ছবি : সংগৃহীত

২৩ জুন ১৯৪৯ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বর্তমান আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তন হয়। আজ বৃহৎ এই রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দলটি যখন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে, তখন কতটা পেছনে ফিরে তাকাবে? ২০০৮ সাল থেকে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে থাকা, ‘ক্ষমতাসীন’ শব্দটি কি নেতিবাচক নয়?

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জয়ের পরপরই সুধা সদনে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, এখনো কানে বাজে তার উচ্চারণ, ‘আমরা শাসক নয় সেবক হতে চাই’।

এমন এক সময় এই উপমহাদেশের পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যতম আওয়ামী লীগ তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে যখন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। ৯ জুন ২০২৪ দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেন শেখ হাসিনা। যখন তিনি প্রবেশ করছিলেন অনুষ্ঠানের ঘোষক তাকে দীর্ঘসময়ের সরকার প্রধান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন।

শেখ হাসিনার জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। আওয়ামী লীগের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। তুলনা করার বিষয় নয় কিন্তু জানা থাকা দরকার ৪৩ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই পরিচালিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠার সময় আওয়ামী মুসলিম লীগে অন্য ধর্মের মানুষের যোগ দেওয়ার সুযোগ ছিল না।

ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানে তখন নির্বাচনও হতো ধর্মকেন্দ্রিক। কিন্তু মাত্র ৬ বছরের মধ্যেই বাংলার রাজনীতিকরা দলকে সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত করে দলের নাম পরিবর্তন করে দিয়েছিল ১৯৫৫ সালে। আর বাঙালিদের মধ্যে অগ্রসর তরুণ রাজনীতিক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলের সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এর তিন বছরের মাথায় দলের নাম বদলে যায়।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকে গড়ে ওঠা প্রবীণ রাজনীতিক দলের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আর তরুণ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান নাম বদলের জোরদার ভূমিকা রাখলেও, তখনকার সরকারের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী চাইছিলেন না ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিতে।

৯ জুন ২০২৪ দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেন শেখ হাসিনা। যখন তিনি প্রবেশ করছিলেন অনুষ্ঠানের ঘোষক তাকে দীর্ঘসময়ের সরকার প্রধান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন।

আওয়ামী লীগ থেকে ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী দল ত্যাগ করার পর শেখ মুজিবুর রহমান বলা যায় নিজস্ব কারিশমায় দলকে এগিয়ে নিয়ে যান। ১০ বছরের মাথায় ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ঘোষণা আর ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই তিনি দলকে গড়ে তোলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায়।

তার মাথা থেকেই এসেছিল রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় চার মূলনীতির দুটি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতা’, এগুলোও জাতির পিতার মাথা থেকেই এসেছিল। কারণ শেখ মুজিবই ১৯৬৫ সালের দাঙ্গায় রুখে দাঁড়িয়েছিলেন মানবতার পক্ষে।

এবার যখন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে তখন কেউ না কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে সেই অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা কি ফিকে হয়েছে একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে? অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জমি উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতা, আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকলে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদের স্বস্তিতে থাকা বা প্রশাসনে সব ধর্মের প্রতিনিধিদের গুরুত্ব দেওয়া নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের প্রতিফলন।

কঠিন বাস্তবতায় এখনো ফিরে যাওয়া যায়নি ১৯৭২ এর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতায়। আর অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিলের পর প্রশাসনের মদদে ‘ক’ তালিকা, ‘খ’ তালিকার জটিলতা কতটা গ্রহণযোগ্য? দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কি তা নিয়ে আলোচনা করা অন্যায় হবে?

