও খেতে খামারে বা বিভিন্ন জায়গায় অনেকেই অসতর্কতাবশত কামড় খেয়ে ফেলতে পারেন।
চিকিৎসা
সময়মতো অ্যান্টিভেনম (Antivenom) দিলে বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ। ওঝার কাছে গিয়ে, সাপ মারতে গিয়ে বা হাসপাতালে না নিয়ে সময় নষ্ট করলে বিষে জটিলতা দেখা দেয়। টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ (Toxicology Society of Bangladesh)-এর তথ্য অনুযায়ী, সাপের দংশনের পরে দ্রুত অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করলে অ্যান্টিবডিগুলো বিষকে নিষ্ক্রিয় করে। যার ফলে আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন বেঁচে যায়। গোখরা সাপের দংশনের গড় ৮ ঘণ্টা পর, কেউটে সাপের দংশনের গড় ১৮ ঘণ্টা পর ও চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপের দংশনের গড় ৭২ ঘণ্টা বা তিনদিন পর রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
আরও পড়ুন
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সময়সীমার মধ্যে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা অত্যন্ত জরুরি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগী অ্যান্টিভেনম নিয়েও মারা যায়। হেমোটক্সিন বিষ রক্তের মাধ্যমে এমন সব অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত করে যা সারানো অ্যান্টিভেনমের কাজ নয়। রাসেলস ভাইপারের কামড়ে অ্যান্টিভেনম নেওয়ার পর এইসব অঙ্গের জন্য অতিরিক্ত চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন পড়ে।
পলিভ্যালেন্ট অ্যান্টিভেনম (Polyvalent Antivenom) দিয়ে দেশের সব সাপের কামড়ের চিকিৎসা করা হয়। তবে শুধু রাসেলস ভাইপার সাপের জন্য অতিরিক্ত চিকিৎসা করাতে হয় না হয় অ্যান্টিভেনম দিয়ে বিষ নষ্ট হলেও অঙ্গ নষ্ট হয়ে রোগী মারা যায়। তাই মনে হতে পারে অ্যান্টিভেনম বুঝি কাজ করে না।
সাপের আতঙ্ক
সাপের আতঙ্কে নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের খেটে খাওয়া অনেক মানুষ কাজে যাচ্ছে না। সাপ আতঙ্ক কৃষিশ্রমিকদের দাম বেড়ে যাচ্ছে এবং কৃষি নির্ভর পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই আতঙ্ক না ছড়িয়ে সঠিক তথ্য দিন। বর্ষার সময়ে যেকোনো এলাকাতেই সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। যাদের বাড়ি-ঘর এর আশেপাশে পানি বেশি বা কৃষক শ্রমিক যারা ক্ষেত খামার বা ঝোপ ঝাড় এলাকায় কাজ করেন তাদের সতর্কতার সাথে কাজ করা উচিত।
বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই বন্যপ্রাণীদের নিছক শত্রু বা উপদ্রব মনে করে আসছে। কোথাও ঠান্ডা মাথায়, কোথাও দলবেঁধে মহা উল্লাসে বন্য প্রাণী হত্যা করে তা ফলাও করে প্রচার করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে এই অবস্থা চলার ফলে প্রকৃতি এখন প্রায় বন্যপ্রাণী শূন্য।
প্রয়োজন জনসচেতনতা সৃষ্টি
এই সময়ে সবচেয়ে জরুরি কাজ চন্দ্রবোড়া সাপ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। শুধুমাত্র রাসেলস ভাইপার নয় যেকোনো সাপের কামড়ে আর কোনো মানুষের যেন মৃত্যু না হয় এবং আর কোনো সাপ যেন নিহত না হয় মানুষের আক্রমণে। নদী তীরবর্তী উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয় অ্যান্টিভেনমের মজুদ থাকা প্রয়োজন। যাতে যেকোনো সাপের দংশন করা রোগী আসলে খুব দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া যায়।
মানুষ এবং সাপের সহাবস্থান কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সেই বিষয়ে কাজ করা জরুরি। সৃষ্টিকর্তা প্রতিটি প্রাণীকে সৃষ্টি করেছেন মানুষের কল্যাণে। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার তাদের রয়েছে। আর এজন্য বন বিভাগ, বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ, সাপ উদ্ধার কর্মীসহ সব সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। পৃথিবীটা সবার; মানুষ বাঁচুক, অন্য প্রাণীরাও বেঁচে থাক।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com