এখনো প্রতি দুর্গাপূজায় শেখ হাসিনার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটি ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দ। ১৫ বছরে দেশে দুর্গাপূজায় পূজামণ্ডপের সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের বরাদ্দ। রামুর বৌদ্ধ মন্দির পুনর্নির্মাণ হয়েছে অল্প সময়ের মধ্যেই।

২০০৮ সাল থেকে একনাগাড়ে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। এই সময়েও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-হয়রানি বন্ধ হয়নি। কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ, পাবনার সাঁথিয়া, দিনাজপুর, সাতক্ষীরার তালা, বাগেরহাটের মংলা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, রাজশাহীর মোহনপুর, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, যশোরের বেনাপোল, মাগুরার মহম্মদপুর, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা হয়েছে। এই ঘটনাগুলো ভুলে যাওয়া কঠিন।

...তার মাথা থেকেই এসেছিল রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় চার মূলনীতির দুটি ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতা’, এগুলোও জাতির পিতার মাথা থেকেই এসেছিল।

২০১৭ সালে হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী পাঁচটি পদ্য বাদ দেওয়া হয়। সেগুলো হলো—জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া’, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘আমার সন্তান’, লালন শাহর ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা’ ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’। এছাড়া বাদ দেওয়া হয় ভ্রমণকাহিনি ‘পালামৌ’, হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘বই’ নামের কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, কাজী নজরুল ইসলামের 'বাঙালির বাংলা'।

শুধু ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয় নয় শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। পাঠ্যসূচির সংশোধনে ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘আপস’ কি আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সংগতিপূর্ণ?

৭ জুন ২০২৪ ছয়দফা দিবসের একটি লেখায় প্রশ্ন তুলেছিলাম যে, ছয়দফায় অর্থনৈতিক বৈষম্যই প্রধান বিষয় ছিল, কিন্তু আওয়ামী লীগ একটানা ১৫ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করার পরও কেন অর্থনৈতিক বৈষম্য কমছে না? জাতির পিতা শোষিতের পক্ষে নিজের অবস্থান দৃঢ়তার সাথে উচ্চারণ করেছিলেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অসংখ্য ভাষণ এখন শোনা যাচ্ছে। অথচ আর্থিক খাতের দুর্বলতা নিয়েই এখন বেশি কথা হচ্ছে। যখন মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে চীনকে টপকিয়ে মিঠা পানিতে মাছের উৎপাদনে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসার কথা বলেন তখন অর্থমন্ত্রী তার সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন।

আওয়ামী লীগ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দেয়, তখনই ‘বেনজীরকাণ্ডে’ সরকার ও দল বিব্রত হয়। আওয়ামী লীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতাদের কথায়ও যুক্তির অভাব দলের নেতা-কর্মীদের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয় না।

ছয় যুগের পুরোনো আর বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কাছেই হয়তো প্রত্যাশা বেশি। ছয়দফা নিয়ে বঙ্গবন্ধু যেভাবে ছুটে গিয়েছিলেন বাঙালির দুয়ারে দুয়ারে ঠিক যোগ্য পিতার যোগ্য কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা দেশের পথে-প্রান্তরে ঘুরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে জনপ্রিয় করে তা আদায়ে সমর্থ্য হয়েছিলেন, একই সাথে ২১ বছর পর দলকে রাষ্ট্রপরিচালনার সাথে যুক্ত করেছিলেন।

৫ বছরে কোনোকিছুর সাথে আপস না করায় ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গিয়েছিল। তার জন্য এখন এই প্রশ্ন তোলা যাবে কি, আওয়ামী লীগ কৌশলের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করে সরকার পরিচালনার ধারাবাহিকতায় টিকে থাকুক নাকি আদর্শের রাজনীতির ‘জজবা’ তুলে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ুক, চাওয়া কোনটি?

কী চাওয়া মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ লালনকারীদের? লাগামহীন দুর্নীতিতে আপত্তি নেই তবুও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকুক নাকি সেই কৌশল অবলম্বন করুক যাতে দুনীতি দূর হোক। রাজাকার আলবদরা যাতে আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না ফেরে তার জন্য আওয়ামী লীগ ধর্ম নিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকে দলকে গড়ে তুলুক। যাতে ক্ষমতা পরিবর্তনের প্লে-মেকারদের সব চক্রান্ত প্রতিহত করার মতো শক্তি অর্জন করুর এত বছরের প্রাচীন দলটি। ২৩ জুনে কি তা খুব বড় বেশি চাওয়া?   

প্রণব সাহা ।। এডিটর, ডিবিসি